ভোক্তা অধিকার রক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা
১৭ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:৪২
বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকই ভোক্তা। এমনকি যে শিশুটি মায়ের গর্ভে এখন আছে, সেই শিশুটিও একজন সম্মানিত ভোক্তা। সুতরাং মায়ের গর্ভের শিশুটিসহ আমাদের দেশের ভোক্তার সংখ্যা জনসংখ্যারও বেশি। মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে ভোক্তা অধিকার অন্যতম। যদিও দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে বেশকিছু আইন রয়েছে কিন্তু নিজেদের অধিকার ও আইন সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হতে হচ্ছে। ভোক্তা অধিকার আইন সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক যোগাযোগ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা প্রচার করতে হবে, পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকে আইনটি অন্তর্ভুক্ত করে এর গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশের ক্রেতা ভোক্তাদের সচেতনতার জন্য সরকারী বেসরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। বাংলাদেশের ক্রেতা সাধারণের অধিকার নিশ্চিত করার দাবী ও দীর্ঘদিনের। কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ও অন্যান্য সংগঠন বাংলাদেশের ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করার জন্য দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে সরকার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন আইনে ২০০৯ প্রণয়ন করে। সাধারণভাবে বলতে গেলে সকল মানুষই ভোক্তা। তবে ধনী বা স্বচ্ছল ভোক্তাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে পণ্যের গুনগতমান এবং গরীবদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ে। ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য যদি আইনের বাস্তবায়ন থাকে এবং ভোক্তারা যদি সচেতন থাকেন তাহলে সকল স্তরের ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষার একটি সুযোগ থাকে। যে কোন মানুষই কোন না কোন পণ্য ক্রয় করে থাকে। সে অর্থে সব মানুষই ভোক্তা। পণ্য কিনে কেউ যাতে প্রতারিত না হয়, সে জন্য বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন জরুরী। যে কোনো আইনের যথাযথ প্রয়োগ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেমন উদ্যোগ গ্রহন জরুরী তেমনি আইন ও অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগ গ্রহন আরও বেশী জরুরী। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষনে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয়। গণমাধ্যমের অসাধারণ ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের ভোক্তাগন ভেজাল সচেতন হচ্ছেন। দিন দিন আমাদের দেশে খাদ্য ভেজালের প্রবণতা বেড়েই চলছে। বর্তমানে খাদ্যে ভেজাল এমন পর্যায়ে রয়েছে ভেজালমুক্ত খাবার এবং অন্য কোন পণ্য ভেজালমুক্ত পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে পণ্য বা সেবা ক্রয়ে দূরদর্শিতা প্রয়োগ করতে হবে এবং কোনোভাবে প্রতারণার সম্মুখীন হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত কিংবা সরাসরি ফোনের মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে হবে। ভোক্তা ও সচেতন নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে দেশ থেকে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
ভোক্তা অধিকার কি তা জানতে হলে, ভোক্তা কে তা জানতে হবে। ভোক্তা হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি টাকার বিনিময়ে কোন কিছু জিনিসপত্র ক্রয় করেন বা সেবা ক্রয় করেন। কোন ভোক্তা কোন সেবা বা কোন পণ্য বা জিনিস ক্রয় করার সময় প্রতারিত হলে তার অধিকার লঙ্ঘিত হয়। সুতরাং ভোক্তা হিসেবে যেসব অধিকার পাওয়া যায়, সে অধিকারগুলি হল ভোক্তা অধিকার। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একজন ব্যবসায়ী নিজেও ভোক্তা, কারণ তিনি নিজেও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা ক্রয় করে থাকেন। নিজ নাম, পিতা-মাতার নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা এবং অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানা লিখে ডাকযোগে বা কুরিয়ার যোগে বা ই-মেইলের মাধ্যমে অভিযোগ করতে পারেন। অভিযোগ করার সময় অবশ্যই প্রমাণ হিসাবে পণ্য ক্রয়ের রশিদ বা ভিডিও সংযুক্ত করতে হবে।
রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকই ভোক্তা। একজন ভোক্তা হিসেবে রয়েছে তার ‘ভোক্তা অধিকার’। কিন্তু ভোক্তার অধিকার কী, প্রতারিত হলে কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে, তা জানেনই না ভোক্তা নিজে। সময়ে অসময়ে আমাদের বাধ্য হয়ে বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়। ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি দেশের খুচরা বাজারগুলোতে। আবার কখনো কখনো মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য কিনেও বিড়ম্বিত হই, পণ্য ফিরত দিতে জড়াতে হয় অনেক বাক-বিতর্কে। নিরাপদ এবং ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারাটা ভোক্তার অধিকার এবং তা আইন দ্বারা সংরক্ষিত। বিক্রেতারা যাতে কোনোভাবেই ক্রেতাদের ধোঁকা দিতে বা ঠকাতে না পারেন, সে লক্ষ্যেই ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণ এবং তাদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে সংসদ কর্তৃক গৃহীত ‘ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ ২০০৯’ আইনটি ২০০৯ সালের ৫ এপ্রিল অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তবে এটা সত্য যে, আইনটি প্রণয়নের ফলে জনগণ এর সুফল কিছু কিছু ক্ষেত্রে অল্প-বিস্তর হলেও পেয়েছে। পাশাপাশি অনেক প্রতিষ্ঠানও আগের থেকে অনেক সতর্ক হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রচারের কারনে এই আইনের প্রয়োগ ঘটেছে , এটা কিছুটা চোখে পড়েছে। এর মূলে রয়েছে আইনটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সচেতনতা ।
অশিক্ষিত থেকে শুরু করে শিক্ষিত শ্রেণিও ‘ভোক্তা অধিকার আইন’ সম্পর্কে তেমনভাবে অবগত নন। গণমাধ্যম গুলোর পক্ষে এ নিয়ে পূর্বে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। ফলে এই আইনের সুফল পাচ্ছে না সাধারণ ক্রেতারাও। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভোক্তা আইন এতটা সক্রিয় যেখানে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন করা কল্পনাতীত। এই আইনে ভেজাল বা প্রতারণা করলে লাইসেন্স বাতিলসহ ফৌজদারি আইনে দণ্ড দেওয়ার বিধান রাখার পাশাপাশি এই আইন লঙ্ঘনে অর্থ জরিমানা ও কারাদণ্ডসহ উভয় দণ্ডের বিধানও রয়েছে। তাই আইনের সুফল ভোগ করার জন্য নাগরিককেই সচেতন হতে হয়, তা না হলে অসাধু শ্রেণি অন্যায়ভাবে সুবিধা নেবে এটাই স্বাভাবিক।
শুধু আইন এবং ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর নয়, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান গুলো কে শহরগুলোতে প্রতিনিয়ত করতে হবে সচেতনতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক ক্যাম্পেইনিং। সেইসঙ্গে ইউনিয়ন পর্যায়ে আয়োজন করতে হবে প্রচারণা কিংবা পথনাট্য, যাতে করে প্রতিটি নাগরিক একজন ভোক্তা হিসেবে এই মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়। কাজেই ভোক্তা অধিকার নিশ্চিতকরণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে একই সাথে কাজ করতে হবে।
গণমাধ্যমকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। একটি সমাজে যতগুলো অপরাধ সংঘটিত হয় তার মধ্যে ভোক্তার অধিকারগুলোর লংঘন অন্যতম। গণমাধ্যমগুলো ভোক্তাদেরকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নিতে পারে:
* প্রিন্ট মিডিয়া ভোক্তা অধিকার আইন সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
* একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রিন্ট/ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো টকশোর আয়োজন করতে পারে।
* রেডিওগুলো ভোক্তাদের সচেতন করার জন্য মাঝে মাঝে বুলেটিন প্রকাশ করতে পারে।
* বেসরকারি ও সরকারি টেলিভিশন গুলো ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাজগুলো প্রচারের মাধ্যমে ভোক্তাদেরকে আরো দায়িত্বশীল হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। বিশেষ করে কোন ভোক্তা যদি ভোক্তা -অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন এবং অভিযোগটি প্রমাণিত হলে জরিমানার যে ২৫ শতাংশ অর্থ পান তা ব্যাপকহারে প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে।
ভোক্তা অধিকার একটি নাগরিক অধিকার। ভোক্তা অধিকার কারো দয়া বা করুণার বিষয় নয়। বাংলাদেশের সকল ভোক্তার অধিকার সুনিশ্চিত করতে হলে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মী, অভিভাবক সকলকে গণসচেতনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে সরকার ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারে:
১) জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে হবে।
২) জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
৩) ভোক্তা অধিদপ্তরে পর্যাপ্ত পরিমাণ মানবসম্পদ নিয়োগ করতে হবে। নিয়োজিত কর্মীদের দেশে ও বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪) ভোক্তা অধিকারের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে।
৫) স্কুল -কলেজের পাঠ্য বইয়ে ভোক্তা অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে পড়াতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের গণমাধ্যম যথার্থ অর্থেই সর্বস্তরের সচেতন ভোক্তাদের নির্ভরযোগ্য জায়গা । ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে গত দেড়শ বছরে বাঙালীর যা অর্জন তার বেশীর ভাগই সংবাদপত্রের অবদান। মানুষের অধিকার রক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকাই মূখ্য । গণমাধ্যমও আজ জাতির অতন্দ্র প্রহরী। যখন অন্যায়কারীকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না তখনও গণমাধ্যমই জনগণের একমাত্র ভরসার জায়গা। বাংলাদেশ মানবসম্পদ সূচকে ভারত ও পাকিস্তান থেকে এগিয়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের করা নতুন এক সূচক অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলংকা ও নেপাল ছাড়া সবার চেয়ে ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ রয়েছে । বিশ্বব্যাংকের ১৫৭টি সদস্য রাষ্ট্রের ওপর জরিপ করে এই তালিকাটি করা হয়েছে। এতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বেঁচে থাকার অনুষঙ্গগুলো বিবেচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের এই এগিয়ে যাওয়ার ধারাকে বেগবান করতে হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষনে ব্যাপক হারে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ বাড়াতে হবে।এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য গণমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকার কোন বিকল্প নেই।
সারাবাংলা/এসবিডিই