Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পানির অপচয় বনাম ভবিষ্যৎ পানি সংকট

অলোক আচার্য
২১ মার্চ ২০২৩ ২১:১৬

প্রতিদিন পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর খাদ্যের পাশাপাশি যা আবশ্যকীয় তা হলো পানি। এক-দুবেলা খাদ্য না খেয়েও দিব্বি মানুষ বেঁচে থাকছে কিন্তু পানি ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। প্রাণের উৎস পানি। এক ফোঁটা পানির তৃষ্ণার সময় সব খাবার অপ্রয়োজনীয়। পানি হলো একটি অজৈব,স্বাদহীন, প্রায় বর্ণহীন,গন্ধহীন রাসায়নিক পদার্থ। তবে সেই পানি হতে হবে সুপেয়। কারণ সুপেয় পানির বাইরে যে পানি রয়েছে তা পান অযোগ্য এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকির। পানির অস্তিত্ব খোঁজার জন্য বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বাইরে চাঁদ ও মঙ্গলে অভিযান চালাচ্ছে। কারণ পানির সন্ধান পেলেই সেখানে প্রাণের খোঁজ মেলা সম্ভব। আবার পৃথিবীর পরবর্তী মানুষের বাসস্থান এসব গ্রহ হতে পারে যদি সেখানে পানি পাওয়া যায়।

আমাদের এই ভূমন্ডলের বেশিরভাগ অংশই পানি হলেও খাওয়ার উপযোগী পানির পরিমাণ কম। সেই কম থেকে আরও কমে আসছে। নিরাপদ পানির উৎসস্থল ক্রমেই আশংকাজনকভাবে কমে আসছে। পানির জন্য রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের বিভেদ, উপমহাদেশীয় আন্তঃকলহ। পানির ন্যায্য হিসাব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। পানি নিয়ে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব নিরসন পূর্বক সঠিক বন্টনের ব্যবস্থা করা গুরুত্বপূর্ণ। না হলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। তাই প্রয়োজন পরে পানির সঠিক সংরক্ষণ ও সঠিক ব্যবহার।

সুপেয় পানি কাকে বলে এর সংজ্ঞায় জানা যায়, পনিতে লবণাক্ততার মাত্রা ৫০০ পিপিএম বা এক মিলিয়নের পাঁচশত ভাগের চেয়ে কম থাকে তাকে সুপেয় পানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী গোটা বিশ্বের সিংহভাগ মানুষের নিরাপদ পানি সুযোগ নেই। পানির তীব্র সংকটে যারা রয়েছে এর অধিকাংশই দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। সারা বিশ্বেই এই এক চিত্র। অথচ পানির অপচয় কমাতে পারলে এবং সুষ্ঠু বন্টন করতে পারলে এই দরিদ্র্র শ্রেণির অনেককেই পানি থেকে বঞ্চিত হতে পারে না। আমাদের দেশে বৃষ্টি বা এরকম উৎস থেকে যে পানি আসছে তার অধিকাংশই নষ্ট হচ্ছে। অর্থাৎ তা মাটিতে ফিরে যেতে পারছে না। অধিকাংশ নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে পানির সংকট ঘনিভূত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে সারা বিশ্বে যে পরিমাণ পানি রয়েছে তার মধ্যে মাত্র শূন্য দশমিক ১৪ ভাগ খাবার পানি রয়েছে।

নিরাপদ পানির জন্য বাজারের বোতলজাত পানি কিনে খাওয়া আজ একটি সাধারণ দৃশ্য। সেই বোতলজাত পানিই যে নিরাপদ তার নিশ্চয়তাও বা কিভাবে পাই! কারণ মাঝে মধ্যেই অসাধু ব্যবসায়ীদের বোতলজাত পানির নামে অনিরাপদ পানি ভরে বিক্রি করার খবর পাই। এসব বাদে এটি নিরাপদ এবং পানযোগ্য। কিন্তু কতজনের এই পানি বাজার থেকে কিনে খাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে? আর থাকলেও কতবার?
পানি মানুষের জীবন জীবিকা ও উন্নয়নের সব বিষয়ের অত্যাবশ্যক উপাদান। তাই পানির সঠিক হিসাব হওয়া উচিত। মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হলে পানির ন্যায্য হিসাব একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।

বাংলাদশের জীবন জীবিকা ও সংস্কৃতিতে পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের কষিকাজ, শিল্প কলকারখানা, মৎস চাষ, জলজ সম্পদের আরোহন থেকে শুরু করে আমাদের ঐতিহ্য এর সাথে জড়িত। বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই পানির সংকটের ব্যাপারে সতর্ক করে আসছে। সুপেয় পানির সংকটে চলে আসা দেশের মানুষগুলো এই জীবনধারার সাথে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এর প্রভাব পরছে তাদের জীবনধারায়। আমরা জেনে এসেছি এই ভূভাগের তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। আশ্চর্যের ব্যপার হলো তিনভাগ জল হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ব আজ পানি সংকটের মুখোমুখি। আরও ষ্পষ্ট ভাষায় বললে, পানযোগ্য এবং ব্যবহারযোগ্য পানির তীব্র সংকটের মুখোমুখি এই ধরণী। আমাদের দেশে কেবল রাজধানী ঢাকা শহর নয় বরং প্রধান প্রধান বিভাগীয় শহরগুলোতেও শুকনো মৌসুমে পানির তীব্র সংকট দেখা যায়। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায় এবং নলকূপ দিয়ে পানি ওঠে না। উপকুলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এই সমস্যা আরও তীব্র হচ্ছে। যখন বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ কেবল পানির জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় একত্রিত হবে সেদিনটা হবে ভয়াবহ। কারণ একফোঁটা পানি অন্য সব খাদ্যের চেয়ে বহুগুণে মূল্যবান। পানযোগ্য পানির অপর নামই যে জীবন। মানুষ আজ তেল, গ্যাস বা এরকম প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য যুদ্ধ করছে। এমন একসময় আসতে পারে যখন পানির দখলের জন্য প্রচেষ্টা শুরু হবে। কারণ শুকনো গলায় তো আর যুদ্ধ হয় না। তাই আগে পানি তারপর সবকিছু। যা আমাদের জীবন ও জীবিকার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। সারা বিশ্বের অনেক বড় বড় শহর আজ পানির তীব্র সংকটে ভুগছে। কয়েকটি শহর তো রীতিমত পানিশূন্য হওয়ার আশংকায় ভুগছে।

আমাদের তিলোত্তমা শহর ঢাকা সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে। গরমের সময় এই সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করে। ক্রমেই ঢাকার আশেপাশের নদনদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়াতে এবং তার সাতে পানি সংরক্ষণের কোন সুবিধাজনক উপায় না থাকায় গত কয়েক বছরে পানির স্তর নষ্ট হচ্ছে। কোন সুপেয় পানির অভাব তার পেছনে অপরাপর বেশ কিছু কারণ জড়িত রয়েছে। আমাদের জনসংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বেড়ে চলার সাথে সাথে নদীনালা ভরাট হচ্ছে। নদীনালা খালবিল ভরাট হওয়ার সাথে সাথে নিরাপদ পানির উৎস নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি দ্রুত জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে দ্রুত নগরায়ণ ঘটছে। কৃষিজমি ভরাট হয়ে গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা। এসব শিল্পকারখানার বিষাক্ত পদার্থ নদীতে পরার ফলে দূষিত হচ্ছে পানি। তাছাড়া বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য পানির যোগান দেওয়া কর্তৃপক্ষের জন্য কঠিন হয়ে পরেছে। ভুগর্ভস্থ পানি আমাদের দেশে ব্যপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে। মোট কথা পানির জন্য আমরা মাটির নিচে সঞ্চিত পানি ব্যবহার করছি। অনেক দেশেই বৃষ্টির পানি ধরে তা সারাবছর ব্যবহার করছে তারা। পানির জন্য রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের বিভেদ, উপমহাদেশীয় আন্তঃকলহ। তাই প্রয়োজন পরে পানির সঠিক সংরক্ষণ ও সঠিক ব্যবহার। বলা হয় পানি নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব ও সমস্যার সমাধান সঠিকভাবে না করতে পারলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটা অস্বাভাবিক হবে না। তার কারণও রয়েছে। তেল, গ্যাসের বিকল্প শক্তি আবিষ্কারে মানুষ ক্রমাগতই সাফল্যের মুখ দেখছে। কিন্তু সুপেয় পানির যোগান ক্রমেই কমে আসছে।

ভু-গর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহার এই সংকটকে আরও ঘনিভূত করছে। পানি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে মাঝে মধ্যেই উত্তেজনা তৈরি হয়। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে প্রায় ৭৬ কোটিরও বেশি মানুষ। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ ৯৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭০০ কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকটে পরবে। এখনই বিশ্বে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ পানি পায় না অথবা তাদের কাছে নিরাপদ পানি পৌছায় না। এক গবেষণায় দেখা যায়, সারা বিশ্বে ১১০ কোটি মানুষ প্রতিদিন পান করার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি পায় না এবং প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার শিশু দূষিত পানি পান করে মারা যাচ্ছে। পানি ব্যবহারেও উন্নত বিশ্বের মানুষের সাথে উন্নয়নশীল দেশের মানুষের ব্যবহারে পার্থক্য বিদ্যমান।

ইউনিসেফ এর আগে এক জরিপে বলেছিল, আমাদের দেশের প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ জনগোষ্ঠি সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে। সুপেয় পানির সুযোগ বঞ্চিত জনসংখ্যার দিক থেকে আমাদের দেশের অবস্থান সপ্তম। আমাদের দেশের প্রায় এক হাজার তিনশত নদীর মধ্যে শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ২১২ টি নদীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এছাড়া আরও নদী অস্তিত্ব সংকটে ধুঁকছে। পানির উৎস ঠিক রাখার জন্য অবশ্যই নদী রক্ষা করতে হবে। পানযোগ্য সুপেয় পানির চাহিদা ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই সংকট মোকাবেলায় আামদের বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। এর মধ্যে মিঠা পানির উৎস সৃষ্টি করা, জেলা উপজেলা পর্যায়ে সুপেয় পানির প্ল্যান্ট করা, দেশের সর্বত্র বৃষ্টির পানির সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, শহরের মত গ্রামের মানুষের জন্য পানি ব্যবস্থাপনা করা, দেশের খাল বিল ও জলাভূমিগুলো রক্ষা করতে হবে, পরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ করতে হবে, সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এছাড়াও দেশের বিশেষজ্ঞগণের পরামর্শে পানির সঠিক ব্যবস্থাপনার উদ্যেগ নিতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

অলোক আচার্য পানির অপচয় বনাম ভবিষ্যৎ পানি সংকট বিশ্ব পানি দিবস


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর