Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাঙালির সর্বজনীন লোকউৎসব

ইমরান ইমন
১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:১৭

পহেলা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন লোকউৎসব। অতীতের গ্লানি, ব্যর্থতা ভুলে নতুন উদ্যমে চলার শপথ নিয়ে এ দিনের যাত্রা শুরু। পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। বাঙালির জাতীয় জীবনে যে কয়টি উৎসব বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে এর মধ্যে পহেলা বৈশাখ অন্যতম। ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সব ভেদাভেদ ভুলে এই একটা উৎসব সবাই একাকার হয়ে পালন করে।‌

পহেলা বৈশাখ বা এই বাংলা নববর্ষ আজকের দিনে বাঙালির জাতীয় জীবনে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হওয়ার পেছনে সমৃদ্ধ এক ইতিহাস রয়েছে। হিন্দু সৌরপঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় কিন্তু এমনটি ছিল না। তখন বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই তখন নির্ভর করতে হতো।

বিজ্ঞাপন

ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরী সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষিজ ফলনের সঙ্গে মিলতো না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবী হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।

বিজ্ঞাপন

মোঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকেই বাংলা নববর্ষ উদযাপনের রেওয়াজ শুরু হয়। চৈত্রের শেষ দিনে কৃষকরা ভূস্বামীদের সাথে সব দেনাপাওনা মিটিয়ে নিতেন এবং পহেলা বৈশাখের দিন ভূস্বামীরা কৃষকদের মিষ্টি মুখ করাতেন। পহেলা বৈশাখের মর্মকথা হলো কৃষকদের নতুন ফসল ঘরে তোলা এবং ভূস্বামী জমিদারদের কাছ থেকে ঋণমুক্ত হওয়ার আনন্দ। আর এ কারণেই পহেলা বৈশাখ বাঙালির পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো পহেলা বৈশাখ এ মর্মকথা খুব মানুষই জানেন!

পহেলা বৈশাখের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হলো হালখাতা তথা নতুন খাতা প্রস্তুতকরণ। এখন পর্যন্তও ব্যবসায়িক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হালখাতার প্রচলন রয়েছে। এই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। মেলায় দেশীয় কুটির শিল্পের বিভিন্ন পণ্য ও পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়।

আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোমকীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।

১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদের অংশ হিসেবে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে প্রথম নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান করে। সে থেকে তথা ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে প্রতি বছর— ‘এসো হে বৈশাখ, এসো হে…’ গান দিয়ে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয় এ দেশের হাজার হাজার সংস্কৃতি প্রিয় মানুষ। স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃতপক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয় সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ। এই একটা দিন—এই একটা উৎসবে ধর্ম-বর্ণ-জাতি সবাই সব ভেদাভেদ ভুলে একই কাতারে শামিল হয়। আমাদের ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত থাকলেও এই একটা উৎসব আমাদের মাঝে প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। রমনার বটমূলে আমরা সেই প্রাণের সঞ্চার দেখতে পাই।

কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এদেশের সংস্কৃতির ঘোর বিরোধী কিছু অপশক্তি ও অশুভ শক্তির কর্মকাণ্ড আমাদের মর্মাহত করে। ২০০১ সালে রমনার বটমূলে বোমা হামলা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে নারীদের ইভটিজিং, সম্ভ্রমহানি তো ঘটেই চলছে। যা আমাদের সংস্কৃতির সাথে যায় না। আমরা আমাদের অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে পরিচয় দিলেও পারতপক্ষে এখনও দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প বিদ্যমান। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আমাদের কাছে বড় দৃষ্টান্ত। বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অপশক্তি আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছে। খোদ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও চেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু সফল হয়নি। আমাদের সংস্কৃতি বিরোধী সাম্প্রদায়িক এই অপশক্তিকে আমাদের রুখতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

স্বাধীনতার পর থেকে যত দিন গড়াচ্ছে ততই বেশি পহেলা বৈশাখ বেশ জমকালোভাবে পালিত হচ্ছে। সময়ের পরিক্রমায় আমাদের বাঙালীত্ব ও বাঙালিয়ানা প্রগাঢ় হচ্ছে। কিন্তু সংস্কৃতির আগ্রাসন যেন না ঘটে সে দিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। অপসংস্কৃতি যেন আমাদের হাজার বছরের প্রাণময় সংস্কৃতি গুলোতে আঘাত হানতে না পারে সে দিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

আমরা এ প্রজন্ম যেভাবে জমকালো আয়োজনে নববর্ষ উদযাপন করছি আমাদের বাবা-মায়েরা কিন্তু সেভাবে নববর্ষ উদযাপন করতে পারেননি। বড় হয়ে বাবা-মা কে আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম— তোমরা পহেলা বৈশাখ কীভাবে উদযাপন করতে? তারা বললেন— ‘আমরা এমনিতে ঘরে বসে নিজেদের মাঝে উৎসবমুখর পরিবেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতাম, নতুন কাপড়চোপড় পরিধান করতাম, ঘর পরিস্কার রাখতাম, বাঙালির ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খাওয়ার রান্না করতাম। তোরা তো এখন মেলায় যাস, মঙ্গল শোভাযাত্রায় যাস, পান্তা ইলিশ খাইতে যাস, ঘুরতে যাস- তখনকার সময়ে আমাদের পক্ষে এগুলো করা সম্ভব হয়নি।’

সময়ের পরিক্রমায় আমাদের সংস্কৃতি পালনের ধরণে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু আমাদের মূল থেকে বিচ্যুতি ঘটা যাবে না। এটা আমাদের জন্য স্বস্তির বিষয় যে— কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে দিনদিন আমরা সুশীল, সভ্য, আধুনিক ও সংস্কৃতিমনা হচ্ছি। এককালে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে অনেক বাধা ছিল, এটিকে শুধু সমাজের একটা শ্রেণীর উৎসব বলে চালিয়ে দেয়া হতো, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো হতো। সব বাধা ডিঙিয়ে পহেলা বৈশাখ এখন বাঙালির সর্বজনীন লোকউৎসব।

আমাদের জন্য আশার সংবাদ হলো—কুসংস্কার পরিহার করে দিনদিন এ প্রজন্মের মানুষের মাঝে পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা‌ নববর্ষ উদযাপনের রীতি বেড়েই চলছে। আর এক্ষেত্রে বর্তমান প্রজন্ম কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। সময়ের পরিক্রমায় অনন্তকাল ধরে বাঙালির এই প্রাণের উৎসবকে বাঁচিয়ে রাখতে বর্তমান প্রজন্মকে সোচ্চার থাকতে হবে। সর্বোপরি, সোচ্চার হতে হবে সব‌ ধরনের সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইমরান ইমন বাঙালির সর্বজনীন লোকউৎসব মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর