ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে সচেতন ও সতর্ক হোন
৪ মার্চ ২০২৩ ১৮:৫২
প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা স্হানে অসংখ্যবার ভূমিকম্প হয়। ছোট বড় নানা মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এই ভূমিকম্পের আঘাতের কারণে ঘরবাড়ি সহ নানান স্হাপনা ধ্বংস হয়, ক্ষতিগ্রস্হ হয় অনেক কিছু। প্রতিবছর অসংখ্যবার ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্প কখনো ছোট আকারের হয় আবার কখনো বড় আকারের হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্হা ইউ. এস জিওলজিক্যাল সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর কয়েখলাখ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এগুলোর মধ্যে ১৭ টি বড় আকারের ভূমিকম্প রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার বেশি। আট মাত্রার ভূমিকম্প হয় বছরে গড়ে একবার। মৃদু ভূমিকম্প গুলো সাধারণভাবে অনেক সময় বোঝা যায় না। জনবহুল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংগঠিত হওয়া ভূমিকম্প সাধারণ মানুষ অনেক সময় খেয়াল করে না।
সম্প্রতি তুরস্ক ও সিরিয়াতে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংগঠিত হয়। এটি সংগঠিত হয় তুরস্কের গাজিয়ানতেপ সহ পাশ্ববর্তী দেশ সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায়। এ ভূমিকম্পে মূর্হুত্বে সব লন্ডভন্ড করে দেই সবকিছু। প্রথম আঘাত হানার পর দ্বিতীয় শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে৷ পরের দিন আবারো তুরস্ক মধ্যাঞ্চলে আঘাত হানে৷ এক মিনিটের ভূমিকম্পে লন্ডভন্ড তুরস্কের গাজিয়ানতেপ। চারদিকে হাজারও মানুষের কান্না আর্তনাদ। ভূমিকম্প নয় যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়৷ প্রাচীন দেশ তুরস্ক ও সিরিয়া। নগর স্হাপনায় সৌন্দর্যই গাঁথা এসব স্হাপনা। ভয়াবহ এক মিনিটের ভূমিকম্পের কারণে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে সবকিছু। এ ধরণের কম্পরের কারণে সাড়ে ১০ হাজারের বেশি ভবন ভেঙে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তুরস্কের ১০ টি শহরে ক্ষতিগ্রস্হ হয়। সেসব এলাকায় মাইলের পর মাইল ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। রাস্তাঘাটে ফাটল দেখা দিয়েছে। মৃত্যুর মিছিল সব জায়গায়। ৪৫ হাজারের বেশি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এমনকি উদ্বেগজনক হারে হু হু করে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। বাতাসের সাথে লাশের গন্ধ। খুবই মর্মান্তিক ও হ্নদয় বিদারক ঘটনা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা উদ্ধার কর্মীরা উদ্ধার করতেছে লাশ ও জীবিতদের। ১১ দিন হয়ে যাওয়ার পরও এখনো পর্যন্ত জীবিত মানুষ উদ্ধার করছে। অনেক বিল্ডিংয়ে এখনো উদ্ধার কাজ শুরু করতে পারেনি। এমনকি কাফনের কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না৷ খাবারের সংকট খুবই প্রকট। ঠান্ডা পড়ছে মাইনেস ১০ ডিগ্রির মতো। তীব্র ঠান্ডা উপেক্ষা করে উদ্ধার কার্যক্রম চলছে।
ধারণা করা হচ্ছে, তুরস্ক ও সিরিয়াতে ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে আড়াই কোটির বেশি মানুষ ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়ে নানাভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্হ হয়েছে। এই ভূমিকম্পে ৮৪ বিলিয়নের মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তুরস্কের৷ মাইলের পর মাইল বিচ্যুতি হয়েছে ভূমির। ৩০০ কিলোমিটারের মতো ফাটল৷ স্বজন হারিয়ে সবার আর্তনাদ চারদিকে। বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্ধার কর্মীরা গিয়ে বিল্ডিং থেকে উদ্ধার করতেছে হাজার হাজার মানুষকে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন- ভূমিকম্পের কারণে ভৌগোলিক নকশায় নাকি বদলে গেছে। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, ইন্দোনেশিয়ার মতো তুরস্ক বিশ্বের সবচেয়ে ভূকম্পন এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। দেশটির অবস্হান সেখানে, যেখানে সক্রিয়ভাবে গতিশীল বেশ কয়েকটি ফল্ট একত্রিত হয়েছে। তাই ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
গত কয়েকদিন আগে সিলেটে ৪.৩ মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এটির কেন্দ্রস্হল মেঘালয়। এটি ছাতকের ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এতে সিলেটে মৃদু কম্পন অনুভূত হয়। যদি রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্হ অনেক বেশি হয়ে থাকে। দুর্যোগ, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় হলে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়৷ ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়, প্রস্তুতি নেওয়া যায়। ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই আলাদা। ভূমিকম্প এমন যা কখন হবে কখন হতে পারে সে বিষয়ে জানা যায় না৷ বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত ভূমিকম্প কখন হবে তা জানার জন্য কোন প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারেনি৷ বাংলাদেশে আরো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়। তাই সবসময় সতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে এবং সচেতন করতে হবে জনসাধারণকে৷ রিখটার স্কেলে যদি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে বাংলাদেশ কি সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন- তুরস্কের চেয়ে ছোট ভূমিকম্প হলেও রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ভবন ধস হবে এবং পাশাপাশি অপরিকল্পিত ভাবে ঢাকায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন, গ্যাসের লাইন, পানির লাইন, অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে। তুরস্ক ও সিরিয়ার ভয়াবহ ভূমিকম্প কাঁপিয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্বকে। বাংলাদেশও এই শঙ্কার বাহিরে নয়। বাংলাদেশে ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে সবসময়। যে কোন সময় ভয়াবহ ভূমিকম্পে ডেকে আনতে পারে মানবিক বিপর্যয়।
ভূতাত্ত্বিক গঠন ও অবস্থানের কারণে বড় ভূমিকম্প হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এমন ৮ টি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন আছে। এ ফল্ট থেকে যে কোন সময় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা৷ ওনারা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন। রাজধানী ঢাকায় হলে মানবিক বিপর্যয় বেশি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ গণবসতি অপরিকল্পিত নগরায়ণ তৈরী করার কারণে। বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ছোট বড় ভূমিকম্পে ১৪২ বার কেঁপে উঠে৷ আর বাংলাদেশে ভূমিকম্পে প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে শহরঞ্চলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- ছোট মাঝারি ভূমিকম্পগুলো কে হেলা করলে হবে না, এগুলো ভালো বার্তা দেই না। তাই সবসময় সতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে। কারণ এগুলো বড় ভূমিকম্পের আলামতও বটে। ভূমিকম্পবিদরা বলেন, বড় ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে শতবছরের আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়।
বাংলাদেশে যদি বড় ভূমিকম্প হয় রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার মতো তাহলে কয়েক হাজার ভবন ধসে পড়বে। তাই নিরাপদ আবাসস্হল, পরিকল্পিত ভাবে ভবন তৈরী করতে হবে। নগরায়ণ হতে হবে পরিকল্পিত। জনসাধারণ কে আতঙ্কিত না করে সচেতন ও সতর্ক করা উচিৎ। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্হাপনা কর্মসূচির সমীক্ষা তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে৷ ভূমিকম্প কখন কোথায় হবে কেউ বলতে পারে না। তা জানার প্রযুক্তি এখনো কোন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করতে পারেন নি৷ তাই কোন ভবন তৈরীর সময় ফাউন্ডেশন দিয়ে ভূমিকম্প সামলাতে পারে এরকম করে ভবন তৈরী করতে হবে। শহরঞ্চলে ভবন নির্মাণের সময় বিধি নিষেধ মানতে হবে নির্মাণ বিধি মেনে ভবন তৈরী করতে হবে। পরিকল্পিত ভাবে নগরের সবকাজ করতে হবে এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালন, গ্যাসের লাইন টানার সময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ভূমিকম্পের জন্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে৷ ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে উদ্ধারে প্রস্তুতি থাকতে হবে। জনগণের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি না করে সচেতনতা তৈরী করতে হবে৷ দ্রুত নগরায়ণের ফলে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর ব্যবস্হা নিতে হবে। এলাকাভিত্তিক প্রশিক্ষণ সেচ্ছাসেবক দল গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের দ্বারা জনসাধারণে মাঝে জনসচেতনতা মূলক সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। জাপানের মধ্যে প্রায়ই সময় ভূমিকম্প হয়ে থাকে৷ তারা ভয়কে জয় করেছে৷ তারা ভূমিকম্পের জন্য সবসময় প্রস্তুতি থাকে। তাই তাদের ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয় না, তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুবই কম। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিম্নমাণের রাখে এবং ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে বিপর্যয় স্বল্প সময়ে সামাল দেই। তুরস্কের ভয়াবহ ভূমিকম্প থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে সচেতন ও সতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে এবং ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে৷
বিশেষজ্ঞরা রিখটার স্কেলে ৭ বা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে যা ঘটতে পারে বলে মনে করেন—
১. রাস্তাঘাট ধসে লাইটপোস্ট নিচে পড়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ, ভবনের কাচ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে নিচে পড়া। রাস্তার বিলবোর্ড ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২. বিদ্যুৎ সঞ্চালনের তার ছিঁড়ে নিচে পড়া এবং মাটির নিচে দিয়ে যাওয়া গ্যাস ও পানির লাইন ফেটে উপরে ওঠে আগুণ ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
৩. মোবাইল ফোনের টাওয়ার ধসে পড়া এবং মোবাইল ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রগুলো ক্ষতিগ্রস্হ হওয়া। মোবাইল ও বিদুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
৪. আগুণ নিভানোর সংকট দেখা দিবে। ফায়ার সার্ভিস পৌঁছাতে না পারা রাস্তা বন্ধ থাকার কারণে৷
ভূমিকম্পের সময় যা করবেন—
১. ভূমিকম্প হওয়ার সময় জীবন বাঁচাতে হলে প্রথমেই মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আতঙ্কিত হওয়া যাবে না৷
২. গ্যাসের চুলা বন্ধ করে দিন এবং মেইন গ্যাসের লাইন বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্হা নিবেন।
৩. বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করতে হবে এবং লিফট থাকলে তার সুইচও বন্ধ করে দিন।
৪. যদি বাসাবাড়িতে থাকেন তাহলে মাথায় বালিশ দিয়ে ঢেকে টেবিল,খাট ও শক্ত আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নিন৷ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অবশ্যই মাথায় বালিশ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে৷ কোনো অবস্হাতেই লিফট ব্যবহার করা যাবে না৷
৫. ঘর থেকে বের হওয়া না গেলে ইটের তৈরী পাকা ঘর হলে ঘরের কোণে এবং কলাম ও বিমের তৈরী ভবন হলে কলামের গোড়ায় আশ্রয় নিন৷ টিনের ঘর হলে শক্ত খাট ও চৌকির নিচে আশ্রয় নিন।
৬. স্কুল, কলেজ বা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকলে মাথায় ব্যাগ দিয়ে শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নেন এবং শিল্পকারখানা, মার্কেট, হাসপাতালে হুড়োহুড়ি না করে এক জায়গায় মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন দরজার সামনে ভিড় বা ধাক্কাধাক্কি করবেন না৷
৭. গাড়িতে থাকলে গাড়ি একপাশে থেমে গাড়িতেই থাকুন। সমুদ্র বা নদীর ধারে থাকলে উচুঁ জায়গায় অবস্হান নিতে হবে। ঘরের বাইরে থাকলে উঁচু বাড়ি, বড় গাছ ও বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে থাকবেন। একবার কম্পন হওয়ার পর আবারো কম্পন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাই খোলা জায়গায় আশ্রয় নিন।
সতর্কতা ও সচেতনতা—
১. ভূমিকম্প সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিন।
২. ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি থাকতে হবে৷
৩. ভূমিকম্পে ঝুঁকি ও করণীয় সম্পর্কে অবহিত থাকতে হবে।
৪. এলাকাভিত্তিক প্রশিক্ষিত সেচ্ছাসেবক দল গড়ে তুলতে হবে। তাদের মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা তৈরী করতে হবে।
৫. বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সভা, সেমিনারের আয়োজন করতে হবে।
৬. সরকার ও গণমাধ্যমকে মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
৭. ভবন তৈরী করার সময় নির্মাণ আইন অনুযায়ী ভবন তৈরী করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ
সারাবাংলা/এসবিডিই
ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে সচেতন ও সতর্ক হোন মুক্তমত রায়হান উদ্দিন