বাঙালি সংস্কৃতির ধারক পহেলা বৈশাখ
১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:১৬
বছর পেরিয়ে আবারও দুয়ারে হাজির পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। ১৪৩০ বঙ্গাব্দ কালের যাত্রা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল, মত নির্বিশেষে বাঙালির এক মহামিলনের দিন। সকল বাঙালি যৌথভাবে পালন করতে পহেলা বৈশাখ ব্যতীত আর কোন উৎসব নাই। দুই ঈদ, পূজায় সম্প্রীতি সৌহার্দ্য থাকলেও সেটা ধর্মীয় উৎস। আবার একুশে ফেব্রুয়ারি বা জাতীয় দিবসগুলো আনন্দ উৎসব নয়। এ কারণে সারা বছর আমরা যেমন উন্মুখ হয়ে থাকি কবে আসবে পহেলা বৈশাখ, নানা ঢঙে নানা সাজে সাজাবো। ঠিক পাহাড়ে কিংবা সমতলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের ভেতরেও থাকে নানা আয়োজন। তারা আয়োজন করে বৈসাবির।
পহেলা বৈশাখের পথ চলা কবে কখন থেকে শুরু হলো এটা হয়তো সঠিক করে কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এটা সত্য যে মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে বৈশাখ মাসকে কেন্দ্র করে পত্তন হয় ফসিল সনের। হিজরী সনের সাথে ১০-১১ দিনের পার্থক্য জটিলতা তৈরি হওয়ায় বাংলা ফসিল সনের আবির্ভাব। এই দিনে সূর্য ওঠার সাথে সাথে বাংলা বছর গণনা শুরু হতো এবং শুরু হতো খাজনা দেওয়ার কার্যক্রম। প্রজা যেমনই থাকুক, খাজনা দেওয়া বাধ্যতামূলক। প্রজারও স্বস্তি মিলতো, জমিদারের দাওয়াখানায় মিষ্টিমুখ করে বাড়িতে ফিরতো ভবিষ্যতে আবার জমি চাষ করতে পারবে সেই আনন্দে। এখন তো জমিদারি প্রথা নেই, কিন্তু পহেলা বৈশাখ আছে, উৎসব আছে। বৃহৎ পরিসরে উৎসবের রূপ নিতে গিয়ে ক্রমান্বয়ে আচার সংস্কৃতির সংযোজন বিয়োজন হয়েছে। গ্রামীণ এবং শহুরে উৎসবে এসেছে ভিন্নতা।
গ্রাম বাংলায় নববর্ষের চালচিত্র অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ এবং আনন্দময়। বড়দের ভেতরে তেমন একটা আনন্দ দেখা না গেলেও পহেলা বৈশাখ আসলেই শিশু-কিশোরদের মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। যদিও গ্রামীণ এই বৈচিত্র্যময়তা বর্তমানে ভাঁটার পথে। আমাদের কথাই ধরুন— গত শতাব্দীর শেষ দিকেও আমাদের কিশোর সময়ে পহেলা বৈশাখ আসলেই আমরা বুঝতাম মেলা, নৌকা বাইচ, বছরের প্রথম দিনে ভালো কিছু খাওয়া, হৈ-হুল্লোড় করা আর মায়ের অবাধ্য না হওয়া। বৈশাখ আসার আগেভাগেই আমরা নাতি-নাতনীর দল গিয়ে ধরতাম মানিক দাদুকে। তার কাছে জানতে চাইতাম মেলা কবে হবে। কেননা এই মেলাটা আমাদের বাড়ির উপরে হয়, ঘরের পেছনে। মানিক দাদু আমাদের আশ্বস্ত করতেন, সবুর করো দাদুভাই, কয়দিন পরেই হবে। মেলার দিনে মুখিয়ে থাকতাম বিকালের আশায় কখন মেলা জমবে, সারাদিন রোদের ভেতরে টো টো করতাম। রোদে ঘোরাঘুরি করতে মা নিষেধ করত; কিন্তু কে শোনে কার কথা। ধুমধাম করে মেলা হতো। খাবার, খেলনা, আসবাবপত্র, হাঁড়ি-পাতিলের পসারি সাজিয়ে বসতেন দোকানীরা। ঢোলের তাক-ধুম আওয়াজ আর বাঁশির পু পু শব্দতে মেতে থাকতো সারা বাড়ি। মাটির পুতুল আর কাগজের চরকি-ফুল ছিলো আকর্ষণীয়। মিষ্টিমুখের জন্য থাকতো দেখার মতো আয়োজন— মাছ, গরু, পাখি, ঘোড়ার আদলে মিষ্টি, বাতাসা, নকুল আর গরম গরম জিলাপি। রসগোল্লার দোকানও থাকতো। বাঁশির প্যাঁ পু, তিলের নাড়ু, কটকটি, কচি তালের শ্বাস আর হাওয়াই মিষ্টি হতো আমাদের প্রধান আকর্ষণ। মাঝে মধ্যে নাগরদোলা আসলে কি যে মজা হতো!
আসবাবপত্রের যে কথা বললাম, ওগুলো থাকতো মেলার একেবারে প্রান্তে। এখানে বড়দের কারবার। কুলা, ডালা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ খাট-পালং পর্যন্ত থাকতো। পাড়ার বৌ-ঝিয়েরা বড় ঘোমটা দিয়ে তাদের পছন্দ মতো কেনাকাটা করত। তবে মেলা থেকে কেনা বেশিরভাগ জিনিসেই ঠকতে হতো, তারপরও মেলাই ছিলো কেনাকাটার উৎসব। পহেলা বৈশাখের এই মেলায় দেখতাম— আমাদের কে মুসলমান আর কে হিন্দু বা কে খ্রিস্টান সেটা পার্থক্য করা যেত না। মানিক দাদু মারা যাওয়ার দু’বছর আগে থেকে কি ধর্মীয় বাঁধার কারণে বাড়িতে মেলার আয়োজন বন্ধ থাকল। বাড়ির উপরের মেলা সেই যে বন্ধ হলো আর আয়োজন হয়নি। গ্রামে অন্যপাড়ায় এখনও মেলা হয়, খালের পাড়ে তিন রাস্তার ধারে শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়া বট গাছটার নিচে এখনও হয় বৈরাগীর মেলা; তবে আগের সেই আনন্দটা আর নেই। রঙ ঢঙেও পরিবর্তন এসেছে। যা হোক পহেলা বৈশাখ যে শুধুমাত্র ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভরপুর এমনটা কিন্তু না, গ্রামাঞ্চলে কিছু কুসংস্কার এবং মিথও প্রচলিত আছে। এই যেমন— বছরের প্রথম দিনে ভালো খাবার-দাবার না খেতে পারলে সারা বছর খারাপ খেতে হবে; আবার বছরের প্রথম দিনেই কারও সাথে ঝগড়া বা তর্ক করলে সে সারাবছর তর্ক করে কাটাবে, এমনকি এই দিনে কেউ কারও কাছে ধারও চাইতো না। সুতরাং যে করেই হোক সকলের হাসিখুশি থাকা চাই, খাওয়া চাই ভালো খাবার, চাই পোষাক-পরিচ্ছেদ।
এই তো গেল কেবল গ্রামীণ সংস্কৃতি, গ্রাম্য বাহারি আয়োজন এবং বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা। বর্তমানের শহুরে জীবনে পহেলা বৈশাখ এসে ঠেকেছে ন্যাকামিতে, আছে শ্রেণী চরিত্র। বিশাল বড় মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়, রমনার বটমূলে ছায়ানটের সঙ্গীত, নানা সাজের বৈশাখী পোশাক ও পান্তা-ইলিশের দৌড়াদৌড়ি শহরকেন্দ্রিক বৈশাখের রূপ। গরিব বা নিম্নবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের উপস্থিতি এখানে শূন্য। যে শ্রমজীবী খেটে-খাওয়া মানুষের দুয়ার থেকে পহেলা বৈশাখ সংস্কৃতির সৃষ্টি তাদেরই যদি অংশগ্রহণ না থাকে তাহলে সেটা সার্বজনীন উৎসবের চেহারা থাকে? যা হয় তা হলো বড়লোকি ফ্যাশন, বছরান্তের ঢঙ।
পাকিস্তান সরকার সব সময়ই বাঙালির সংস্কৃতি এবং জাতিসত্তা বিকাশের অন্তরায় ছিলো। বাঙালিও নানা দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ১৯৬৭ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান পহেলা বৈশাখের সরকারি ছুটি বাতিল করলেন। ঘোষণা দিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ, রবীন্দ্র সঙ্গীত ইসলামবিরোধী। ছায়ানট সাহসের সাথে এগিয়ে এসে রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের উদযাপন শুরু করলো; আইয়ুব খানের চোখ রাঙানি শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকেনি। মঙ্গল শোভাযাত্রাও প্রায় একইভাবে প্রতিবাদের সাংস্কৃতিক প্রকাশ। তবে মঙ্গল শোভাযাত্রা ঢাকার আগে শুরু হয়েছে যশোরে; ১৯৮৫ সালে চারুপিঠ নামক এক আর্ট স্কুলের হাত ধরে। বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী আবরণের মাধ্যমে প্রতিবাদ ফুটিয়ে তোলা এই আয়োজনের গুরুত্বপূর্ণ শৈল্পিক দিক। আয়োজকের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে অংশগ্রহণ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ-তরুণীরা। যা হোক, ইউনেস্কো কর্তৃক মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘ইনটেনজিবল হেরিটেজ’ ধারায় স্বীকৃতি পাওয়া আমাদের বাঙালিত্বের অহংকার।
আশির দশকে শুরু হলো পান্তা ইলিশের উৎপাত। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ১৯৮৪ সালে ‘দৈনিক দেশ’ পত্রিকার কার্যালয়ে এর উৎপত্তি। সামরিক সরকারের রোষানলে পরে পত্রিকাটি বন্ধ ছিলো। কোনো কাজ নেই, এরকম সময়ে পত্রিকাটির দায়িত্বশীলেরা পহেলা বৈশাখের দিনে রমনার বটমূলের দক্ষিণ পাশে গাছের নিচে পান্তা ভাতের দোকান দিয়ে বসলেন। বাঙালিয়ানার স্মরণে খাওয়ার উপকরণ— কাঁচা পেঁয়াজ-মরিচ, আলু ভর্তা আর ডালের বড়ার সাথে আগের দিন রান্না করা লাল বিরই চালের পান্তা। পরবর্তীতে সেটাকে রূপ নেয় ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার অহংকারে। বৈশাখের দিন এক প্লেট পান্তা-ইলিশ বিক্রি হয় হাজার টাকারও উপরে। একে তো বৈশাখ মাস ইলিশের মৌসুম না, তার উপরে অস্বাভাবিক চাহিদায় ইলিশের দামে ডাকাতি চলে। এক কেজি ইলিশের দাম পৌঁছায় ২০ হাজার টাকার কাছাকাছি। কথা হলো— যারা এই ইলিশ খায় তারা এতো টাকা পায় কোথায়? অবশ্যই যারা লুটেরা, বৈষম্যের প্রতীক, সমাজের বিষফোঁড়া তাদের লুটপাটে। তারা বাংলা নববর্ষ এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিবন্ধক।
বৈশাখ পত্তনের গোড়ার দিক থেকে গ্রামগঞ্জে, শহরে-বন্দরে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরাও বৈশাখ উদযাপন করতেন। তবে সেটা ভিন্ন কায়দায়। তাদের উদ্দেশ্যেও ভিন্ন, ব্যবসায়িক। তারা খুলে বসতেন হালখাতা অনুষ্ঠান। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ কাগজ ত্রিভুজ আকৃতিতে কেটে দড়ির সাথে লাগিয়ে দোকানটি সাজান। ভেতরটায় সাজান বাসরঘরে ব্যবহৃত প্লাস্টিক কাগজের নানা ফুল দিয়ে। কেউ কেউ দুটি কলাগাছ, মঙ্গলঘট এবং আমপাতা দিয়ে প্রবেশদ্বার তৈরি করেন। সকাল থেকে খদ্দের আসতে থাকে; বাকির খাতা পরিশোধ করেন, যাদের বাকি নেই তারা অগ্রিম কিছু টাকা হালখাতায় জমা রাখেন। সকলকে মিষ্টিমুখ করে খোশমেজাজে কথাবার্তা বলেন। ক্রেতা-বিক্রেতার ভেতরে গড়ে ওঠে সৌহার্দ্য ভাব বিনিময়। তবে হালখাতার এই আয়োজনটা এখন তেমন একটা নেই, বহুলাংশে কমে গেছে; রয়ে সয়ে পুরান ঢাকায় এবং গ্রামের দিকে কিছুটা চলমান আছে। এই যে কতকিছুই না থাকা এর দায় আমাদের সচেতন ব্যক্তিদের, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর। সংস্কৃতির ধারা রক্ষার্থে দলবল নিয়ে আমাদের ছুটতে হবে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। উদ্বেলিত করতে হবে ঐতিহ্যবাহী যাত্রায়, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি-সারি আর মুর্শিদি গানে। ছুটতে হবে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক ধারা পুনরুজ্জীবনে লোকজ সংস্কৃতিতে।
মানুষের আচার-আচরণের সাথে প্রতিনিয়ত সংস্কৃতির যোগ-বিয়োগ হয়। এটা চিরাচরিত নিয়মিত। তেমনি যুগের পরিক্রমায় আমাদের পহেলা বৈশাখ নতুনভাবে অলংকৃত হচ্ছে। অনেক জিনিস নাই হয়ে গেছে, আবার অনেক কিছু যুক্ত হয়েছে। যে জিনিস চলে গেছে, সে আর ফিরবে না এমন কিছু না। তাকে ফেরানো সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন মননের এবং আমাদের সামষ্টিক স্বদিচ্ছা। কাজেই আমাদের সাংস্কৃতিক ধারা ধরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকুক। পহেলা বৈশাখে জগতের সকল গ্লানি দূর হয়ে যাক এই প্রার্থনা। করোনা মহামারী সম্পূর্ণ নিঃশেষ। পরবর্তী পৃথিবী সূচিসিগ্ধ হয়ে উঠুক। সবাইকে বৈশাখী শুভেচ্ছা।
লেখক: প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এসবিডিই