সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর (মেয়ে) আত্মহত্যার ঘটনায় সরগরম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিভিন্ন মাধ্যমে খবর নিয়ে জানা গেল, আত্মহত্যাকারী মেয়েটি বিবিএ ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী। বিভাগের চেয়ারম্যান ফাইনাল পরীক্ষা দিতে অনুমতি না দেওয়ায় সে আত্মহত্যা করেছে—এমনটা অভিযোগ তার স্বামীর। উল্লেখ্য, বিভিন্ন সূত্রে জানা গেল—মেয়েটি বিবাহিত এবং সন্তানসম্ভবা ছিল। তেজগাঁও কলেজের এক ছাত্রের সঙ্গে দীর্ঘদিনের প্রেম এবং তা থেকে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
একসঙ্গেই তারা ক্যাম্পাসে থাকতেন। জানা গেল, তাদের বিবাহের খবর পরিবার জানতো না। এতদিন তাদের যাপিত জীবন ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু কেন এতদিন পর এসে মেয়েটা আত্মহত্যার পথ বেছে নিল? প্রশ্ন সেখানে। ঘটনার কার্যকারণ বিশ্লেষণে বলা যায়, জীবনের প্রথম পর্যায়ে আবেগবশত তারা একটি বন্ধনে আবদ্ধ হলেও একটা সময়ে এসে জাগতিক জীবনের বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় তাদের উভয়েরই। পরিবেশ, পরিস্থিতি আর সমাজের যাতাকলে এই অনিবার্য বাস্তবতা তাদের উভয়ের মাঝেই বা দুইজনের একজনের মাঝে তীব্র হতাশার জন্ম দেয়। সেখান থেকে শুরু হয় পারস্পারিক মানসিক যাতনা। সে থেকে সৃষ্টি হয় বোধ আর শ্রেণিকরণের। বোধ বলতে উচিত-অনুচিতের বোধ। আর শ্রেণিকরণ বলতে যোগ্যতার শ্রেণিকরণ। যেমন- ‘আমি আরও ভালো ডিজার্ভ করি’। তখন মানসিকভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে হয়। জীবনের প্রতি তীব্র মায়া-ভালোবাসা, বেঁচে থাকার ইচ্ছা মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়। এতদিন হাজার হাজার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা, জীবন নিয়ে যুদ্ধ করা মানুষটি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যহীন বা বোঝা মনে করে। সে মনে করে পৃথিবী থেকে তার অস্তিত্ব মুছে গেলেই সে চিরসুখী হবে। এ পয়েন্টে এসেই একজন মানুষ নিজের প্রতি পুরোপুরি বেপরোয়া হয়ে যায়। হারিয়ে ফেলে জীবনের ছন্দ, বেঁচে থাকার অনিবার্য ইচ্ছা। সব মানুষেরই জীবনের প্রতি মায়া আছে। কে না চায় এ পৃথিবীতে একদিন, একঘন্টা, এক মুহূর্ত বেশি বেঁচে থাকতে? কিন্তু তবুও মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কেন নেয় সেটাই বড় প্রশ্ন, বড় জিজ্ঞাসা! অর্থাৎ, সহ্যশক্তি যখন আর থাকে না, যখন আর নিজেকে দমিয়ে রাখা যায় না, তখন মানুষ অনিবার্য সেই না ফেরার পথে পাড়ি জমান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মহত্যাকারী মেয়েটি হয়তো উপলব্ধি করেছিল, এ বয়সে সন্তান জন্ম দিলে তাকে অনেক অসহনীয় বিষয়ের মুখোমুখি হতে হবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেল, মেয়েটির বিয়ের খবর তার পরিবার জানে না। এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্ট। এর মাঝে সন্তান জন্ম হলে সেটাতে তার পারিবারিক মর্যাদা ও সামাজিক পর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। বন্ধুবান্ধব, সমাজ কোথাও সে মুখ দেখাতে পারবে না। বা এ দুর্যোগময় সময়টাতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া, সে কিন্তু কয়েকটি পরীক্ষা দিতে পারিনি বিভিন্ন এসব জটিলতার কারণে, যার কারণে তাকে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি তাদের শিক্ষাগত স্ট্যাটাস। যেমন-মেয়েটি পড়ে পাবলিকে আর ছেলেটি ন্যাশনালে। প্রচলিতঅর্থে মেয়েটির যোগ্যতাকেই এগিয়ে রাখা হবে। তাছাড়া তার অ্যাকাডেমিক রেজাল্টও বেশ ভালো (৩.৯)। এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, স্বামীর খারাপ প্রভাব, শেষমেশ নিজের ভুলের মাশুল গুনতে গিয়ে হিসাবনিকাশ করতে গিয়ে ফলাফল শূন্যে মিলিত হওয়া—অনেকগুলো ফ্যাক্টই এখানে তার আত্মহত্যার মূলে ক্রিয়াশীল।
জীবনে সহ্যশক্তিটাই সবচেয়ে জরুরি। জীবনে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, হতাশা থাকবেই—এটা জীবনেরই অনিবার্য নিয়ম। আঁধার কেটে গেলে আলোর দেখা মিলবেই। দিনে ২৪ ঘন্টার প্রতি মিনিট কারও ভালো যায় না—সেটা কেউই বলতে পারবে না। জীবনে আঘাত-সংঘাত, ঘাত-প্রতিঘাত থাকবেই। বুদ্ধিমানের কাজ হলো সহ্য করে টিকে থাকা, সময়ের জন্য অপেক্ষা করা, জীবনকে উপভোগ করা। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ মানুষই সে জীবনকে উপভোগ করতে ভুলে যাই।
জীবনে আমার ওপর যে পরিমাণ ঘাত-প্রতিঘাত গিয়েছে, যায়—তাতে আত্মহত্যার নিয়মে ফেললে আমার বহু আগেই পৃথিবীর মায়া ভুলে নিরন্তরের পথে পাড়ি দেওয়ার কথা। কিন্তু আমি তা করিনি বা করবও না। সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। কারণ, দেশ ও জাতির কাছে এ জীবনের দায় আছে, আছে মূল্য। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই বুঝতে পারে না সে মূল্য। আমি যত দুঃখ, কষ্টে থাকি না কেন, সেটা বাইর থেকে দেখে কেউই বুঝবে না, উপলব্ধি করতে পারবে না, বা বুঝতে দেওয়া হবে না। বাইর থেকে দেখে মনে হয়, আমার মতো এত সুখী মানুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা আর নেই। আমাকে অনেকেই যখন এ কথা বলেন, আমি বলি—আপনার উপলব্ধি সত্যি। ‘আমি পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ’। নিজের দুঃখ-কষ্ট কাউকে বুঝতে না দিতে পারাও অনেক বড়গুণ, অসাধারণ যোগ্যতা। কারণ, দিনশেষে আপনি আপনারই। আপনাকে ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে আবার গড়ে উঠতে হবে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। Survival of the fittest—হওয়াতেই জীবনের সফলতা। কিন্তু সেটা খুব কম মানুষই পারে।
দেশে তরুণ-তরুণীদের মাঝে দিনদিন আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। আর ১৯-২৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীরাই বেশি আত্মহত্যা করছে। সবগুলো আত্মহত্যার সঙ্গে কিন্তু একটা মিল পাওয়া যাচ্ছে। দেশের তরুণ প্রজন্মের বিরাট একটা অংশ নানামুখী সংকট আর হতাশায় নিমজ্জিত। আর তা থেকেই আত্মাহুতি—আত্মহত্যা। অথচ সেসব সংকট-হতাশা নিরসনে কোন উদ্যোগ নেই। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে শিক্ষার্থীরা যে বিভিন্ন জোরজবরদস্তিমূলক বিষয় বা ঘটনার মুখোমুখি হয়ে ‘জীবিত থেকে মরে যেতে হয়’—সে বিষয়ে কি কারও ভ্রুক্ষেপ আছে? শিক্ষিত বেকার তরুণের হাহাকার কি কারও চোখে পড়ে? আমরা ভুলেই গিয়েছি যে, তরুণ প্রজন্ম রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার ঘটনায় অনেকে বলবেন, মানসিক কাউন্সিলিং সেল, অমুক সেল, তমুক সেল গঠন করো। কিন্তু পারতপক্ষে তা কোন সুফল বয়ে আনবে না। সংকটের মূলে হাত দিতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত সমাধান ও সুফল আসবে না।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট