Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা এতো গড়িমসি কেন?

জাফর হোসেন জাকির
২৯ মার্চ ২০২৩ ১৮:০৫

পানির অপর নাম জীবন। পানি এবং জীবন একই বৃন্তের দুটি ফুল। জীবের সৃষ্টি যেমন পানি ছাড়া কল্পনাতীত, তেমনি পানি ছাড়া বেঁচে থাকাও রূপকথার গল্পের মতো। আর এই পানি যদি উজান অঞ্চলে অন্যের হাতে বন্দী হয়ে থাকে তাহলে ভাটি অঞ্চলের মানুষের কি দূর্দশা হতে পারে তা একজন সাধারণ মানুষও অনুধাবন করতে পারেন, সমাধানের পথ খোঁজেন। যারা পানির প্রবাহের ওপর নির্ভর করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন তারা প্রত্যক্ষভাবে বুঝতে পারেন নদীতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহতার প্রয়োজনীতা। তিস্তা নদীর মাঝে বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে এমনটাই দীর্ঘদিন ধরে চলেছে বাংলাদেশের মানুষের ওপর।

বিজ্ঞাপন

নদীটির বাংলা নাম তিস্তা এসেছে ‘ত্রি-সে্রাতা’ বা ‘তিন প্রবাহ’ থেকে। সিকিম হিমালয়ের ৭,২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে এই নদীটি সৃষ্টি হয়েছে। এটি দার্জিলিং -এ অবস্থিত শিভক গোলা নামে পরিচিত একটি গিরিসঙ্কটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দার্জিলিং পাহাড়ে তিস্তা একটি বন্য নদী এবং এর উপত্যকা ঘনবনে আচ্ছাদিত। পার্বত্য এলাকা থেকে প্রথমে প্রবাহটি দার্জিলিং সমভূমিতে নেমে আসে পরে পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) দুয়ার সমভূমিতে প্রবেশ করে এবং বাংলাদেশের নীলফামারী জেলা ডিমলা উপজেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে পতিত হয়। ফলে তিস্তা নদী আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে রূপ নেয়। কারণ একটি নদী যখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রবাহিত হয় তখন তাকে আন্তর্জাতিক নদী বলে। আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন নিয়ে রীতিনীতি থাকার পরেও দীর্ঘদিন যাবত তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে এতো টালবাহানা কেন? ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারে আলোচনা হয় যে, তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত, ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ আর ২৫ ভাগ পানি থাকবে তিস্তার নিজের জন্য। তিস্তা নিজে না বাঁচলে তার অববাহিকার জীববৈচিত্র্য বাঁচবে কীভাবে? এরপর ২০০৭ সালে স্থির করা হয় ৪০ শতাংশ ভারত, ৪০ শতাংশ বাংলাদেশ এবং ২০ শতাংশ রাখা হবে নদীর জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু চুক্তি না হওয়ায় গজলডোবা থেকে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি আসার পরিমাণ শূন্য। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফরের মাধ্যমে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সেই চুক্তি সময়কাল ধরা হয়েছিল ১৫ বছর। এ চুক্তি অনুসারে তিস্তা নদীর পানির ৪২.৫ শতাংশ ভারত এবং ৩৭.৫ শতাংশ বাংলাদেশ পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু গতানুগতিকভাবে ফলাফল শূন্য। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করলে মানুষের ভেতরে আশা তৈরি হয় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে। কিন্তু গণমানুষের আশা নিরাশায় রূপ নেয়। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকা সফরে আসেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী । এ সময়ে তিস্তার চুক্তির ব্যাপারে ইতিবাচক বক্তব্য রাখলেও সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ফলাফল যা তা-ই। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে ৫৪টি ভারত বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের কারিগরি কমিটি ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে দুই দিন বৈঠকটি ভার্চুয়ালি সম্পন্ন করেন। কিন্তু রেজাল্ট কি তা কারো-ই অজানা নয়।

বিজ্ঞাপন

তিস্তার উজানে ভারত ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সীমান্তের ৬০ কিলোমিটার উজানে ৫৪টি ফটক বিশিষ্ট গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় অংশে সেচের সম্প্রসারণ ঘটানো। এই বাঁধ দিয়ে প্রথম পর্যায়েই প্রায় ১০ লাখ হেক্টর, অর্থাৎ ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় সেচ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে ২১০ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল করেছে তারা। এসব খাল একদিকে পশ্চিম-দক্ষিণে অগ্রসর পশ্চিমবঙ্গের মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ জেলা পর্যন্ত পৌঁছেছে, অন্যদিকে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলা পর্যন্ত গেছে। অর্থাৎ গজলডোবা বাঁধ একটি বিস্তৃত পরিধিতে সেচ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নির্মিত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এর ফটক বন্ধ থাকে বলে বাংলাদেশ পানি পায় না। এখন যে নতুন দুটি খাল খনন করা হচ্ছে, তা এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের বাস্তবায়নের অংশ। ভারত ভাটির দেশের কথা কোনোভাবেই বিবেচনায় না নিয়ে নতুন নতুন খাল খননের মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানি অপসারণের ক্ষমতা বাড়িয়েই চলেছে। আর বাংলাদেশ অঞ্চলে তিস্তা হারাচ্ছে তার বেঁচে থাকার মতো পানি। পশ্চিমবঙ্গ সেচ বিভাগের এক সূত্রের বরাত দিয়ে টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়, তিস্তা এবং জলঢাকার পানি টানার জন্য কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খাল খনন করা হবে। আরেকটি খালের দৈর্ঘ্য হবে ১৫ কিলোমিটার। এটি তিস্তার বাম পাশের তীরবর্তী এলাকায় খনন করা হবে। এই খালটি খনন করা হলে প্রায় এক লাখ কৃষক সেচসুবিধার আওতায় আসবেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ পদক্ষেপের আওতায় জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার এলাকার আরও অনেক কৃষিজমি সেচের আওতায় আসবে। সাধারণভাবেই বলা যায় যে, তিস্তার পানি বাংলাদেশে না এসে চলে যাবে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার এলাকায়। তাহলে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ পানি পাবে কীভাবে? তবে কি তিস্তা নদী একেবারে শুকিয়ে মরবে? নতুন খাল খননের যড়যন্ত্র নদী মারার যড়যন্ত্র নয় কি? তিস্তার পাড়ের যেসব মানুষ নদীর ওপর বিভিন্নভাবে নির্ভর, তিস্তায় সতেজতা না থাকলে সেসব মানুষের জীবন সতেজ থাকবে কেমন করে?

তিস্তা সিকিমের বৃহত্তম নদী, পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। এর ১১০ কিলোমিটার বাংলাদেশে অবস্থিত হলেও ১২৫০০ বর্গকিলোমিটার অববাহিকার জনবসতি ও কৃষি অধ্যুষিত বৃহত্তম অঞ্চলটাই বাংলাদেশে। ভারতের একতরফা পানি নেয়ার কারণে শুধু তিস্তা নয়, বাংলাদেশের খাদ্যভাণ্ডার বলে পরিচিত উত্তরবঙ্গ বিশেষত রংপুর অঞ্চল কি শুকিয়ে মরবে? বর্ষা মৌসুমে তিস্তা নদীর উজানে সমস্ত বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে জলে ডুবিয়ে মারা এবং শুষ্ক মৌসুমে ফটক বন্ধ করে নদীতে স্বাভাবিক পানি প্রবাহে বাঁধা দিয়ে তৃপ্তি না পেয়ে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারে নতুন করে খাল খননের মধ্য দিয়ে পানি প্রত্যাহারের যড়যন্ত্র কি বাংলার মানুষ দর্শকের কাতারে থেকে চুপ হয়ে বসে থাকবে? দেশ স্বাধীনের বায়ান্ন বছর পার করেও যেখানে কোনো সরকার তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে সমাধান আনতে সক্ষম নয় সেখানে কি সচেতন নাগরিক, দেশপ্রেমিক ও প্রতিবাদী মানুষ চুপ থাকতে পারে? নদীর রক্ষার আন্দোলন কি শুধু বাম রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর একার?

সারাবাংলা/এজেডএস

জাফর হোসেন জাকির তিস্তার পানি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর