সড়কে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক
১ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:৪২
বর্তমানে পত্রিকা কিংবা টিভিতে খবর দেখতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করি না। কারণ পত্রিকা খুললেই কয়েক জায়গার দূর্ঘটনার খবর সামনে আসে। কয়েকদিন আগে পদ্মা সেতু এক্সপ্রেস ওয়ে থেকে বাস খাদে পড়ে ১৯ জন নিহত হয়েছে। এর আগে গতবছর অসুস্থ মাকে দেখতে স্ত্রী-সন্তানসহ প্রাইভেটকারে করে বাড়ি যাচ্ছিলেন রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. বাসুদেব সাহা। কিন্তু পথে দূর্ঘটনার শিকার হয়ে তিনি, তার স্ত্রী এবং তার ছেলে নিহত হন। ওনার মেয়ে না আসায় তিনি বেঁচে যান। এই দূর্ঘটনা যে একটা পরিবার ধ্বংস করে দিয়েছে তা নয় । এই এক দূর্ঘটনায় তিন দম্পতির প্রাণ গেছে। চারটি পরিবার নষ্ট হয়ে গেছে। আর এটা তো শুধু একদিনের নির্দিষ্ট একটি জায়গার ঘটনা। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় দূর্ঘটনা ঘটছে এবং প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। সবসময় কেমন যেনো একটা আতঙ্ক কাজ করছে সবধরনের মানুষের মনে। কারণ সড়ক দুর্ঘটনা যেভাবে মহামারী আকার ধারণ করেছে তাতে কেউ নিরাপদ নয়।
এবছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সহ গত কয়েক বছরের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দেখে যে কেউ আঁতকে উঠবে। আমি কৌতুহল বশত রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এবং যাত্রী কল্যাণ সমিতির কয়েকটা রিপোর্ট দেখলাম। গত কয়েকবছরে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ আশংকাজনক ভাবে বেড়ে গেছে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে মোটর সাইকেল দূর্ঘটনায় মারা গেছেন ৮৩০ জন মানুষ। যা ২০১৯ সালে ছিলো ৯৪৫ জন, ২০২০ সালে ১৪৬৩ জন এবং ২০২১ সালে ২২১৪ জন।
রমজান মাস শুরু হতে যাচ্ছে, সামনেই ঈদ।ঈদের সময় দূর্ঘটনা অনেক বেড়ে যায়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত ঈদে বাড়ি যাওয়া এবং কর্মস্থলে ফেরার সময় ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জন নিহত হয়েছেন। যেটা মোট নিহত মানুষের ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ঈদে বাড়ি যাওয়া এবং কর্মস্থলে ফেরার পথে ২৫ এপ্রিল থেকে ৭ মে পর্যন্ত ১৪ দিনে ২৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৭৬ জন মানুষ। আহত হয়েছেন অন্তত দেড় হাজারের বেশি। সংবাদমাধ্যম এবং এসব সংস্থার গবেষণায় দেখলাম আগের বছরের ঈদুল ফিতরের চেয়ে এ বছরের ঈদুল ফিতর উদ্যাপনকালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ১৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেস ওয়ে থেকে যে বাসটি দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে পরবর্তীতে জানা যায় ওই গাড়ির ফিটনেস ছিলো না। দূর্ঘটনার পরেই কেনো এগুলো ধরা পড়ে। আর তখন ধরা পড়ে লাভ কি?
দেশের চলমান গণপরিবহনের একটা বড় অংশই ফিটনেস বিহীন, রাস্তায় চলাচলের অযোগ্য। বারবার এটা নিয়ে কথা বলা হয়েও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ এবিষয়ে কেনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না এটা খতিয়ে দেখা দরকার। বাংলাদেশ সড়ক ও পরিবহন কতৃপক্ষ বিআরটিএ এর তথ্য মতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল এর সংখ্যা ১৫ লাখ এর কম ছিলো যা বর্তমানে ৩৬ লাখ এর বেশি।
আর অনিবন্ধিত সংখ্যা তো অগণিত। গতকয়েক বছরে সড়কে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনার হার এবং নিহতের সংখ্যা দুটোই আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং সম্পর্কিত সকল বিভাগকে বসে এবিষয়ে একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে হবে। তা নাহলে হাজারো মায়ের কোল খালি হবে, নষ্ট হয়ে যাবে অনেক পরিবার।
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তা কাটিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শিক্ষার্থীরা আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। আর আগামী দিনের কর্ণধার দের সম্ভাবনা যদি এভাবে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে নষ্ট হয়ে যায়, এটা আমাদের জন্য মোটেই সুখকর হবে না।
২০১৮ সালে হাজার হাজার স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমে এসেছিলো নিরাপদ সড়কের দাবিতে। ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগষ্ট পর্যন্ত আন্দোলন চলেছিলো। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ‘সড়ক পরিবহন আইন – ২০১৮’ পাস করে। সেই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় দাড়িয়ে সকল যানবাহনের লাইসেন্স দেখা থেকে শুরু করে সব আইন মেনে কীভাবে দূর্ঘটনা এবং যানজট কমানো যায় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলো। সড়ক পরিবহন আইন পাস হবার পর সকলের আশা ছিলো এই আইন কার্যকরের ফলে দূর্ঘটনা কমে আসবে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেই আইনের বাস্তবায়ন খুব একটা দেখা যায় না। পরিবহন শ্রমিকরা আইনের ১২৬টি ধারার মধ্যে ৩৪টি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন৷ হয়তো সেগুলো বাস্তবায়নও হবে। এতে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি সমূহ পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে না।
সড়ক পরিবহন আইনের ৮৪ ধারায় অবৈধভাবে মোটরযানের আকৃতি পরিবর্তনে শাস্তির কথা বলা হয়েছে, ৯৮ নম্বর ধারায় ওভারলোডিং বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গাড়ি চালানোর শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১০৫ নম্বর ধারায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
কিন্তু সংশোধনে ৮৪ ও ৯৮ ধারাকে জামিনযোগ্য অপরাধ, ৯৮ ধারাকে আপোষযোগ্য বলে প্রস্তাব করেছিলো তারা। এমন আরও অনেক সংশোধন চেয়েছিলো পরিবহন শ্রমিকরা। যদি সড়ক পরিবহন আইন এর যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হতো তাহলে দূর্ঘটনার পরিমাণ এবং নিহতের সংখ্যা দুটোই কমে যেতো। কিন্তু তা না হওয়ায় যেটা হচ্ছে তা তো সবাই দেখতেই পাচ্ছে। বৈধ লাইসেন্স, ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া লক্ষ লক্ষ গাড়ি চলছে দেশে। আইনের সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা নাহলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হতে থাকবে সময়ের সাথে।
দূর্ঘটনার সংখ্যা কিংবা নিহতের সংখ্যার পরিসংখ্যান রয়েছে। কিন্তু দূর্ঘটনায় আহত ব্যাক্তিদের পরবর্তী জীবনের দূর্দশার ঘটনা আমরা জানতে পারি না। প্রতিবছরই সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর সংখ্যাও। হাজার হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে দূর্ঘটনার কারণে। হাজার হাজার পরিবার পথে বসে যাচ্ছে। একটা সড়ক দুর্ঘটনা শতশত মানুষের কান্না বয়ে আনে।
পরিশেষে বলি সড়ক দুর্ঘটনার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া তার মধ্যে প্রধান। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অসতর্কতা এবং অসচেতনতার জন্য দূর্ঘটনা ঘটে থাকে। এতে অনেক প্রাণহানি ঘটে। একারণে শুধুমাত্র আইনের বাস্তবায়ন নয় নাগরিকদের সচেতনতারও প্রয়োজন আছে। আমরা সচেতন হলে এবং আইনের সঠিক বাস্তবায়ন ঘটলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল ছোট হয়ে আসবে৷
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
সারাবাংলা/এসবিডিই