৭ই মার্চের ভাষণ; মন্ত্রমুগ্ধ অমর কবিতা
৭ মার্চ ২০২৩ ১৩:৫৫
‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে / রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে / অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাড়ালেন / তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা / জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার, সকল দুয়ার খোলা / কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী? / গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি / এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’- কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এক অমর কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। কবিতা! কবিতাই বটে। এর চেয়ে ছন্দময় কাব্য আর কোনকালে রচিত হয়নি। সাহস জাগানিয়া অমর শব্দমালা কোনকালে রচিত হয়নি। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সেদিন রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ যে যেভাবে পেরেছে সেভাবে এসে জনসমুদ্র তৈরি করেছে। রেসকোর্স ময়দান ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। সমবেত হওয়া লাখ লাখ মানুষ বার বার গর্জনে ফেটে পরছিল। একটি ভাষণ যা মন্ত্রের মত সবার মাঝে ছড়িয়ে গেল, একটি ভাষণ যা লাখ লাখ বাঙালিকে প্রেরণা যোগালো, একটি ভাষণ যা স্বাধীনতার পথ দেখালো- এটা নিঃসন্দেহে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষণ, এক অমরগাঁথা। তাই ভাষণ আর কেবল ভাষণ থাকলো না হয়ে গেল এক অমর গাঁথা। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বাঙালির মাঝে এতটাই জনপ্রিয় এবং তরুণ প্রজন্মকে এত তীব্র আর্কষণ করে যে ছাত্রছাত্রীরা ভাষণটি জানে। তাদের অন্তরে ঠাঁই করে নিয়েছে এই ভাষণ। চোখ বুজলেই যেন সেদিনের সেই জনসমুদ্র, বঙ্গবন্ধুর পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে দেয়া, অন্তরে ভয় ধরিয়ে দেয়া সেই বজ্রকন্ঠ ভাষণ শুনতে পাই। যা চিরকালের, চিরশাশ্বত। কবি নির্মলেন্দু গুণ তাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে অমর কবিতা বলেছেন। পশ্চিমা বিশ্ব তাকে বলেছে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’। বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ দিন যে দিনের জন্য লাখ লাখ বাঙালি অপেক্ষা করছিল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির প্রিয় নেতার মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা এবং ভয় ও শঙ্কার বাইরে এসে সর্বোচ্চ প্রতিরোধ করার মূলমন্ত্র পাওয়ার অপেক্ষা ছিল।
২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালি আক্রান্ত হওয়ার পর বাঙালি সশস্ত্র প্রতিরোধের স্পৃহা সেই ৭ই মার্চেই পেয়েছিল। সবার সামনে, খোলা মঞ্চে দাড়িয়ে দৃপ্ত কন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালির অন্তরকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আজও যখন টিভির পর্দায় সেই দিনের কোন ভিডিও চিত্র দেখি নিজেদের রক্তে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করি। মনে হয় সেদিনের সেই মঞ্চের সামনে বসে স্বাধীনতার ঘোষণার অপেক্ষায় আছি। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ অসংখ্য ভাষায় অনুদিত হয়েছে। প্রায় আড়াই হাজার বছরের সেরা ভাষণ নিয়ে ২০১৪ সালে লেখক ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড এর সংকলিত গ্রন্থ ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচ দ্যাট ইনস্পায়ার্ড হিস্টোরি’ গ্রন্থে এই ভাষণ স্থান পেয়েছে। বাঙালির চেয়ে এই ভাষণের গুরুত্ব আর কে বুঝবে? আর কে ভালোবাসবে? জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর শক্তি যুগিয়েছিল যে ভাষণ তার তুলনা হয় না। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এ ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা,বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। ডকুমেন্টারি হেরিটেজ হলো সেই সব নথি বা প্রামাণ্য দলিল, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যার ঐতিহ্যগত গুরুত্ব আছে। আর সেসব ঐতিহ্যের তালিকা হলো ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিষ্টার’। এসব দলিল সংরক্ষণের পাশাপাশি বিশ্বের মানুষ যাতে এ বিষয়ে জানতে পারে সে জন্যই ১৯৯২ সালে এ কর্মসূচি শুরু করে ইউনেস্কো। গবেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সার্বজনীনতা এবং মানবিকতা। এই ভাষণ যে কোন নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে কাজ করে। এই ভাষণ একটি জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছে। এই ভাষণ একটি দেশের সব মানুষকে একসাথে শত্রুর মোকাবেলা করার সাহস যুগিয়েছে। লাখ লাখ মানুষের মনে যে বিশ্বাস, যে চাওয়া, যে আকাঙ্খা ছিল বঙ্গবন্ধু সেদিন সে কথাই তাদের শুনিয়েছেন।
স্বাধীনতা একটি স্পর্শমণি যা প্রতিটি নাগরিক চায়। আমরাও চেয়েছিলাম। খুব করে চেয়েছিলাম। অনেক ত্যাগ, অনেক শ্রম আর বুকের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আজকের এই সমৃদ্ধির পথে ধাবমান বাংলাদেশ প্রায় শূণ্য থেকে শুরু করেছিল তার যাত্রা। ১৯৪৭ সালের ভারতীয় উপমহাদেশ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হওয়ার পর পাকিস্থান পূর্ব পাকিস্থান থেকে যায় পশ্চিম পাকিস্থান দু’টি অংশ হয়। পূর্ব পাকিস্থানকে পশ্চিম পাকিস্থানের শাসক গোষ্ঠী সবক্ষেত্রে বঞ্চিত করতে থাকে বাঙালির ন্যায্য অধিকার থেকে। তারা সব ক্ষেত্রে শোষণ করতে থাকে। ক্ষেত্রে বিমাতাসুলভ আচরণ করতে থাকে পশ্চিম পাকিস্থান। আমরা ছিলাম কেবল শোষিত হওয়ার জন্য। পূর্ব পাকিস্থানের জনগণের ন্যায্য হিসাব থেকে বরাবর বঞ্চিত করা হয়েছে। বৈষম্যের ঘেরাটপে বন্দী ছিল বাঙালি। প্রথমেই তারা আমাদের ভাষার স্বাধীনতায় বাধা দেয়। সেখানেও বাঙালির রক্ত ঝরে। রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার রক্ষা করে বাঙালিরা। তারপর থেকে দিন গড়ানোর সাথে সাথে স্বাধীনতার দাবি আরও জোরালো হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। সেই ছিল বাঙালির অন্তরে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনে দেওয়া। সেই স্বপ্ন নিয়েই বাঙালি ঝাঁপিয়ে পরে শক্তিশালী পাকিস্থান বাহিনীর বিরুদ্ধে। তারপর ২৫ মার্চ সেই কাল রাত বাঙালির জীবনে নেমে আসে। ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মম আক্রমণ চালায় পাকিস্থান সেনাবাহিনী। দীর্ঘ নয় মাস পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। নতুন যে দেশ আমরা তখন পাই তার অবকাঠামো থেকে শুরু করে তেমন কিছুই ছিল না। এমনকি জাতিকে থামিয়ে দিতে বিজয়ের একেবারে আগে দেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয়েছিল। কি ঘৃণ্য পরিকল্পনা ছিল!
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন এক সময় এই ভাষণ দিয়েছিলেন যখন প্রতিটি পদক্ষেপে তার জন্য বিপদ অপেক্ষা করছিল। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তাকে ভাষণ দিতে হয়েছিল। ইতিহাসে তাই তিনি মহাবীর। ইতিহাসে তিনি তাই অমর। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিশেষজ্ঞরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। একটি ভাষণে এত দিকের সমন্বয়, এত দুরদৃষ্টিসম্পন্ন চেতনা পৃথিবীর আর কোন ভাষণে আছে কি না জানা নেই। তিনি তার ভাষণে বাংলার নিপিড়ীত মানুষের শোষণ ও বঞ্চনার কথা তুলে ধরেন, তিনি তার ভাষণে বাঙালির ওপর নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন, তিনি তার ভাষণে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন, গণতান্ত্রিক চেতনার কতা বলেন এবং সবশেষে প্রতিরোধের কথা বলেছেন। উত্তাল জনসমুদ্র যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তখন বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন তার চূড়ান্ত আদেশ- ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে প্রতিরোধের কথা শোনার সাথে সাথেই সামনের লাখ লাখ জনতা নিজেদের মনকে সংগঠিত করে ফেলে স্বাধীনতার জন্য। নিজেদের প্রস্তুত করে নেয় স্বাধীনতার জন্য। অথচ এই বাঙালির হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। কেবল স্বাধীনতার বীজমন্ত্র অন্তরে সেই যে বুনে দিয়েছিল সেখান থেকেই সাহস সঞ্চয় করে দেশপ্রেমকে অনুপ্রেরণা কাজে লাগিয়ে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে উদ্ভদ্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ তাই এক অনুপ্রেরণার নাম, এক উদ্দীপনার নাম।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই