পবিত্র ‘শবে ক্বদরের’ আমল ও ফজিলত
১৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:৫৬
বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বরকতময় রাত হলো শবে কদর। মহাগ্রন্থ আল কোরআন এই পবিত্র রাতেই নাজিল হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মাহাত্ম্যপূর্ণ রজনীতে।”
আরবিতে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ আর ফারসিতে ‘শবে ক্বদর’ নামে পরিচিত হাজার মাসের মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনী। যা মুসলিম উম্মাহের জন্য একটি অনন্য নেয়ামত ও বরকতময় রাত।
‘শব’ ও ‘লাইলাতুল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত্রি বা রজনী। অন্যদিকে ‘ক্বদর’ শব্দের অর্থ হলো সম্মান, মর্যাদা, মহাসম্মান। এর অন্য অর্থ হলো ভাগ্য, পরিমাণ, তাকদীর নির্ধারণ করা। সুতরাং ‘শবে ক্বদর’ তথা ‘লাইলাতুল ক্বদরের’ অর্থ হচ্ছে সম্মানিত রাত, মহামান্বিত রাত বা মর্যাদার রাত।
রমজান মাস পবিত্র কোরআন নাজিলের মাস। আর ‘শবে ক্বদর’ কোরআন নাজিলের রাত। এ পবিত্র রাতেই প্রথম পবিত্র মক্কা মোকাররমার হেরা পর্বতের গুহায় মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ফেরেশতাদের সর্দার হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজিল হয়েছে। প্রথমে সূরা আলাকের প্রথম ৫টি আয়াত নাজিল হয়। এভাবে দীর্ঘ ২৩ বছরে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন- রমজান মাস! যে মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে মানবের দিশারী ও হেদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনরুপে। [সূরা বাকারা, আয়াত১৮৫]
এই পবিত্র রজনী ‘শবে ক্বদরে’ অধিকসংখ্যক রহমতের ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং সকাল অব্দি পর্যন্ত এক অনন্য শান্তি বিরাজ করে পৃথিবীতে। মহান আল্লাহ বলেন- “হাজার মাসের চেয়ে উত্তম এ রাত।” ‘লাইলাতুল ক্বদরের’ ফজিলত ও তাৎপর্য অপরিসীম। এই পবিত্র রাতে আল্লাহর মুমিন বান্দাগণ ইবাদত বন্দেগী করে রাত যাপন করে।
‘লাইলাতুল ক্বদরের’ নির্দিষ্ট কোনও তারিখ নেই। ২১ রমজান থেকে ২৯ রমজান পর্যন্ত বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে একটি রাত ‘শবে ক্বদর’ হতে পারে। তাই আলেম উলামারা এই বেজোড় রাত ২১/২৩/২৫/২৭/২৯ রমজানে ইবাদত বন্দেগী করার জন্য বলেছেন। ‘লাইলাতুল ক্বদরের’ তারিখের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “আমাকে লাইলাতুল ক্বদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর আমাকে তা ভূলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ ১০ রাতের বেজোড় রাতসমূহে তালাশ করো।” [বুখারী, হাদিস৭০৯] অন্য একটি হাদিসে পাকে আছে- একদা হযরত উবায়দা রহমাতুল্লাহি আলাইহি নবীজি পাক কে জিজ্ঞেস করলে নবীজি সাহাবিদের কে বললেন- “রমজানের শেষের ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলো কে তালাশ করো।” [বুখারী,হাদিস২০১৭]
রমজানের শেষের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে ২৭ রমজান ‘শবে ক্বদর’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ পবিত্র কোরআনের সূরা ক্বদরে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ শব্দটি ৩বার এসেছে। আর ‘লাইলাতুল ক্বদর’ শব্দটির মধ্যে ৯ টি হরফ রয়েছে। আবার (৯×৩) দিয়ে গুণ করলে ২৭ হয়। তাই ‘শবে ক্বদর’ ঠিক ২৭ রমজান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বহু আলেম, মুহাদ্দিস, মুফাস্সির ও ফকিহবিদগণ এ ঠিকে সমর্থন করেছেন।
এই পবিত্র রজনীতে মুসলিম উম্মাহের সকলে ইবাদত বন্দেগী করে রাত কাটান। হাদিস শরীফে আছে- এই পবিত্র রাতে ইবাদত বন্দেগী করার কারণে দোজখের আগুন তাহাদের উপর হারাম হয়ে যায়, বেহেশতে যাবে এবং তাদের জন্য বেহেশতে অসংখ্য ঘর নির্মাণ করা হইবে। এই রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করার কারণে গুনাহ মাফ করে দিবেন এবং শত বৎসরের নেকির সওয়াব অর্জন করতে পারবে। তাওবাকারির তাওবা কবুল করেন ও ভাগ্য পরিবর্তন করে দেন।
‘শবে ক্বদরের’ রাত দো’আ কবুলের রাত। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহের ছগীরা, কবিরা গুনাহ মাফ করে দেন। কেয়ামতের দিন তাদের নিরাশ করেন না। কেবল মদ, গাজা, শরাব সেবনকারী হিংসুক, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, যেনাকারী, সুদখোর, বখীল ইত্যাদি- এই কিছু মানুষের দো’আ কবুল হবে না। হাদিস শরীফে আছে- হযরত আনাস ইবনে মালিক রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি ‘লাইলাতুল ক্বদর’ পেল কিন্তু ইবাদতের মাধ্যমে রাত কাটাতে পারলনা,তার মত হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই।” মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ থাকিতেন যাতে শবে ক্বদরের রাতটি হাতছাড়া হয়ে না যায়। [মুসলিম, হাদিস১১৬৭]
এই রজনীতে মুসলিম উম্মাহের সকলে মসজিদে গিয়ে ইবাদত বন্দেগী করেন। সকলে এশার নামায,তারাবির নামায আদায় করে ১২ রাকাআত নফল নামায আদায় করেন। বিশেষভাবে ‘লাইলাতুল ক্বদরের’ নিয়তে ৪/৬/৮/১২ রাকাআত নামায পড়া। নামাযের পর যিকির আযকার, মিলাদ পড়ে আখেরী মোনাজাত করা হয়। মোনাজাতে সকলের জন্য দো’আ করা হয়। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমি যদি লাইলাতুল ক্বদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি আল্লাহর কাছে কি দো’আ করব? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- তুমি বলবে ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া;ফাফু আন্নি। অর্থাৎ আপনি ক্ষমাশীল,ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।[ইবনে মাজাহ, সহিহ-আলবানি]
এই রজনীতে সকলে নফল নামায, যিকির আযকার, কোরআন তেলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল, কিয়ামুল লাইল, সালাতুত তাসবীহ, তাহাজ্জুদ নামায পড়ে রাত যাপন করেন। পিতা-মাতা, আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সব মুসলিমদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা, রোগমুক্তি কামনা করা, শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের জন্য এবং জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনায় দো’আ করা হয়। আল্লাহ আমাদের ইবাদত বন্দেগি করে পবিত্র মহমান্বিত রাত যাপন করার তাওফিক দান করুক। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফাযিল ৩য় বর্ষ, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসা
সারাবাংলা/এজেডএস