পুরস্কারে থালাবাটি ও আমাদের রুচির দুর্ভিক্ষ
২০ মার্চ ২০২৩ ১৮:৪৭
সোজাসুজি একটা কথা বলি, পুরস্কার বিতরণের নামে আমাদেরকে থালা-বাটি আর কাঁচের গ্লাসের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
স্বাধীনতার মাস মার্চ জুড়ে গোটা দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান- ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। এসব আয়োজনে প্রতিযোগীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ শেষে বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা কিংবা বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করার রেওয়াজটা বহুদিনের। সাধারণত এসকল আয়োজনে প্রতিযোগিতার বিষয় আর প্রতিযোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় আয়োজকেরা তুলনামূলক চলনসই বাজেটের মধ্যে ভালো কোনো পুরস্কার নির্ধারণ করার চেষ্টা করে থাকে। তবে লক্ষ্যণীয় মাত্রায় মান্ধাতার আমলের মতো পুরস্কারের তালিকায় আয়োজকেরা বেশিরভাগই থালা-বাটি কিংবা পানি খাওয়ার গ্লাস রেখে দেন।
দেখা যাচ্ছে, একজন বিজয়ী, যে অংশগ্রহণ করেছে দৌড় প্রতিযোগিতায়- তাকে পুরস্কার হিশেবে দেওয়া হচ্ছে বড়ো একটা ম্যালামাইনের প্লেট। আবার কোনো এক কোমলমতি শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায়, সে বিজয় অর্জন করাতে তাকে দেওয়া হচ্ছে কাঁচের গ্লাস কিংবা ঐ ম্যালামাইনের থালা-বাটি। অনুরূপ অন্যান্য বিজয় অর্জনকারীকেও একইধরনের পুরস্কার প্রদান করা হয়।
এমনটা কেন হতে হবে? আমাদের রুচির দুর্ভিক্ষ কি এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে সেই মান্ধাতার আমলের থালা-বাটি সংস্কৃতিতেই বারবার ফিরে যেতে হবে?
ধরুন, কেউ যদি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়, সে থালা-বাটি দিয়ে কী করবে? তাকে চিত্রাঙ্কন সংশ্লিষ্ট পুরস্কার দেওয়া সমীচীন নয় কি? অথবা ধরুন, কেউ রচনা লিখে প্রথম হলো, তাকে বিষয়ভিত্তিক পুরস্কার কিংবা সম্মাননা প্রদান করা যেতে পারে কি-না এটাও তো ভেবে দেখা যেতে পারে! পুরস্কার হিশেবে থালাবাটির বদলে বয়সভেদে বিষয়ভিত্তিক মানসম্মত লেখা সমৃদ্ধ বইও উপহার দেওয়া যেতে পারে। আমার মতে বই হতে পারে পুরস্কারের তালিকায় সবথেকে সেরা কিছু। অথবা সঙ্গে থাকতে পারে ক্রেস্ট কিংবা সম্মাননা সনদ! যে সেক্টরে যে পুরস্কার প্রয়োজন, সেখানে সেটা দিন। সামর্থ না থাকলে পুরস্কারই দিয়েন না। পারলে উৎসাহ দিন, প্রসংশা করুন। তাই বলে গণহারে থালাবাটি-ই দিতে হবে, এটা কেমন কথা! পুরস্কারের তালিকায় থালাবাটি বা খাবার পরিবেশন সামগ্রী থাকবে- এটার পক্ষে আমি নই। এধরনের কাজের আমি তীব্র বিরোধিতা করি, কখনো পুরস্কারের ঘোর সংকট পড়লেও এসব দেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করে যাব।
আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যে সময়ে এসে এধরণের পুরস্কার একদমই বেমানান। কিছুদিন আগে শরীর গঠন সম্পর্কিত (বডি বিল্ডিং) প্রতিযোগিতায় এক বিজয়ীকে ব্লেন্ডার বা জুসার মিক্সার উপহার দেওয়া হয়। বিতর্কিত ঐ প্রতিযোগিতায় পুরস্কার প্রাপ্ত ছেলেটিকে বিক্ষুব্ধ অবস্থায় জুসার মিক্সারটা সজোরে লাথি দিয়ে ফেলে দিতে দেখা গেছে। অন্তর্জাল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে সেই দৃশ্য গোটা বিশ্ব দেখেছে। আচ্ছা চিন্তা করুন তো, পাঁচ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে শরীর গঠন করার পর পুরস্কার হিশেবে ঐ তিন-চার হাজার টাকার জুসার মিক্সার ছেলেটার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো? আয়োজনকারীদের কাছে কি বিষয়টি একবারও দৃষ্টিকটু মনে হয়নি?
এব্যাপারগুলো অনেকের নজরে খুবই সামান্য মনে হতে পারে। আদতে তেমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই। মেধা-পরিশ্রমের স্বাক্ষর রেখে যাওয়া যে ছেলেটি বা মেয়েটি তার প্রতিভা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন থালাবাটি দ্বারা পাচ্ছে সে জানে অপমান কী জিনিস, অবমূল্যায়ন কী জিনিস; তাৎক্ষণিক না বুঝতে পারলেও কালক্রমে একটা সময় ঠিকই সে বুঝতে পারে। কারণ এটাকে পরোক্ষভাবে অপমান-ই বলা চলে। আমি চাইনা আর কোনো পরিশ্রমী-প্রতিভাবানকে এভাবে অবমূল্যায়ন করা হোক।
আমি বলছিনা এমন অরুচিকর চিত্র সবখানে। পুরস্কারে সবাই এমনটা করে থাকে- এমনটিও বলছিনা। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখবেন, গ্রাম থেকে শহরে- এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর বিশাল একটা অংশে এই একই চিত্র- যা একপ্রকারে আমাদের সামগ্রিক রুচির পরিচয়টাকেই বহন করে। অনেকে এগুলো দেখেও, দৃষ্টিকটু জেনেও চুপ করে থাকে। এটা ঠিক নয়। এভাবে ছাড় দেওয়া অনুচিত। আপনার এই এক টুকরো ছাড় একটা সময় অনেক বড়ো আকার ধারণ করবে- তখন চাইলেও এই সংস্কৃতি থেকে সহজে পরিত্রাণ পাবেন না।
কারো কাছে আমার কথাগুলো উচ্চাভিলাষী মনে হতে পারে, আমার লেখাটি অপ্রয়োজনীয়ও মনে হতে পারে। হোক! যাদের মনে হয় হোক- আপাতত তাদেরকে নিয়ে আমি কিছু ভাবছিনা। আমার কথাগুলোকে উচ্চাভিলাষী না ভেবে, আমার লেখাটিকে অপ্রয়োজনীয় না মনে করে বরং ঐধরণের অথর্ব পুরস্কারকে অপ্রয়োজনীয় মনে করুন। ওগুলো আমাদের বিপর্যস্ত রুচির ফলাফল। এধরণের অথর্ব পুরস্কার গ্রহণের বদলে পরিত্যাগ করুন। নিম্নরুচি সম্পন্ন আয়োজকদের মুখের উপরেই এগুলো ছুড়ে ফেলুন। মূল্যায়নটা যথাযথভাবে হোক, এভাবে লোক দেখানো মূল্যায়নের কোনো দরকার নেই। বৃহৎ পরিবর্তনের বদলে পরিবর্তনটা না-হয় ক্ষুদ্র থেকেই শুরু হোক।
লেখক : শিক্ষার্থী ও সমাজকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
পুরস্কারে থালাবাটি ও আমাদের রুচির দুর্ভিক্ষ মুক্তমত শিশির ওয়াহিদ