Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বার্থলীগের অপতৎপরতায় বিধ্বস্ত ছাত্রলীগের আদর্শ

সুকান্ত দাস
৫ মার্চ ২০২৩ ১৪:২২

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে নবীন এক ছাত্রীর উপর মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের খবর প্রচার হওয়ার পর থেকে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের উপর রাগ, ক্ষোভ কিছু ক্ষেত্রে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশও করছেন অনেকেই। একই সময়ে রাজশাহীসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু সংখ্যক ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দ্বারা সাধারণ শিক্ষার্থী আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো খারাপ ঘটনার জন্য শিরোনামে আসছে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নাম।

বিজ্ঞাপন

ছাত্রলীগ বর্তমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার শিখরে থাকলে চারপাশে সুবিধাভোগীদের আনাগোনা বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা শুরু হবে তখন, যখন এই লোকগুলো নিজেদের সুবিধার জন্য দলের নাম এবং ক্ষমতা ব্যবহার করবে। আর দলের মধ্যেও স্বাভাবিকভাবেই কিছু মানুষ থাকবে যারা ছাত্রদের ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিটা দল কিংবা সংগঠনের নিজস্ব কিছু নিয়ম, নীতি, আদর্শ থাকবে। তারা এটি জনগণের মাঝে প্রচার করে তাদের সমর্থন আদায় করে নিবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নীতি আদর্শের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় না। গতবছর ফেব্রুয়ারী মাসে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। একপর্যায়ে সেখানে জেলার নেতারা উপস্থিত হন। এইসময়ের কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখিও হয়। সবচেয়ে আলোচিত ভিডিওতে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা চলে যাচ্ছি। যারা ছাত্রলীগ করেন তারা আমাদের সাথে যাবেন, যারা করেন না তারা থাকেন, আন্দোলন চালায়ে যান। যারা জামায়াত-শিবির করেন তারা আন্দোলন চালান।’ এরপর জেলার আরেক নেতা বলেন, ‘যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, যারা ছাত্রলীগ করেন তারা এই আন্দোলন থেকে সরে যান। তাদের অনুরোধ করি তারা আন্দোলন থেকে সরে যান।’

সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষমাত্রই আঁতকে উঠবেন এই কথা শুনে। কি ভয়ংকর ব্যাপার! ধর্ষণের প্রতিবাদে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা আর সেখানে এসে কিনা তথাকথিত কিছু নেতারা বলছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকেরা আন্দোলন থেকে চলে যাও! যে মহান নেতার জন্ম না হলে এ দেশের স্বাধীনতা আসত না, যিনি সারাজীবন নির্যাতিত অসহায় মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল খেটেছেন তার নাম করে এমন জঘন্য কাজ করছে একটা গোষ্ঠী। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বহিষ্কার হয়েছিলেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে থাকার কারণে। জীবনের অর্ধেক সময় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কারাগারে কাটিয়েছেন। আর এখন তার নামেই নির্যাতিত মানুষের বিপক্ষে দাঁড়াচ্ছে একদল সুবিধাভোগী মানুষ। এদের বিরুদ্ধে কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

দলের যে ই অপরাধ করুক না কেনো বদনাম সংগঠনের নামেই আসে। আর এর জন্য যে শুধু দুধের মাছিরা দায়ী তা নয়, এদের যারা সুযোগ দেয় তারাই দায়ী। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচজন শিক্ষার্থী বহিষ্কার হয়েছে তাদের অপরাধের কারণে। কিন্তু এদের পেছনের যে শক্তি, যারা এদের অপরাধ করতে সাহস যুগিয়েছে তাদের নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। যদি সেই লোকগুলোকে চিহ্নিত করা যেত এবং তাদের বিরূদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া হত তাহলেই অপরাধ বন্ধ হত। বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটন না করলে ওটা মানুষের ক্ষতি করতেই থাকবে।

বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যার পর হত্যার সাথে যুক্তদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে কিন্তু যারা এই অপরাধ সংগঠিত করতে উস্কানি দিয়েছে সেই কুশীলবদের বিচার হয়নি। যে কারণে অপরাধ থেমে নেই। মাঝে কতগুলো মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবন নষ্ট হয়ে গেলো এবং ছাত্র সংগঠনটির বদনাম হলো। অথচ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্যই। নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি সংগঠন আগেই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর দেখা গেল এই সংগঠন শুধু শাসকশ্রেণীর তাঁবেদারি করতে ব্যস্ত। তখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি সংগঠনের সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতার পর নাম পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানের বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হয়।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন থেকে ছয় দফা, উনসত্তরের গনঅভ্যুত্থান থেকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ সব জায়গায় ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। পরবর্তীতে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, জননেতা তোফায়েল আহমেদ, বর্তমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এরা সবাই ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন। বহু নির্যাতন সহ্য করেছেন। পুরাতন অনেক পত্র পত্রিকা পড়েছি। তোফায়েল আহমেদ টেন্ডারের পিছনে ছুটছেন কিংবা ওবায়দুল কাদের চাঁদাবাজি করেছেন কোথাও এমন খবর পাইনি। তারা কখনও এমনকিছু চিন্তা করতে পারেননি। তাদের সেই ত্যাগের রাজনীতি এখন আর নাই।

এখন ছাত্রলীগের কিছু নেতা হলের সিট বানিজ্য করে, শিক্ষার্থীদের পেটায়, চাঁদাবাজি করে, সাংবাদিক পেটায়, নারী শিক্ষার্থীর শ্লীলতাহানি করে, বিভিন্ন আন্দোলনে বাধা দেয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীর পা হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে দেয়, ইডেন কলেজের কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত থাকে। এরা কেউ ছাত্রলীগের আদর্শ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিজের মধ্যে ধারণ করে না। এরা নিজের স্বার্থকে ধারণ করে এবং দলের নাম ব্যবহার করে।

ছাত্রলীগ একসময় সকল শিক্ষার্থীর বন্ধু ছিলো। সুবিধা অসুবিধা সবকিছুতে সাহায্য করতো। শিক্ষার্থীদের বিপদে পাশে থাকত। এখনও যে থাকে না তা নয়। এই তো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের যে নেত্রী বহিষ্কার হয়েছেন, কয়েকমাস আগে বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালীন মেয়েদের হলে বড় পর্দায় খেলা দেখার ব্যবস্থা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। কিন্তু তিনি এবং তার সহযোগীরা যে ঘটনা কয়েকদিন আগে ঘটিয়েছেন এটা তো অমানবিক। ছাত্রলীগের ছেলেরা করোনার সময় মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত মানুষের সৎকার করেছেন, অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করেছেন। এগুলো তো ছাত্রলীগের সেই গৌরবময় ইতিহাসের অংশ। কিন্তু হলের গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, ধর্ষকের পক্ষে দাড়ানোর ঘটনা ছাত্রলীগের সেই ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বসেছিলাম। ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি সাদ্দাম হোসেন কয়েকদিন আগে বলেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্যাতিতা ছাত্রী ‘ফুলপরী ছাত্রলীগের প্রতিবাদের নাম’। এ বিষয়ে পত্রিকায় লেখা পড়ছিলাম। হঠাৎ আমার পাশেই একজন শিক্ষার্থী এটা দেখে বলল, ফুলপরী ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার, প্রতিবাদের নাম নয়। শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ছাত্রলীগের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনোভাব কতোটা নেতিবাচক হয়ে যাচ্ছে এটা ভেবে। ছাত্রলীগ যেন তাদের কাছে একটা ত্রাসের নাম।

কিন্তু এমন তো হওয়া উচিত ছিল না। ঐতিহাসিক একটি ছাত্র সংগঠনের গায়ে প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পর এসে এমন কালিমা লেগে যাবে এটা হয়তো কেউ চিন্তা করেনি। নীতি এবং আদর্শ না থাকলে এতোদিন কোনো সংগঠন টিকে থাকতে পারে না। ছাত্রলীগের নীতি, আদর্শ অবশ্যই আছে। কিন্তু কিছু বিপথগামী নেতা এবং সুবিধাবাদীদের অপকর্মে চাপা পড়ে যাচ্ছে সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের উচিত সংখ্যা নয় মানের ভিত্তিতে নেতাকর্মী যুক্ত করা। কারণ অধিকাংশই দুধের মাছি। দলের বিপদে কেউ এগিয়ে আসবে না। আর বিভিন্ন অপকর্মের পিছনে যেসব স্বার্থান্বেষী মহল জড়িত তাদের প্রতিহত করা উচিত। ছাত্রলীগের আদর্শ চাপা পড়ে যাচ্ছে স্বার্থবাদী কিছু মানুষের অপতৎপরতায়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ভয় পায়, কিছু ক্ষেত্রে ঘৃণাও করে। এই মনোভাব পরিবর্তনের চেষ্টা করা উচিত। নেতাদের হাতের পুতুল না হয়ে, শিক্ষার্থীদের শোষণ না করে তাদের বন্ধু হয়ে উঠতে পারলেই উপমহাদেশের পুরাতন এবং ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনের গৌরবময় দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

সারাবাংলা/এসবিডিই

মুক্তমত সুকান্ত দাস স্বার্থলীগের অপতৎপরতায় বিধ্বস্ত ছাত্রলীগের আদর্শ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর