শিশুদের হাতে মোবাইল নয় বই তুলে দিন
২৫ মার্চ ২০২৩ ১৫:২৮
বই পড়া নিয়ে ওমর খৈয়াম বলেছিলেন, রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে প্রিয়ার কালো চোখ দুটি ঘোলাটে হয়ে আসবে কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়। বই নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, “পৃথিবীর আর সব সভ্যজাত যতই চোখের সংখ্যা বাড়তে ব্যস্ত, আমরা ততই আরব্য উপন্যাসের এক চোখা দৈত্যের মতো ঘোঁত ঘোঁত করি, আর চোখ বাড়াবার কথা তুলতেই চোখ রাঙাই। চোখ বাড়াবার পন্থাটা কি ? প্রথমত বই, বই পড়া এবং তার জন্য দরকার বই পড়ার প্রবৃত্তি”। বিল গেটস বলেছেন, খুব কম বয়সে বই পড়ার প্রতি আমার ঝোঁক তৈরি হয়। শিশু হিসেবে আমার বাবা- মাও বই কিনতে আমাকে ইচ্ছামতোই টাকা দিতেন। তাই আমি প্রচুর পড়তাম।
আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে এই মুহুর্তে সবচেয়ে দামী উপহার কি হতে পারে ? আমি প্রথম উত্তরে বই দ্বিতীয় এবং তৃতীয় উত্তরে ও বলব বই। বইয়ের চেয়ে পৃথিবীতে দামী উপহার আর কিছুই হতে পারে না।
একটু শৈশবে ফিরে যায়, ইশকুল ছুটির পর বই সংগ্রহ করতে যেতাম পটিয়া উপজেলা পরিষদের সমাজ সেবা অধিদপ্তরের পাশে ছোট একটা কক্ষে ছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। সপ্তাহ শেষে বই পড়া শেষ হলে বই ফেরত দিয়ে আরেকটা বই নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। সে সময়টা ছিল সোনালী দিন। আনন্দের সাথে বই পড়া প্রতিযোগিত হতো বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে। মাঝে মাঝে বই পড়া নিয়ে আলোচনা, আড্ডা, প্রতিযোগিতার আসর বসত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। স্মৃতির ঝাঁপিতে আজও গেঁথে আছে বই বিনিময়, প্রিয়জনকে বই উপহার দেয়া এবং বইয়ের ভিতরে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী বাক্যটি লিখে প্রেম নিবেদন করা। কালের বিবর্তনে সব হারিয়ে গেছে। আবেগমাখা চিঠির জায়গা দখল করে নিয়েছে মুঠোফোনের ক্ষুদে বার্তা।
বিজ্ঞান কেড়ে নিয়েছে আবেগ, বড়ো দুঃসময় চলছে। সেটার জন্য দায়ী পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমান সময়ে শিশু এবং ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে জ্ঞান কেড়ে নিয়েছি। বছরের শুরুটা হয় নতুন বই দিয়ে কিন্তু দুঃখের বিষয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বার্ষিক ক্রিড়া-প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানটা শেষ হয়, ঘটি-বাটি থালা-বাসন আর বদনা উপহার দিয়ে।
আজকাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় শিক্ষকরা বই পুরস্কার দিতে অনিহা। বিশেষ করে শিশুদেরকে ছোটবেলা থেকে বই পড়ার অভ্যাস তৈরী করতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দারুন ভূমিকা রাখতে পারে। বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় মজার মজার শিশুতোষ বই পুরস্কার দিতে পারেন এবং বিদ্যালয়ে শিশুতোষ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। বাসা বাড়িতেও পিতামাতাদের লক্ষ্যে রাখতে হবে শিশুদেরকে বইয়ের প্রতি ঝোঁক বাড়াতে ছোটবেলা থেকে বই প্রেমী করে তুলতে হবে। এ জন্য আপনি আপনার শিশুকে বই মেলায় কিংবা মাসে অন্তত একবার হলেও পাঠাগারে নিয়ে যাবেন শিশুদের পছন্দমতো ভালো মানের বই কিনে দিবেন।
খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি, এবং শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ক্রিড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার পছন্দ করেন, প্লেট, ঘটি-বাটি, বদনা, মগ, ক্রেস্ট। অভিভাবকরাও আজকাল তাঁদের সন্তানদের সাফল্যে অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য দামী শপিং মলে গিয়ে ব্রান্ডের কাপড়- চোপড় কিংবা খেলার-সামগ্রী উপহার কিংবা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গিয়ে ট্রিট দেন। একবার ভেবে দেখেছেন এই উপহার সামগ্রীগুলো শিক্ষার্থীদের ক্ষনিক আনন্দ দিবে কিন্তু কাজে আসবে না। আপনাদের দেয়া লোক দেখানো উপহার সু-পিচগুলো কিছুদিন ঘরে সজ্জিত করে রাখে। একসময় ভাঙ্গারী হিসেবে বিক্রি করে দে না হয় ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। শুধু তাই নয় অভিভাবক এবং শিক্ষকদের খেলাধুলা কিংবা বাৎসরিক পিকনিক/চড়ুইভাতি হলেও সেখানেও থালা বাসন টিফিন বাক্স, টাওয়াল না হয় ঘরককন্নার শোপিচ। এসব অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা জরুরী। ঘটি-বাটির বদলে যদি বই দেয়া হয়। বই কিন্তু অনন্ত যৌবনা হিসেবে থেকে যায় বুক সেলফে। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ছোট বইটি বাতিঘর হিসেবে আলো দিয়ে যায়।
বিজ্ঞানের আশীর্বাদ যেমন আছে, তেমনি অভিশাপও আছে। বই-র বদলে যন্ত্র তুলে দিয়েছি শিশুদের হাতে। দিয়াশলাইয়ের বাক্সের মতো ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে হাতে মুঠো ফোন, ট্যাব, কম্পিউটার। বর্তমান প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেম ফেসবুক জ্বরে ভুগছে। এ যেন এক মানসিক ব্যাধীতে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক এবং মুঠোফোন আসক্তি মাদকাসক্তির চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারন করছে। কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের উপর দারুণভাবে ন্যাতীবাচক প্রভাব পড়ছে। তরুণ সমাজ পর্ণোগ্রাফিতে আসক্তি হয়ে পড়ছে। ১৮ বছরের আগে শিশুদের হাতে স্মার্টফোন দেয়া যাবে না। এ জন্য চায় সচেতনাতা পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে।
আনন্দের সাথে ছাত্র-ছাত্রীদের বই পড়ায় মনোযোগী করতে হবে। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিশুদের কে ছবি আঁকা, বই পাঠ, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে মনোযোগী করতে হবে। ওরা কি চাই কোন বিষয়ে আনন্দ পাচ্ছে সেটা নির্বাচন করেন। বই উপহারের কোন বিকল্প নেই। বাসায় যদি পিতামাতারা এবং ইশকুলে শিক্ষকর বই পড়ার সু অভ্যাস করেন, ছাত্র-ছাত্রীরা যন্ত্র বাদ দিয়ে বই প্রেমী হয়ে উঠছে।
এ প্লাস , গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখার জন্য অস্থির না করে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়া তোলার পরিকল্পনা করুন। জোড় করে কোন বিষয় চাপিয়ে দিবেন না। যদি দেন সেটা হবে বদহজম । পাঠ্য বই পড়ার পাশাপাশি গল্পের বই, ছবি আঁকা, মজার মজার ছবি উপভোগ, খেলাধোলা করার সুযোগ দিতে হবে। বাসায় কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বই পড়া প্রতিযোগিতার করা যেতে পারে। এবং প্রতিযোগিতার পুরস্কার হবে বই।
কবি রবি ঠাকুর বলেছিলেন, “মানুষ বই দিয়ে অতীত ভবিষ্যৎ এর মাঝে সাঁকো বেধে দিয়েছে”। বই পড়া, বই প্রেমী করে তোলার অভ্যাস ইশকুল বেলা থেকে গড়ে তুলতে হবে। তাই আসুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার নির্বাচন করতে হবে বই। বর্তমান প্রজন্মকে আগামীদিনের কান্ডারী করে গড়ে তোলতে হলে বই প্রেমী করে তুলতে হবে। বই হলো মনের বড় দাওয়াই, তাই আসুন আর নয় থালা ঘটি-বাটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগামীর উপহার হোক বই এবং বই।
লেখক: লেখক ও প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এজেডএস