Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শেখ হাসিনার মন্তব্য ও আমাদের কাঁঠাল সমাচার

শিশির ওয়াহিদ
৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:২৭

পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেকে মাংসের বিকল্প হিসেবে কাঁঠাল ব্যবহার করে থাকেন, এর চাহিদা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এ ফলটিকে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই। এটা ‘সুপারফুড’ নামেও পরিচিত। মূলত কাঁঠালের রাজত্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। এ অঞ্চলেই বেশি কাঁঠাল উৎপাদন হয়ে থাকে। কাঁঠালকে আমরা জাতীয় ফল হিসেবে মানি। সহজলভ্য হওয়ায় আমরা অনেকেই এই ফলটিকে অবহেলা করে থাকি। ক্ষেত্রবিশেষে অবহেলার মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে বাংলাদেশের কিছু কিছু যায়গায় জ্যাকফ্রুট তার জাত পাল্টিয়ে ‘কাউফ্রুট’ও বনে যায়।

বিজ্ঞাপন

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে’র (DW) ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে দেখলাম, পশ্চিমা দেশগুলোতে মাংসের বিকল্প হিসেবে কাঁঠালের চাহিদা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ কারণে মাইক্রোসফ্টের পরিচালকের চাকরি ছেড়ে কেরালার জেমস জোসেফ এখন পুরোদস্তু কৃষক বনে গেছেন৷ নিজের বিশাল বাগানে ফলা কাঁঠাল থেকে নানা ধরনের অভিনব সব রেসিপির খাবার বানাচ্ছেন৷ এমনকি জোসেফের খামার থেকে কাঁঠালের আটাও বিক্রি করা হচ্ছে৷ গম বা চালের আটার সঙ্গে মিশিয়ে বা সেগুলোর বিকল্প হিশেবে কেউ কেউ ওই আটা দিয়ে বার্গার, প্যাটিস বা স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার ইডলি বানাচ্ছে। এইতো গতবছর লন্ডনে একটি কাঁঠাল বিক্রি হয়েছে ১৬০ পাউন্ডে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা দাঁড়ায় প্রায় ১৮ হাজার টাকায়।

বিজ্ঞাপন

এটা মোটামুটি কাঁঠাল বিষয়ক বাইরের দেশগুলোর অবস্থা। কিন্তু বিপত্তিটা অন্যখানে। গত বছরের শেষের দিকে কাঁঠালের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে ধন্যবাদ দেওয়ার প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাঁঠাল ও মাংস সম্পর্কিত একটি দূরদর্শী বক্তব্য দিয়েছিলেন।

যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাংসের বিকল্পে কাঁঠালের ব্যবহার সম্পর্কে বক্তব্য দিলেন, তখনই চারিদিকে ভেসে এলো কাঁঠালপাতাখোর বিপ্লবী বকরি সমাজের ম্যা-ম্যা চিৎকার ধ্বনি। বকরিদের সেই চিৎকার কমার বদলে আশ্চর্যজনক হারে বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটা কোনো রাজনৈতিক না হলেও বকরিদের ম্যা-ম্যা ধ্বনিটা আপাদমস্তক রাজনৈতিক। এরা একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে উড়িয়ে দিয়ে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠেছে। বকরিদের সাথে এদেশের তথাকথিত সুশীল-কুশীলরাও দেখি মূর্খামির স্রোতে গা ভাসিয়েছে ।

শেখ হাসিনা আপনাকে কাঁঠাল খেতে বাধ্য করছেনা, কেউই এব্যাপারে কাউকে জোর করছেনা। ওটা ছিল নিছকই তার একটা পরামর্শ। কারণে হোক-অকারণে হোক দেশের বাজারে ক্রমাগত মাংসের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা সাধারণ মানুষের জন্য যেমন অস্বস্তিকর, তেমনটা সরকারের জন্যও। বেশ কিছু অদৃশ্য শক্তির কারণে বাজারে দ্রব্যমূল্য থেকে-থেকে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় যেকোনো সরকারের পক্ষে সেই অদৃশ্য শক্তির সাথে পেরে ওঠা মুশকিল হয়ে যায়, একধরনের সাময়িক অস্থিরতা বিরাজ করে। এমনই এক মূহুর্তে শেখ হাসিনা খুব সূক্ষ্মভাবে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দিলেন, যা অত্যন্ত দূরদর্শী এবং প্রাসঙ্গিক।

দেখুন আমি অর্থনীতির ছাত্র নই, খুব ভালো মতো ব্যাখ্যাতে যেতেও পারবো না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, কোনো দ্রব্যের চাহিদা বাড়লে তার দাম বাড়ে, আবার চাহিদা কমলে দামও কমে। মাংস ক্রয়ের উদ্দেশ্য যখন আমিষের চাহিদা পূরণ, এবং সেই আমিষের অন্যতম উৎস মাংসের দাম যখন চড়া- তখন বাধ্যতামূলক আপনাকে ঐ দ্রব্যের চাহিদা কমিয়ে দিতে হবে। মাংস প্রাণিজ আমিষ, দাম যেহেতু চড়া- চাহিদা আপনাকে কমাতেই হচ্ছে, বিকল্পে আপনি সাময়িক আমিষের সংকট দূর করতে উদ্ভিজ্জ আমিষে ঝুঁকতে পারেন। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর চাহিদা যখন কমতে থাকবে, বাজারদর ঠিকই কিন্তু নিম্নমুখী হতে থাকবে। দ্রব্যমূল্যের অদৃশ্য শক্তির সাথে ভোক্তারাই চাইলে লড়তে পারে, এর জন্য খুব বেশি ক্ষমতার প্রয়োজন নেই, শুধু একটু সহ্যক্ষমতা, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা আর সাহসীকতার প্রয়োজন। সব কাজ সরকারকেই-বা কেন একা করতে হবে? জনগণ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব কি শুধুই ভোগ করা? এর বাইরে কি আমরা কিছুই ভাবতে পারিনা!

মূর্খেরা একটিবারও বুঝবার চেষ্টা করলোনা শেখ হাসিনা ঠিক কী বললেন, কেন-ই বা বললেন, এর পেছনের কারণটা-ই বা কী! এসবের কিছুই না করে তারা নেমে পড়লেন কাঁঠালের গুষ্টি উদ্ধারে। শেখ হাসিনার বক্তব্যের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করে বকরিগুলো ফের লেগে পড়েছে কাঁঠালপাতা ভক্ষণে। মাথায় রাখতে হবে, শেখ হাসিনা আপনাকে সবকিছু আকারে-ইঙ্গিতে ব্যাখ্যা দিতে যাবেন না, তিনি যা বলার সরলভাবেই অর্থবহ শব্দ বাক্য দিয়ে বুঝিয়ে দিবেন। বাকিটুকু আপনার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের খেল। বুঝলে বুঝুন, না বুঝলে ঐ তাদের মতো হায়-হুতাশ করেই সময় কাটান।

প্রশ্ন আসতে পারে, পশ্চিমা দেশের মতো আমাদের দেশে তো নিরামিষাশী মানুষ সংখ্যায় কম, তারা কী খাবে?
-দেখুন, নিরামিষাশী বলতে কি আপনি শুধু মাংস না খাওয়াকেই বুঝেন? যদি তাই বুঝে থাকেন তাহলে ভুল। আমিষ তো তারাও খায়, যারা নিরামিষাশী। তারা উদ্ভিজ্জ আমিষে অভ্যস্ত। দিব্যি আপনার-আমার মতো তারাও হেসে খেলে বেড়ায়, বরং আমাদের তুলনায় তারা বেশি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী নয় কি? তারা মাংস খেয়ে না থাকতে পারলে আপনি-আমি কেন পারবোনা! আপনাকে কেউ মাংস না খেতে জোরও করছেনা, শুধুমাত্র সাময়িক এই ভোগান্তির মধ্যে ধৈর্য ধরতে বলা হচ্ছে, একটু ছাড় দেওয়ার মানসিকতা রাখতে বলা হচ্ছে, বিকল্প খাদ্যপণ্যে অভ্যস্ত হওয়ার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা গোঁয়ার্তুমি করছি, আমাদের একরোখা মনোভাব নিয়েই বসে আছি। উন্নত দেশগুলোয় কাঁঠালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার অনেকগুলো যৌক্তিক কারণও আছে, সে ব্যাখায় যাবোনা। এখন ইন্টারনেট সহজলভ্য, একটু খোঁজ করলেই বিস্তর তথ্য পাওয়া যাবে। কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, শর্করা ও ভিটামিন থাকায় তা মানব দেহের জন্য বিশেষ উপকারী, বঙ্গীয় বিপ্লবী বকরিদের জন্য তা উপকারী নয়। ভাবখানা এমন, কাঁঠাল তারা খাবেইনা। ঠিক আছে, কাঁঠাল তাদেরকে খেতে হবেনা, আপাতত তাদেরকে কাঁঠালপাতা খাওয়ার পরামর্শ প্রদান করা যেতে পারে।

তবে আমি অবাক হয়েছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জানার আগ্রহ ও পরিধি দেখে। আপাতদৃষ্টিতে কাঁঠালের ব্যাপারটা খুব বেশি গুরুতর বিষয় না হলেও এমন একটি ব্যাপারও যে শেখ হাসিনার নজর এড়ায়নি, ওয়ার্ল্ড ট্রেন্ডিংয়ে এই মূহুর্তে কী কী চলছে এটা সম্পর্কে যে একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী এতটা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে ধারণা রাখেন- তা ভেবে আমি রীতিমতো অবাক হই। আমি তাঁর জানার প্রশংসা করি। আমি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেবো। তিনি সামান্য এক কাঁঠাল দিয়ে আমাদেরকে প্রকৃত কাঁঠালপাতাখোর বকরিদের চিনিয়েছেন।

দেশটা সবার; পরোক্ষভাবে কারো মজা দেখার নামে, কাউকে গদিচ্যুত করার দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে যারা অযাচিতভাবে এমন সুন্দর একটি বিষয়ের বিরোধিতা করে যাচ্ছেন, তারা নিচু মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন। গ্রামে হুট করে কারো অর্থ-সম্পত্তি বেড়ে গেলে সে নানাভাবে ঔদ্ধত্য দেখায়। এটা করবো না- সেটা করবো না, এটা খাবোনা- ওটা খাবোনা, অমুকের সাথে মিশবো- তমুকের সাথে মিশবো না, ইত্যাকার নানা ঢংয়ের কুরুচিপূর্ণ কার্যকলাপের বহিঃপ্রকাশ সে ঘটাতে থাকে। আমাদের অবস্থা এখন অনেকটা তেমন। আমি কাঁঠাল কেন খাবো, মাংস আমাকে খেতেই হবে, শেখ হাসিনা মাংসের দাম না কমিয়ে কাঁঠাল নিয়ে কেন বললেন, আমি কাঁঠাল খাবো’ই-না শেখ হাসিনার মজা দেখে ছাড়বো, এধরণের চিন্তা যারা করছে, নিঃসন্দেহে তাদের চুলকানিটা অন্য কোথাও। পণ্যের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে আপনি যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করুন, সঠিক উপায়ে মূল্য সংকোচনের দাবি জানান, দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন করুন- এসবের কিছুই না করে কিছু একটা হলেই কাউকে গদিচ্যুত করার দিবাস্বপ্ন দেখেন কেন? সমস্যাটা কি মজ্জাগত হয়ে দাঁড়ালো! ভালো বিষয়কে নর্দমার কীটের মতো কিলবিল করে উপহাস করেন কেন? যৌক্তিক দাবিটা তো এখানেই মাঠে মারা যায়। জনকল্যাণমুখী একটা নিরপেক্ষ মন্তব্যকে আমরা রাজনীতির নোংরা আবর্জনায় রূপ দিয়ে ফেলেছি। আমরা বিরোধী মতাদর্শের কারো কোনো কিছুন কেন যেন স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারিনা!

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু ঐ একই দিন তার বক্তব্যে কাঁঠাল পাতার ব্যবহার সম্পর্কেও বলেছেন। কাঁঠালপাতা অনেক উপকারী, কচি কাঁঠালপাতার রসে চুলকানি সারে। বকরিরা পাতা ভক্ষণের পাশাপাশি আপাতত সেটাও কাজে লাগাতে পারে- অন্তত চুলকানিটা সারবে।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সমাজকর্মী

সারাবাংলা/এজেডএস

শিশির ওয়াহিদ শেখ হাসিনার মন্তব্য

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর