জন্ম হোক যথা-তথা কর্ম হোক ভালো!
১২ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:১২
বিনোদন কি এবং কেন আমরা বিনোদন পছন্দ করি? বিনোদন কি রুচি বা অরুচি সম্পন্ন হতে পারে? কখন বিনোদন রুচি এবং কখন অরুচি সম্পন্ন এবং এ বিচার করার দায়ভার কার ওপর?
একটা গুষ্টি, একটি সমাজ তথা একটি পরিবার এবং দেশের বেশির ভাগ লোক যে জিনিসগুলোতে মজা পায়, সেটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করে, গনমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো দখল করে সেটা নিশ্চয়ই সেই গুষ্টি, জাতি, সমাজ এবং দেশের জন্য বিনোদন। তা নাহলে কেন সেটা নিয়ে প্রতিদিন জল্পনা-কল্পনা হবে? আর যখন এমনটি সর্বক্ষণ হতে থাকে তখন সেটাই সেই দেশের মানুষের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাড়ায়, কারণ সেই জাতি সেটাই ডিজার্ভ করে। রাষ্ট্রের জনগণ যেমন সে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরাও তেমন হয়ে থাকে। প্রকৃতির ক্ষেত্রে একই অবস্থা যেমন আম গাছের তলে আমই পড়বে, সেখানে জাম বা কাঁঠাল পড়বে না। এখন যদি কেউ জোর করে আম গাছের তলে কাঁঠাল পড়াতে চেষ্টা করে তবে আম গাছের তলে কাঁঠাল গাছ লাগাতে হবে, তাহলে আমের সঙ্গে কাঁঠালেরও পড়ার সম্ভবনা থাকবে।
বাংলাদেশের এলিট সমাজ দেশটিকে বেশ ইচ্ছে মত চেটেপুটে খাচ্ছে, কই একবারও তো তারা বলেনি ভুল হয়েছে ক্ষমা করে দিন, কিন্তু গণমাধ্যমের একজন পরিচিত নাম, তিনি চুরি করে ধরা পড়েন এবং সবার কাছে ক্ষমা চান। এই বিষয়টি দেশব্যাপী ভাইরাল হয়ে যায়। এখন তিনি বিনোদনের খোরাক হয়ে বেশ আছেন। তারপর অনেকে আজীবন নাটক, গান, অভিনয় করেও দেখা যায় ভালো গায়ক বা নায়ক হতে পারেনা। আবার কেউ নিজের নামের আগে হিরো টাইটেল লাগিয়ে দিব্বি হিরো হয়ে সর্বজন স্বীকৃত। শুধু তাই নয়, পানি পিপাসা লাগলে যেমন আমরা পানি পান করে তৃষ্ণা মেটাই, ঠিক সারাদিন ক্লান্তি শেষে বা প্রচন্ড মন খারাপ, হঠাৎ গণমাধ্যমে ঢুকলেন আর সঙ্গে সঙ্গে হিরো আলম বা গণমাধ্যমের সেই জনপ্রিয় চোরের ছবি ফেসবুক, খবরের কাগজ বা টেলিভিশনের পর্দায় এসে হাজির হয়ে গেল আর সবার মনটা বিনোদনে ভরে গেল। এ কাজটি একজন এলিট শ্রেণির দুর্নীতিবাজ বা রুচি সম্পন্ন কোন ব্যক্তি এত সহজে পারবে কি? তাহলে ধরে নিতে পারি হিরো আলমের জনপ্রিয়তা অনেকের কাছে নিশ্চয়ই পরশ্রীকাতরতার পরিচয় মাত্র।
গত কয়েকদিন আগে প্রথম আলোর একজন সাংবাদিক ডিজিটাল ক্রাইমে ফেসে গেল, তার অপরাধে তার মালিককেও তলব করা হলো এবং ফাঁসানো হলো। সুষ্ঠু আইন অনুযায়ী চমৎকার ন্যায় বিচার হতো যদি ঘটনাটি ডিজিটাল ক্রাইমের মধ্যে পড়ত। আমার প্রশ্ন প্রতিদিন দেশের রাষ্ট্রীয় কর্মীরা যে পরিমাণ দুর্নীতি, অনীতি, বাটপারি-রাহাজানি সহ জনগণকে হয়রানি করছে, কই তাদের তো একইভাবে বিচার হচ্ছে না? যেমন: একটি উদাহরণ; ধরুণ একজন মন্ত্রী বা সচিবের অধিনে কাজ করেন এমন এক কর্মী দুর্নীতি করেছে, কই তার শাস্তির সঙ্গে তার মন্ত্রী বা সচিবকে তো ফাঁসানো হচ্ছে না? এমন একটি সময় আমরা সাধারণ জনগণ বোধ হারিয়ে মন খারাপ করে হয়ত বসে আছি ঠিক তখন হিরো আলোম বা জনগণের আদরের সেই চোর ভাইয়ের মুখে আদর্শ নীতির কথা শুনলে আর কিছু না হোক সামান্য সময়ের জন্য হলেও আমাদের অনেকের মন ভালো হয়ে যায়। এটা গেল দেশের কথা, এখন দেখা যাক বহির্বিশ্বে কি অবস্থা, এখানে যারা বিনোদন যোগাচ্ছে, তাদের চেহারা থেকে শুরু করে শিক্ষাগত যোগ্যতাই বা কেমন? চার্লি চ্যাপলিন, মিস্টার বিন, জেলেন্সকি এরকম হাতে গোনা শত শত বিশ্বখ্যাত আর্টিস্ট রয়েছে যারা যুগ যুগ ধরে বিনোদন দিয়ে চলছে মানুষের দুর্দিনে। তাদেরকেও আমরা দেখছি গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে। কখনও কি প্রশ্ন করেছি তাদের শিক্ষা, চেহারার গঠন, ভাষা বা শিক্ষার যোগ্যতা নিয়ে? কারণ তারা ভিনদেশি প্রডাক্ট, কিছু যায় আসে না, বিদেশি হলেই তেল মারতে হবে, জিহ্বা লাগাতে হবে, প্রশংসা করতে হবে ইত্যাদি। ছোটবেলায় বাংলা সিনেমা দেখেছি প্রচুর, টেলি সামাদের অভিনয়, হাস্যকর কথা, তার ঢং, হৃদয়ে আজো জড়িয়ে রয়েছে বিনোদনের অংশ হিসাবে, কখনও ভাবিনি তার চেহারা, রুচি বা অরুচি নিয়ে। তারপর আমরা যারা বর্তমানের গণমাধ্যমের পরিচিত মুখ এবং যারা রুচি নিয়ে কথা বলছি, একবার নিজেরা যদি আয়নার সামনে দাঁড়াই, দেখেছি কি আমাদের দেখতে কেমন বা আমাদের নিজেদের আচরণ কেমন!
যাইহোক আমি বহু বছর হলো দেশ ছেড়েছি, থাকি ঠান্ডা দেশে তারপর পরদেশী। এখানে সবাই শিক্ষিত, দেখতে শুনতে খারাপ না। তা সত্ত্বেও এখানকার প্রধানমন্ত্রী, এস্টেফান লোভেন যার বলতে গেলে বাবার দেখা মেলেনি, মা ছিলেন হয়ত মাতাল, নিজে সমাজের সাহায্যে কোন রকম বড় হয়ে পরে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, একবার নয় দুই বার। তারপর গত বছর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইডেনের এসভান্তে প্যাবো (Svante Pääbo)। গত বছর নোবেল কমিটি তার নাম ঘোষণা করেন।
নোবেল কমিটির তরফে বলা হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে গত বছরের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে সুইডেনের এই বিজ্ঞানীকে। বিলুপ্ত হোমিনদের জিনোম (genome) এবং মানব প্রজাতির বিবর্তন নিয়ে গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে এই বিজ্ঞানীকে।
মজার ব্যাপার হলো- এসভান্তের বাবা সুনে ব্যারিস্ট্রোম (Sune Bergström) ১৯৮২ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সুনের জন্ম ১০ জানুয়ারি ১৯১৬ এবং মৃত্যু ১৫ আগস্ট ২০০৪। এসভান্তের জন্ম ২০ এপ্রিল ১৯৫৫। এসভান্তের মা করিন প্যাবো (Karin Pääbo) রসায়নবিদ। মূলত এস্তোনিয়ার নাগরিক তবে তখন থেকেই তিনি স্টকহোমে বসবাস করেন এবং সুনে ব্যারিস্ট্রোমের সাথে গোপন প্রেমে পড়েন। সেই সম্পর্কে এসভান্তের জন্ম হয় এবং সুনে গোপনে করিন এবং এসভান্তের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। পরে সময়ের সাথে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যায় এবং সমাজে এসভান্তের পরিচয় সুনের সন্তান হিসাবে মর্যাদা পায়। মূলত সুনে ব্যারিস্ট্রোম তখন বিবাহিত এবং তার নিজ পরিবার থাকা সত্ত্বেও তিনি করিনের প্রেমে পড়েন। শুরু থেকে এসভান্তে তার মা করিনের পরিচয়ে বড় হতে থাকে বিধায় মায়ের পদবি এসভান্তের “Surname” প্যাবো হিসেবে থেকে যায়।
ছোটবেলা থেকেই মা করিন এসভান্তকে নিয়ে মিশর ভ্রমণ করেছেন। মিসরের ইতিহাস এবং মমির ওপর এসভান্তের সেই ১৩ বছর বয়স থেকেই আগ্রহের জন্ম নেয়। সেই ছোটবেলার আগ্রহ যা তাকে দিনে দিনে আবিষ্কারের দিকে নিয়ে গিয়েছিল; যার ফল স্বরূপ গত বছরের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর তার নোবেল পুরস্কার অর্জন।
সুইডেনের সিস্টেম বায়োলজির অধ্যাপক স্টেন লিনারসন (Sten Lindersson) এসভান্তে প্যাবো সম্পর্কে বলেছেন- “তিনি একজন অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং খোলা মনের সৎ ব্যক্তি”। সুইডিশ টেলিভিশনের পর্দায় তাকে তার ১০ কোটি টাকা পুরস্কারের অর্থ কীভাবে ব্যয় করবেন জিজ্ঞাসাবাদ করলে বলেছেন, তিনি তার সুইডিশ সামার হাউস রেনুভেট করবেন- সেই বিষয়টি তিনি নিশ্চিত।
এসভান্তের স্টোরিটি জানার পর মনে পড়ে গেল আমাদের সমাজের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের জীবনের কথা। যেখানে আমরা তাদের জীবন নাশে সারাক্ষণ ব্যস্ত। এখনো আমরা সমাজের সাধারণ মানুষের মর্যাদা দিতে লজ্জাবোধ করি। গরিব-ধনীর পার্থক্যকে বড় করে দেখি। কিন্তু গোবরেও যে পদ্মফুল ফোটে তা শুধু কথার কথা নয়, বাস্তবেও লক্ষণীয়। ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হতে দেখেছি। রাজার ছেলে রাজা হতে দেখেছি। কৃষকের ছেলে কৃষক হতে দেখেছি। নোবেল পুরস্কার পাওয়া বাবার পরিচয় ছাড়া গড়ে উঠা এক সন্তানের নোবেল পুরস্কার জয়লাভ করার গল্প এর আগে শুনিনি। সব কিছুই অসম্ভব যতক্ষণ না কেউ সেটা সম্ভব না করে। সুইডেনের এসভান্তে প্যাবো তা প্রমাণ করলেন তার নোবেল পুরস্কার অর্জনের মধ্য দিয়ে। আমার এই লিখায় যদি কেউ কষ্ট পান তবে ক্ষমা সুন্দর মনে দেখবেন যেমনটি আমি আপনাদের দেখেছি।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই