Thursday 28 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বাধীনতার ৫১ বছর পর স্বীকৃতি পেলেন শহিদ ছবুর

রশীদ এনাম
৩১ মার্চ ২০২৩ ১৭:০৩

ছেলেবেলায় মায়ের মুখে প্রথম শুনেছিলাম মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা। সেই সময় নানাবাড়িতে আগুন দিয়েছিল পাকস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের তাদের এ দেশীয় দোসরা। চারদিকে আগুন, গোলাগুলি আর বোমাবজি। চিৎকার আর আহাজারির শব্দ। বাতাসে লাশের গন্ধ। মায়ের বয়স আর কত চার-পাঁচ। মাকে পাখির ডানার মতো শাড়ির আঁচলে আগলে রাখতেন নানুমণি।

একাত্তরের সেই গল্প শুনে ভয়ে শিউরে উঠতাম। চোখে দেখিনি ’৭১। মুক্তিযুদ্ধের নাটক, ছবি আর ইতিহাস পড়ে উপলব্ধি করতাম, যুদ্ধের স্মৃতিকথা শুনে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। মুক্তিযোদ্ধা সেজে ভাবতাম অনেক শত্রু সেনাদের খতম করব। দেশ স্বাধীন করব, স্বপ্ন ডানায় চড়ে, লাল সবুজের বিজয় নিশান কপালে বেঁধে সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করে আনন্দ মিছিল করব। বিজয় মিছিলের স্লোগান হবে, জয় বাংলা! জয় বাংলা!

বিজ্ঞাপন

আহারে, শিকড়ের কাছে শোনা সেই গল্প, মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রজন্ম হয়ে হৃদয় গহিনে ধারণ করে স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ানো। যুদ্ধদিনের গল্প স্মৃতির ঝাঁপিতে রাখার চেষ্টা করেছি মাত্র। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই নক্ষত্র মাটি। যে মাটিতে সবাই হেসে-খেলে ঘুরে বেড়াই, জোছনা ভরা রাতে জোছনা উপভোগ করে, বৃষ্টির দিনে বৃষ্টিতে ভিজে। জাঁকিয়ে যখন শীত নামে কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে প্রভাতফেরিতে যায় এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ। আনন্দ-সুখ-দুঃখ একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে, শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা যেন সোনার বাংলাদেশ। এত সুন্দর আমার দেশের মাটি বিশ্বে আর কোথাও আছে কী না সন্দেহ। রাজনীতির কবি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হৃদয় স্পর্শী ভাষণ শুনে সমগ্র দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন হাতে মুঠোয় নিয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

সেই মা-মাটির টানে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, খুব কাছের প্রতিবেশী শহিদ গাজী আবদুস ছবুর। যিনি যুদ্ধ শেষে মায়ের কাছে ফিরেননি। ১২টি বছর প্রতীক্ষায় ছিলেন শহিদ ছবুরের মা ছমেরাজ খাতুন। শেষ নিঃশ্বাসটি চলে যাওয়ার সময়ও ছেলেকে খুঁজে বেরিয়েছেন তিনি। ছেলেও চিরতরে চলে যাওয়ার সময় মাকে দেখার জন্য আর্তনাদ করেছিলেন। শহিদ ছবুর তার সহযোদ্ধদের বলেছিলেন, ‘খবরদার অস্ত্র ফেলো না হাত থেকে। আমি মরে গেলেও দেশ স্বাধীন হবে।’

হ্যাঁ, দেশ স্বাধীন হয়েছে। ৫১টি বছর বৃক্ষের পাতার মতো ঝরে গেল। কী পেয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা? আজও অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ভাতা থেকে বঞ্চিত। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে আজও মানুষের হাতে লাঞ্চিত হতে হয়। চিকিৎসার অভাবে না ফেরার দেশে চলে যেতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। আমরা কী দিতে পেরেছি তাদের সম্মান কিংবা মর্যাদা ? আহা মুক্তিযোদ্ধা! তারাই তো সোনার বাংলার সোনার মানুষ। ছবুর মারা যাওয়ার পর তার স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত মুছে ফেলতে চেয়েছে একটি পক্ষ। তার কবর পাহাড়ে রয়ে গেছে। সঙ্গীসাথি কিংবা পাড়া প্রতিবেশীরা কেউ বলেননি, তার কবর তার গ্রামে মায়ের কবরের পাশে নিয়ে আসার জন্য। তার গ্রামেও হয়নি কোনো শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ। পটিয়া শহরের অনেকে আজও জানেন না শহিদ ছবুর কে? দেশে আজও রয়ে গেছে সেই শকুনের প্রজন্ম। যারা পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করে কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছিল। বিচারের বাণী বহুদিন নিভৃতে কেঁদে ফিরেছে। বহু চড়াই-উতরাইয়ের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশ আজ কলঙ্কমুক্ত হতে চলেছে। অন্ধকারের অবসান হয়ে, আলোকিত হতে চলেছে দেশ।

৩০ লাখ শহিদের একজন শহিদ গাজী আবদুস ছবুর। গাজী আবদুস ছবুর ১৯৫১ সালে ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া পৌরসভা ৪নং ওয়ার্ডের শেয়ান পাড়ার গাজী বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মৃত গাজী আলী চাঁন সওদাগর পেশায় একজন লবণ ব্যবসায়ী এবং মাতা মৃত ছমেরাজ খাতুন। ১৯৭১ সালে ২ অক্টোবর পটিয়া কেলিশহরে রাজাকার অপারেশনে গিয়ে সহযোদ্ধা পটিয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সামশুদ্দিন আহম্মেদের সেম সাইডে শহিদ ছবুর শাহাদাৎবরণ করেন।

পটিয়া কেলিশহরের ভট্টাচার্য হাট এলাকার গুরটিলা পাহাড়ের পাদদেশে বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় তাকে দাফন করা হয়েছিল। কেলিশহরের খিল্লা পাড়ার টিলা পাহাড়ের কবরস্তানে। ১৯৯৮ সালের দিকে চট্টগ্রাম মঞ্চ পত্রিকায় পটিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতাম। একদিন মুক্তিযোদ্ধা কালাম চাচা আমাকে শহিদ ছবুরের কবর দেখাতে নিয়ে গেলেন। সেদিন কালাম চাচার মুখে শুনেছিলাম শহিদ ছবুরের গল্প। সে সময় থেকে আমার খুব কৌতূহল ছিল, মুক্তিযোদ্ধা-শহিদদের সম্পর্কে জানার। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গল্প শোনার। ছাত্রজীবনে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে চট্টগ্রাম জেলার প্রথম আলো বন্ধুসভার উদ্যোগে এবং পটিয়া বন্ধুসভার উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার আয়োজন করেছি বহুবার।

প্রায় ১৬ বছর ধরে শহিদ ছবুরের অজানা গল্প কুড়োনোর চেষ্টা করেছি মাত্র। গত ২০১৫ সালে দৈনিক আজাদীর খোলা হাওয়া বিভাগে “যুদ্ধশেষে যে দামাল ছেলেটি বাড়ি ফিরেনি” নামে একটি ফিচার ছাপা হয়। ফিচারটি পড়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী মাহাবুবুর রহমান আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন । তিনি বলেন, “রশীদ এনাম আমি চাই তুমি একটা বই করো শহিদ ছবুরকে নিয়ে”। বহু চড়াই উতড়াই পান্ডুলিপি প্রস্তুত প্রয়াত শহিদ জায়া মুশতারী শফি আন্টি পান্ডুলিপি পড়ে মুগ্ধ হন। তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে বইয়ের ভূমিকা লিখে দেন। অতঃপর ২০১৬ সালে বলাকা প্রকাশন থেকে ভূমিষ্ঠ হলো আমার সন্তানতুল্য প্রথম প্রকাশিত বই “একাত্তরের শহিদ ছবুর”। সে বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী প্রফেসর সাবিহ্ উল আলম ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত শিশুসাহিত্যিক সুজন বড়ুয়া ও কবি রহীম শাহ বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে বইয়েল মোড়ক উন্মোচন করল। মেলায় বইটি পাঠক নন্দিত হলো। বিশেষ করে আমার প্রাণের পটিয়বাসী একটি বিস্মৃত অধ্যায় সম্পর্কে জানল।

পটিয়ার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শহিদ ছবুর রোড সবাই চিনত। কিন্তু শহিদ ছবুরকে কেউ চিনত না। নতুন প্রজন্মরা কিশোর “শহিদ ছবুর” সম্পর্কে জানল। সে সময় আমার সুহৃৎ আরিফের পরামর্শে কজন বন্ধু মিলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাত্তরের শহিদ ছবুর ফেসবুক গ্রুপ খুলি। গ্রুপটিতে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য আমরা কাজ করতাম। এই কাজে আমাকে ভালোবাসার হাতবাড়িয়ে দিয়েছিলেন পটিয়া কনফিডেন্স পরিবারের কাজী সোহেল ও তার ছাত্র-ছাত্রীরা।

লেখালিখি হওয়ার পর শহিদ ছবুরের নামে পটিয়া কেলিশহরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। ইশকুলটি প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন- প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট হরিসাধন দাদা।

একাত্তরের গল্পশুনি অনুষ্ঠানে শহিদ ছবুরের বন্ধু দক্ষিনজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী মাহাবুব ও চন্দনাইশের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জাফর আলী হিরুকে সম্মাননা প্রদান করি।

একাত্তরের শহিদ ছবুর গ্রুপের পক্ষ থেকে দাবি দাওয়া করার পর শহিদ ছবুর স্মৃতিবিজড়িত রাহাত আলী ইশকুল মাঠে শহিদ মিনার স্থাপন করা হয়। আমার নিজস্ব পরিকল্পনায় পটিয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের শেয়ান পাড়া পশ্চিম পটিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে “শহিদ ছবুরের” নামে পটিয়ায় প্রথম শিশুতোষ পাঠাগার স্থাপন করা হয়। পাঠাগারটি উদ্ধোধক ছিলেন দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী ও চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর সবিহ্ উল আলম। লেখালিখি করে আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো অর্জন শহিদ ছবুরের পরিবারের পাশে থাকা এবং ধৈর্যের ফল নাকি বড়ো মিষ্টি হয়।

২০২১ সালের ২ অক্টোবর চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর চৌধুরীর পরামর্শ দেন পরিবারের পক্ষ থেকে ভাতার জন্য আবেদন করা হয়। ওনার পরামর্শে ২৭ অক্টোবর, ২০২১ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী মহোদয় বরাবর আবেদন করি এবং তার হাতে একাত্তরের শহীদ ছবুর বই ও আবেদন পত্র তুলে দিই। মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক হেসে বলেন “এতোদিন পর কেন এতোটা বছর ঘুমিয়ে ছিলেন কেন? একটা বই হয়েছে এর চেয়ে বড়ো প্রামাণ্য দলিল আর কী? সাথে সাথে তিনি জোর সুপারিশ করে জামুকা(জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) পাঠিয়ে দেন। আলহামদুল্লিাহ অনেক চড়াই উতড়ায়ের করে দীর্ঘ ৫১ বছর পর ২০২২ সালের ৯ মে শহীদ ছবুরের নাম গেজেট ভুক্ত হয় এবং একই বছরের ২৭ অক্টোবর শহিদ ছবুরের বোন জাহেদা আপা, জরিনা আপা এবং সহোদর গাজী সেলিম ভাইয়ের হাতে শহিদ ভাতার বই এবং রেশন কার্ড তুলে দেয়া হয়। ভাতা কার্ড এবং রেশন কার্ড পেয়ে শহিদের ভাইবোন আমার বাসায় এসে আবেগ আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তারা কিছুতে ভুলতে পারছে না ৭১-র শহীদ ছবুরকে। শহিদ পরিবারে সবাই আনন্দে আত্মহারা ৫১ বছর পর তাদের পরিবার শহিদ মর্যাদা পাওয়ায় সবাই খুশি। ভাইবোনসহ পুরো পটিয়াবাসী কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায় সিক্ত করে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এসবের নেপথ্য-র পেছনে ছিল আমার রচনা “একাত্তরের শহিদ ছবুর” বইটি।

শহিদ ছবুরের কবরটি পটিয়া কেলিশহরের পাহাড়ের পাদদেশে অরক্ষিত ও অবহেলিত অবস্থায় ছিল পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতিকুল মামুনকে আমি লিখিতভাবে আবেদন করি। তিনি গত ২৫ অক্টোবর, ২০২২ শহিদ ছবুরের কবরটি পাকা করে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন।

ধামাচাপা পড়ে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া মু্িক্তযোদ্ধাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে লেখা গল্পের ঝাঁপি মেলে দিলাম নতুন প্রজন্মের কাছে। জানি না শহিদ ছবুরের আত্মা শান্তি পাচ্ছে কি না। এ অর্জন আমার নয় প্রিয় পাঠক এবং আঁরার পটিয়বাসীর।

প্রিয় পাঠক! শুধু এটুকু বলব, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কেউ অসম্মান করবেন না। যারা যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন কিংবা না ফেরার দেশে চলে গেছেন তাঁদের পরিবারের প্রতি ভালোবাসার হাত প্রসারিত করে দিবেন। আমার প্রত্যাশা শহিদ ছবুরের কবরটি শেয়ান পাড়া গ্রামে কেলিশহর থেকে নিয়ে আসা হোক এবং তাঁর গ্রামে “একাত্তরের চেতনা ও শহিদ ছবুর স্মৃতিস্তম্ভ” নির্মাণ করার জন্য মাননীয় প্রধান মন্ত্রী মহোদয় ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করছি। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠবাঙালি বঙ্গবন্ধুর তনয়া মানবতার মা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় ও মু্িক্তযোদ্ধা মন্ত্রী এবং শহিদ ছবুর পরিবারের প্রতি যারা ভালোবাসা হাত বাড়িয়েছেন। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই একাত্তরের শহিদ ছবুর সহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাংলা ভাষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ সকলকে।

লেখক: সদস্য বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী

সারাবাংলা/এজেডএস

৫১ বছর পর স্বীকৃতি শহিদ ছবুর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর