প্রজন্মের ‘ভাইরাল সংস্কৃতি’ ও এর নেতিবাচক প্রভাব
১৬ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৩৪
অতি সম্প্রতি রাজউক স্কুল এন্ড কলেজের এক শিক্ষকের সাথে স্কুলের এক ছাত্রীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু অশালীন কথোপকথনের স্ক্রিনশর্ট ও ভিডিও ভাইরাল হয়। যা নিয়ে সরগরম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিষয়টি আমার জানা ছিল না, কিছুক্ষণ আগে এক শুভাকাঙ্ক্ষী ইনবক্সে সেসবের ছবি পাঠিয়ে এ নিয়ে লিখতে বললেন।
আমি বিস্তারিত সেসব দেখতে গিয়ে অশ্লীল ও অশালীনতার তীব্রতায় পুরোপুরি দেখতে পারিনি। তবে বুঝেছি কাহিনি কী! কিন্তু এটার এতই নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে যে কিছু না লিখে পারা যাচ্ছে না।
শিক্ষক ও ছাত্রীর প্রেম এবং তা থেকে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, ইনবক্সে ব্যক্তিগত কথোপকথন, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও ভাইরাল—শেষমেশ সেসব নেটদুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার ফলাফল বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। জানা যায়, তৃতীয় কোন পক্ষ মেয়েটির আইডি হ্যাক করে বা যেকোনভাবে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের সেসব স্ক্রিনশট ভাইরাল করে। মুহূর্তে সেটা হুঁ হুঁ করে ছড়িয়ে পড়ে নেটদুনিয়ায়। এখানে প্রেম থেকে শুরু করে শারীরিক সম্পর্ক, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কথোপকথন—এসবে শিক্ষকের দোষ নাকি ছাত্রীর দোষ সেদিকে আমি যাবো না। কারণ, উভয়ের সম্মতিতেই সেসব হয়েছে। এককভাবে এখানে কাউকে দোষারোপ করার সুযোগ নেই। কিন্তু নৈতিকতার জায়গায় প্রশ্ন তুললে—এখানে ওই শিক্ষকের ওপর প্রশ্ন তোলা যায়, কেননা মেয়েটি বয়সে অপেক্ষাকৃত তার চেয়ে ছোট এবং অন্যদিকে তার ছাত্রী। কিন্তু জৈবিক চাহিদার জায়গায় সে শিক্ষক নিজেকে দমাতে পারেননি। শিক্ষক হিসেবে সেদিক থেকে সে কুলাঙ্গার ও কলঙ্কের ভাগীদার।
এখন প্রশ্ন হলো, সেসব নেটদুনিয়ায় শেয়ার দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে কী লাভ রয়েছে। আদতে লাভ বলতে কিছুই নেই। যারা শেয়ার দিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তারা শ্রেফ মজা বা আনন্দ নেওয়ার জন্যই সেটা করছেন। এবং সেটা করছেন ইয়াং জেনারেশনরাই। কিন্তু এটা একধরনের ক্রাইম। কেননা এটির মধ্য দিয়ে দুইজনের মানসিকভাবে এবং সামাজিকভাবে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। বর্তমানে ঘটনার প্রেক্ষাপটে দুইজনের মানসিক অবস্থা কোন পর্যায়ে সেটা সহজেই অনুমেয়। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার ফলে দুইজনের পরিবারই সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে। জানা গেল, এ ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর থেকে মেয়েটির খোঁজ মিলছে না। হয়তো সে আত্মহত্যা করবে না হয় ফিরে আসবে। কিন্তু যা(র)দের কারণে বা যে ঘটনার প্রেক্ষিতে সে আত্মহত্যা করবে—সেটার দায় কে নেবে? আর ফিরে এলেও সমাজের চোখে সে কী করে তাকাবে!
যারা সেসব ব্যক্তিগত বিষয়ের স্ক্যান্ডাল স্ক্রিনশট শেয়ার দিয়ে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা কী নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে মুহূর্তের জন্য সেটা চিন্তা করছে—যদি আমার বেলায় তা ঘটতো!
আমাদের চারিদিকে অসভ্যতা ভয়ানকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠছে। একটা অসভ্য, নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত ও মেরুদন্ডহীন প্রজন্ম গড়ে ওঠছে। মানুষের ব্যক্তিগত নেতিবাচক বিষয় নিয়ে এরা মাতামাতি করে, ভাইরাল করে এক ধরনের অদ্ভুত আনন্দ পায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেখান থেকে তারা কেউ শিক্ষা নেয় না।
মানুষের ব্যক্তিগত নেতিবাচক বিষয়ের ওপর এদের সার্বক্ষণিক নজর—কখন ভাইরাল করবে। কিন্তু একটা ভালো বিষয়, ইতিবাচক বিষয় নিয়ে তারা মাতামাতি করে না, ভাইরাল করে না। অথচ সমাজে, রাষ্ট্রে, চারপাশে ভাইরাল করার হাজারো ইতিবাচক বিষয় রয়েছে—যেগুলো ভাইরাল হলে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই উপকৃত হতে পারে। কিন্তু তা হতে দেখা যায় না। আমাদের প্রজন্মের মাঝে কি আদৌ বোধশক্তি জাগ্রত হবে?
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস