Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিক্ষায় নারী

অলোক আচার্য
৮ মার্চ ২০২৩ ১৬:৩৬

উন্নয়নের অংশীদার নারী ও পুরুষ। যদি একটি অংশ দুর্বল থাকে তাহলে সুষম উন্নয়ন অসম্ভব। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেল। এই রোল মডেল হওয়ার সমক্ষেত্রে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। এজন্য আমাদের রয়েছে বিশাল জনসংখ্যা। এই বিশাল জনসংখ্যার অংশ হলো নারী ও পুরুষ। আমাদের দরকার দক্ষ জনশক্তি। জনশক্তি অর্থ হলো নারী ও পুরুষ উভয়কে দক্ষ করে গড়ে তোলা। যে দেশগুলো বিশ্বে উন্নত দেশের কাতারে দাড়াতে পেরেছে সেই সব দেশই নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম করেছে। নারী ও পুরুষের পাশাপাশি অবদানেই এগিয়ে চলেছে। আমাদের দেশেও সেটাই হচ্ছে। একসময় যে ক্ষেত্রগুলিতে নারীর অংশগ্রহন চিন্তা করা যেতো না অথবা সামাজিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেতো সেই ক্ষেত্রগুলো এখন মুক্ত। ফলে নারীরা স্বাধীনভাবে এসব ক্ষেত্রে অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। দেশ যতই এগিয়ে চলেছে পুরুষের সাথে সাথে উন্নয়নের কর্মজজ্ঞে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়ন হলো দেশের উন্নয়ন কাজে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ। সেই সুযোগের শুরু হয় শিক্ষা থেকে। আজ প্রতিটি কাজে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রবাস, আইসিটি মোটকথা অর্থনীতি প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীর অবদান বাড়ছে। যেখানে নারীরা ঘরের কাজ করতো এখন সেখানে চাকরি-ব্যবসা করছে। বাংলাদেশে কর্মজীবি নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। লেখাপড়া শেষে নারী-পুরুষ উভয়ই চাকরির জন্য প্রতিযোগীতায় বসছে। সংসার পরিচালনার সাথে সাথে তারা চাকরি, ব্যবসা করছে। গ্রামে প্রায়ই ছোটোখাটো দোকান চালাতে দেখা যায় নারীদের। ঘরে বসে আজ ই-কমার্সের যুগে নারীরা ব্যবসা করছেন। ২০১০ সালে যেখানে কর্মজীবি নারীর সংখ্যা ছিল ১৬ দশমিক ২ লাখ সেখানে ২০১৬-১৭ সালে এসে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় ১৮ দশমিক ৬ লাখ। এই সময়ের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এ সবই নারী শিক্ষার অগ্রগতির ফলেই সম্ভব হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

নারীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। এর মধ্যে অন্যতম এবং প্রধান শিক্ষা। শিক্ষা সকল অন্ধকার দূর করতে সক্ষম এই সূত্র মেনেই নারী শিক্ষায় গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিক্ষা নিয়ে অন্ধকারে থাকলে নারী কোনোদিনই আজকের পর্যায়ে আসতে পারতো না। কিন্তু শুরুতে এই বিষয়টা ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। কারণ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে একটা সময় নারীদের স্কুল-কলেজে পড়া ছিল সামাজিকভাবেই বাধা। পরিবার থেকেই নারী শিক্ষাকে নিরুৎসাহিক করা হয়েছে বহু বছর। যেসব নারী শিক্ষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অগ্রসরমান ভূমিকা রাখতে পেরেছেন তাদের পরিবার তাদের সাহায্য করেছে। বাকিদের নিয়তি ছিল ঘর-সংসার সামলানোর কাজ করা। স্কুলে ভর্তি হওয়া, যাওয়া এবং ক্লাস করা এই সমর্থন পাওয়া পরিবার থেকে খুব দূরহ ছিল। বেগম রোকেয়ার মতো কিছু মহিয়সী নারী সমাজের এই শৃঙ্খল ভাঙতে চেয়েছিলেন। নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে প্রাণান্ত শ্রম দিয়েছেন। সমাজের কুসংস্কারকে উপেক্ষা করে কঠোর সংগ্রাম করেছেন। সেখান থেকে নারী শিক্ষার এই যাত্রা শুরু হয়ে যুগের পর যুগ পার হয়ে আজকের এই পর্যায়ে এসেছে। যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা ছিল না। এই ধারণা যে আজও একেবারেই নির্মূল হয়েছে তাও বলা যাবে না। তবে শিক্ষার মতো অতি মৌলিক এই ক্ষেত্রে নারীরা এখন প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। সব সরকারই নারী শিক্ষা এগিয়ে নিতে গুরুত্বারোপ করেছে। বিভিন্নভাবে নারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষামুখী করার চেষ্টা করেছে। তাদের সামাজিক যে বাধাগুলো একসময় নারী শিক্ষার প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করতো এখন অনেক ক্ষেত্রেই তা বন্ধ হয়েছে। একসময় নারীর ঘরের বাইরে শিক্ষা গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা ছিল। এখন নারীরাই এগিয়ে। গত কয়েক বছর ধরেই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে পাসের হারে নারীরাই এগিয়ে রয়েছে। নারী শিক্ষকতাসহ কর্পোরেট চাকরির বড় অংশেই যোগ দিয়েছে নারী। প্রাথমিক থেকে শুরু করে শিক্ষার প্রতিটি স্তরেই শিক্ষক হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার চিত্র অনেকটাই সাফল্যের। শিক্ষা অধিদপ্তরের অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার ’১৯৭০-৭১’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সে সময় দেশের মোট শিক্ষার্থীও মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশের কিছু বেশি। গত বছরের তথ্য বলছে, প্রাথমিকের শিক্ষকদের মধ্যে ৬৪ দশমিক ২০ শতাংশই নারী। মাধ্যমিক স্তরে ১৯৯৮ সালের পর থেকে সংখ্যার দিক থেকে এগিয়ে আছে নারীরা। গত বছরই এই স্তরে নারী শিক্ষার্থী ছিল ৫৪ দশমিক ৮৬ শিক্ষার্থী। আর কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ৫০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত বছর গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, দেশের ১৫৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯ শতাংশ নারী শিক্ষক। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্চুরি কমিশন। মঞ্জুরি কমিশনের ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদনে মতে- ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, বাংলাদেশ এগ্রিকালচার বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালে মোট শিক্ষক ছিলেন ২ হাজার ৩১৭ জন। সে সময় নারী শিক্ষক ছিলেন ২০৩ জন অর্থাৎ ৮ শতাংশ। ৫০ বছরে এই হার বেড়েছে ২১ শতাংশ। ইউজিসি এর তথ্য মতে, বর্তমানে পুরুষ শিক্ষকদের চেয়ে ৭০ শতাংশ পিছিয়ে আছেন নারী শিক্ষকগণ। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই নয় প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও নারী শিক্ষক বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষা অর্জনে নারীর অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। গত বছরের বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) এর তথ্য মতে, প্রাথমিক ও প্রাক প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ৫১ শতাংশ। দুই কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৯১ শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী শিক্ষার্থী এক কোটি নয় লাখ ৯১ হাজার ৪৫১ জন। প্রাক-প্রাথমিকে ৫০ দশমিক ৩০ শতাংশ নারী। ৩৯ লাখ ৪৭ হাজার ৮৫২ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৯ লাখ ৮৩ হাজার ৮৯২ জনই নারী। প্রাথমিক,মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে নারী শিক্ষকদের যে হারে এগিয়ে রয়েছে উচ্চ শিক্ষায় সেভাবে এগিয়ে যেতে না পারলেও এই অগ্রগতিই একসময় নারীদের এগিয়ে রাখবে। নারীর কাজের ক্ষেত্র এখন সীমাবদ্ধ নেই। আমাদের দেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় ক্ষেত্র পোশাক শিল্পে একটি বিপুল সংখ্যক নারী কাজ করছে। কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হলে নারীর উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি স্মার্ট উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে নারী শিক্ষায় গুরুত্বারোপ করার বিকল্প নেই। যে প্রতিবন্ধকগুলো এখনো বিদ্যমান রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে। বিশেষ করে বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক অভিশাপ আজও বহু মেধাবী নারীর ভবিষ্যত নষ্ট করছে। তারা পূর্ণ বিকশিত হওয়ার আগেই ধ্বংস হচ্ছে। প্রতি বছর স্কুল কলেজে পড়া বহু মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী আর অর্ধেক তার নর। কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এই কবিতার লাইন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে পৃথিবীর মঙ্গলময় সৃষ্টিতে নারীর রয়েছে সমান অবদান। অথচ আমাদের সমাজ আজও পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পায়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে নারীরা হয়রানির শিকার হয়। একটি সভ্য জাতির কাছে যা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্খিত ঘটনা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কিন্তু অতীত কাল থেকেই নারীরা অবহেলিত। নারীরা যেভাবে শিক্ষায় এগিয়ে চলেছে তাদের সে ধারা অব্যাহত থাক। সমাজে শিক্ষা আলো হয়ে নারী-পুরুষ উভয়কে সঠিক পথে পরিচালিত করুক।

লেখক: কলামিষ্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

অলোক আচার্য মুক্তমত শিক্ষায় নারী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর