Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বীরাঙ্গনার মর্যাদা সুনিশ্চিত করতে হবে

মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা
১২ মার্চ ২০২৩ ১৫:২৭

‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটি অভিধানে ‘বীর সাহসী নারী’ অর্থে ব্যবহৃত। বীর সেনানি হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়া রমনীদের বীরাঙ্গনা বলা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হায়েনাদের যৌন লালসার শিকার ধর্ষিতা মা-বোনদের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রাখতে ও জাতির শ্রেষ্ঠ রমনী হিসেবে আখ্যায়িত করতে স্বাধীনতার মহান স্থপতি শহীদ রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদেরকে ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পাবনা জেলায় সংস্কার করা বাঁধ উদ্বোধন করতে গিয়ে মঞ্চে ওঠার সময় নারী কণ্ঠের আর্তনাদ শুনতে পান। কতিপয় নির্যাতিত নারী তাদের করুণ কাহিনি ও শোচনীয় অবস্থা বর্ণনা করতে আসেন। বঙ্গবন্ধু তাদের সায় দিয়ে বলেন, ‘আচ্ছা মা, বিষয়টি আমি দেখব।’ মঞ্চে উঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতিত মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়, তারা এখন থেকে বীরাঙ্গনা। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান কম নয় বরং কয়েক ধাপ ওপরে। তাই তাদের বীরাঙ্গনা মর্যাদা দিতে হবে এবং সম্মান দেখাতে হবে। আর সেসব পিতা ও স্বামীর উদ্দেশে বলছি যে, আপনারাও ধন্য, কেননা এ ধরনের মহৎ ও ত্যাগী মহিলার স্বামী বা পিতা হয়েছেন। হে বীরাঙ্গনা! তোমরা আমাদের মা।’ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বক্তব্য থেকেই বীরাঙ্গনা উপাধি ভূষিত। বঙ্গবন্ধু অসহায় নারীদের জন্য ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠন করেছেন। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারীদের ব্যাপারটি বিশেষভাবে স্থান দিয়েছেন। নারীদের জন্য ‘উইমেন্স ক্যারিয়ার ট্রেইনিং সেন্টার’ চালু করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সনদপত্রে বীর শব্দের সঙ্গে বীরাঙ্গনা শব্দও যোগ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর এত প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি কারণ বীরাঙ্গনার গল্প অপরকে শোনানোর মতো না। ফলে কেউ বীরাঙ্গনা পরিচয় দিয়ে নিজ অধিকার আদায় করতে চাননি।

বিজ্ঞাপন

আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাতে যাই, তাদের গল্প শুনি কিন্তু কখনও কি বীরাঙ্গনার গল্প শুনতে গিয়েছি? যারা শুনতে গেছেন, নিশ্চয়ই দেখেছেন ‘বীরাঙ্গনা’ তার গল্প শোনাননি বরং নয়-ছয় গল্প বলে নিজ গল্প এড়িয়ে গেছেন। মানুষ দুঃখ-কষ্ট পায় অতঃপর তা অপরের সঙ্গে শেয়ার করে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমার বীরাঙ্গনা মা-বোনদের গল্প এমনই যে, যাহা অপরের নিকট বলার মতো নয়। আহ! কী নিদারুণ গল্প! কী করুণ কাহিনি! আমরা প্রখ্যাত লেখিকা সুরমা জাহিদের ৩৬১ জন বীরাঙ্গনার মর্মস্পর্শী কাহিনি নিয়ে লেখা বই পড়লে দেখি, গাজীপুরের শ্রীপুরে ধর্ষণের ফলে এক বীরাঙ্গনার পায়ুপথ ছিড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার তেমন চিকিৎসা হয়নি। কুমিল্লার ছোট্ট বয়সের এক বীরাঙ্গনাকে তুলে নিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে এত বেশি নির্যাতন করা হয়েছে যে, তার কোমরের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। পরে তার বিয়ে হয়েছে কিন্তু ঘটনা জানার পর সংসার টেকেনি। ঠাকুরগাঁওয়ে এক বীরাঙ্গনার ক্যানসার হয়েছে কিন্তু চিকিৎসার অভাবে তিনিও গত হয়েছেন। খাগড়াছড়িতে এক উপজাতি বীরাঙ্গনাকে মাসের পর মাস নির্যাতন করা হয়েছে। পরে সে বীরাঙ্গনাকে তার পরিবারও গ্রহণ করেনি। দুর্গম পাহাড়ে একা একা বাস করেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।

বীরাঙ্গনাদের অনেকেই আত্মহত্যা করেছেন, অনেকে দেশ ছেড়ে বাইরে গৃহস্থালির কাজে গমন করেন। অসংখ্য বীরাঙ্গনা অপ্রশিক্ষিত ধাত্রী দ্বারা গর্ভপাত করাতে গিয়ে মারা যান। আজকের বাংলাদেশে বীরাঙ্গনার সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে, অনেকে বলেন, বীরাঙ্গনার সংখ্যা তিন লাখ, কেউ বলেছেন দশ লাখ, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তার গবেষণায় বলেন, এ সংখ্যা ছয় লাখের কম নয়। দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রতিবেদনে আসে, এ সংখ্যা চার লাখের কম নয়। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীর সেবাদানকারী অজি ডাক্তার জিওপে ডেভিসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, শুধু অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই দুই লাখ। গর্ভপাত করেছেন প্রায় এক লাখ সত্তর হাজার, বাকিরা আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু আফসোস যে, এই বিশাল সংখ্যার বীরাঙ্গনা থেকে বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে মাত্র চারশ আটত্রিশ জন বীরাঙ্গনাকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। আমরা বিজয়ের কৃতিত্বটুকু বীরাঙ্গনাদের চরণে উৎসর্গ করতে পারিনি। সামাজিক মর্যাদা দিইনি। আমরা অনুভব করতে পারি না যে, জীবন দেওয়া সহজ কিন্তু সম্ভ্রম দেওয়া সহজ নয়।

যুদ্ধ চলাকালে এমনকি স্বাধীনতার পরও আমাদের সমাজব্যবস্থায় বীরাঙ্গনাদের ধর্ষিতার চোখে দেখা হয়। সমাজ তাদেরকে এড়িয়ে চলেছে, পরোক্ষভাবে বয়কট করেছে। চিরাচরিত নিগৃহীত হয়েছে। পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবেও তারা উপেক্ষিত হয়েছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে সম্মান দিয়েছি সেভাবে বীরাঙ্গনাদের সম্মান দিতে পারিনি। একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের অনেকেই অর্থাভাবে মারা গেছেন। বহুলাংশে তাদের মৌলিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি।

যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ পেলাম, উন্মুক্ত আকাশ পেলাম, সেই আকাশ থেকে ফলিত রৌদ্র ও বারি বর্ষায় মাথা গোঁজার ঠাঁই তাদের হলো না। স্বাধীন জমিন পেলেও সে জমিনে তারা স্বাধীন ও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে না। ক্ষুধার জ্বালা, সম্ভ্রম হারানোর বেদনা, বদনাম, বয়কট, দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা একাকার হয়ে তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করেছে। পরিবারে, সংসারে, সমাজে ঠাঁই হয়নি। বিয়ে হয়নি, বিয়ে হলেও সংসার হয়নি, সংসার হলেও শেষরক্ষা হয়নি। একতরফা দোষী ও নির্যাতিত হয়েছে। নারী হয়ে জন্ম নেওয়া এবং বীরাঙ্গনা হওয়া কি তাদের একমাত্র অপরাধ?

যারা বীরাঙ্গনাদের মর্যাদা দিতে কুণ্ঠাবোধ করে এমনকি বীরাঙ্গনাদের থেকে অন্যদের বেশি মর্যাদা দেয়, তারা আসলেই কুলাঙ্গার। বীরাঙ্গনা মানেই বাংলাদেশ। বীর রমণী, যারা স্বাধীন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ অংশ তাদের সম্মান করা ও সম্মান নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। নচেত আমরা বাংলা মায়ের জারজ সন্তান বলেই বিবেচিত হব। আমাদের দেশের সরকার, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংসদসহ সব বেসরকারি সংগঠনকে বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে সক্রিয় হতে হবে। সব বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের সম্মানী, নিরাপত্তা ও পরিবারকে পুনর্বাসন করতে হবে। মৃতদের মরণোত্তর স্বীকৃতি দিতে হবে। তবেই নিজেদের বাংলা মায়ের প্রকৃত সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে পারব। গর্ববোধ হবে। উচ্চকণ্ঠে বলতে পারব, আমরা বীরাঙ্গনা বাংলা মায়ের সন্তান।

লেখক: কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী

সারাবাংলা/এজেডএস

বীরঙ্গনা মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর