মুজিবনগর সরকার: মওলানা ভাসানী
১৭ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:৫২
১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিব নগর দিবস। এই দিনই মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১০ এপ্রিল এ সরকার গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ করা হয় ‘মুজিবনগর’। মুজিবনগর সরকারের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়েছিল বলে এ সরকার প্রবাসী মুজিবনগর সরকার হিসেবেও পরিচিত ছিল।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড তথা প্রধান নেতৃবৃন্দকে নিয়ে এই সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুক্তাঞ্চল বৈদ্যনাথতলায় সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এমএনএ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ। নবগঠিত সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে এখানে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সরকার গঠন এবং ১৭ এপ্রিল সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলেও মন্ত্রীদের মধ্যে দফতর বণ্টন হয় ১৮ এপ্রিল। মুজিবনগর সরকারকে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ভাগ করা হয়। এছাড়া কয়েকটি বিভাগ মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীন থাকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত সরকারের সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি (রাষ্ট্রপতি পাকিস্তানে অন্তরীণ থাকার কারণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের দায়িত্বপ্রাপ্ত), তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা, তথ্য, সম্প্রচার ও যোগাযোগ, অর্থনৈতিক বিষয়াবলি, পরিকল্পনা বিভাগ, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ, সংস্থাপন এবং অন্যান্য যেসব বিষয় কারও ওপর ন্যস্ত হয়নি তার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিষয়ক মন্ত্রী, এম মনসুর আলীকে অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক মন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয় বিষয়ক মন্ত্রী।
১৯৭১’র ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের জনগণের প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এই সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ প্রবল যুদ্ধে রূপ নেয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন ত্বরান্বিত হয়।
ভারতে অবস্থানকালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং তাজউদ্দীন আহমদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য দিল্লিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের কয়েক দফা বৈঠক হয় এবং তিনি তাদের বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার জন্য যেসব সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন তা বুঝিয়ে বলেন। এসময় তিনি উপলব্ধি করেন যে আওয়ামী লীগের একজন নেতা হিসেবে তিনি যদি সাক্ষাৎ করেন তবে সামান্য সহানুভূতি ও সমবেদনা ছাড়া তেমন কিছু আশা করা যায় না। সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐ সরকারের দৃঢ় সমর্থন ছাড়া বিশ্বের কোন দেশই বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। এছাড়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের আগের দিন এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান যে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কোনো সরকার গঠিত হয়েছে কিনা। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি রূপে নিজেকে তুলে ধরবেন। কারণ এতে ‘পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামকে সাহায্য করার জন্য ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়’ তা কার্যকর রূপ লাভ করতে পারে বলে তাজউদ্দীনের ধারনা হয়।
ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দীন জানান যে পাকিস্তানী আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ২৬ মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে সরকার গঠন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীই মন্ত্রীসভার সদস্য। শেখ মুজিবের গ্রেফতার ছাড়া তখন পর্যন্ত দলের অন্যান্য প্রবীণ নেতাকর্মীর খবর অজানা থাকায় সমাবেত দলীয় প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শক্রমে দিল্লীর উক্ত সভায় তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী রূপে তুলে ধরেন। ঐ বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, উপযুক্ত সময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে। এভাবেই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ধারনার সূচনা।
সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মুজিনগরে এ সময় সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য বামপন্থি দলগুলো চাপ সৃষ্টি করলে মওলানা ভাসানী স্বয়ং এগিয়ে এসে নজরুল-তাজউদ্দীন সরকারকে সেই চাপের হাত থেকে রক্ষা করেন। ফলে মওলানা ভাসানীকে চেয়ারম্যান করে ‘সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি’ গঠিত হয়। এ জন্যই গবেষকদের মতে, মওলানা ভাসানী ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রকৃত গার্ডিয়ান। (দৈনিক ইত্তেফাক ২৬/৩/২০০৩)।
এম এ মোহাইমেন লিখেছেন- ‘মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার জন্য বিরোধী দলগুলোর একান্ত চাপের মুখে তাজউদ্দীন সাহেব ও আওয়ামী লীগ নেতারা যখন খুব বিব্রতবোধ করছিলেন তখন সমস্যা সমাধান করতে এগিয়ে এলেন দেরাদুন থেকে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বিভিন্ন সময়ে বহুবিধ সংকটের সময় প্রবাসী সরকারকে তিনি মূল্যবান পরামর্শ ও সাহায্য দিয়ে নানাভাবে উপকৃত করেছিলেন।’ (ঢাকা আগরতলা মুজিবনগর)।
মুজিবনগরে প্রবাসী সরকারের অন্তর্দ্বন্দ্বের সময় মওলানা ভাসানী যদি বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে হাল না ধরতেন, সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা না দিতেন, সরকারের অভিভাবক হিসেবে কাজ না করতেন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা কি হতো তা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
আর এ জন্য এবিএম মূসা বলেছিলেন- ‘অথচ মওলানা ভাসানী না হলে আওয়ামী লীগ হতো না, বঙ্গবন্ধুর মতো একজন কালজয়ী নেতা তৈরি হতো না, এ দেশের মুক্তি সংগ্রাম হতো না, স্বাধীনতা যুদ্ধ হতো না, বাংলাদেশ নামক একটি দেশের জন্ম হতো না।’ (দৈনিক জনকণ্ঠ-২৩/১১/১৯৯৫)।
১৯৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কাগমারী সম্মেলনে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসমাবেশে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলেছিলেন- অনেক হয়েছে, তিক্ততা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন- নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নিতে। সত্তরের ৩০ নভেম্বর প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে যখন পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে লাখ লাখ লোক মারা যায় তখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেউ না আসাতে সরাসরি স্বাধীনতার আহ্বান মওলানাই প্রথম জানিয়েছিলেন।
এম আর আখতার মুকুল বলছেন- ‘১৯৭১ সালে ৯ মাসব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাঙালি জাতীয়তাবাদ শক্তির পক্ষে সক্রিয়ভাবে সমর্থন জুগিয়েছিলেন। এটাই হচ্ছে মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক ভূমিকা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস রচনার সময় আরও বিস্তারিতভাবে মওলানা সাহেবের ভূমিকার উল্লেখের প্রয়োজন অপরিহার্য বলা হয়। অন্যথায় স্বাধীনতার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।’ (দৈনিক ইত্তেফাক-২৬/০৩/২০০৩)।
দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও আবেগ দ্বারা তাড়িত না হয়ে মওলানা ভাসানীর অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন করে স্বাধীনতার ইতিহাসকে সম্পূর্ণ করতে বর্তমান প্রজন্ম এগিয়ে আসবে এটাই আজ জাতির প্রত্যাশা।
বাংলাদেশের ভূরাজনীতিতে সংযোজিত হলো ‘মুজিবনগর’ আর এর সরকার হলো ‘মুজিবনগর সরকার’। আকস্মিক নয়, আবেগে নয়, ১৭ এপ্রিলের হঠাৎ আবিষ্কার হিসেবেও নয়, ইতিহাসের পথপরিক্রমায় জন্ম হলো ‘মুজিবনগর’ আর ‘মুজিবনগর সরকার’র। এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
‘মুজিবনগর’ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী, আর এ সরকার স্বাধীন বাংলার প্রথম বৈধ, নিয়মতান্ত্রিক স্বাধীন সরকার। এ সরকার বিশ্বের অন্যতম সফলতম সরকার, যা তার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে একশ ভাগ সাফল্য অর্জন করেছে। বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে তাই ‘মুজিবনগর’ আর ‘মুজিবনগর সরকার’ থাকবে চির অম্লান।
লেখক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন
সারাবাংলা/এসবিডিই
এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া মুক্তমত মুজিবনগর সরকার: মওলানা ভাসানী