Thursday 28 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পারিবারিক লাইব্রেরি: আমাদের হারানো ঐতিহ্য

অলোক আচার্য
৩০ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:২২

লাইব্রেরি শব্দটি দ্বারা এমন একটি স্থান বোঝায় যেখানে প্রচুর সংখ্যক বই থাকে। তা সে বিক্রির জন্যই হোক আর বিনে পয়সায় পড়ার জন্যই হোক। তবে বিনে পয়সায় পড়া যায় এমন স্থানকে পাবলিক লাইব্রেরি বলে। আজকাল এই পাবলিকের পড়ার জন্য তেমন স্থান দেখা যায় না। তবে বই বিক্রির জন্য বহু লাইব্রেরি অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে। বই পড়া শব্দদ্বয় দ্বারা প্রকৃতপক্ষে কয়েকটি বিষয় বোঝানো হয়। সেগুলো হলো আমাদের পাঠ্যবই যা ছাত্রাবস্থায় পড়ি, অন্যটি হলো চাকরির বই পড়া এবং সর্বশেষ বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ বা এ জাতীয় বই পড়া যেখানে আসলে বিনোদন নেওয়া ছাড়া বা মানসিক পরিতৃপ্তির বিষয় ছাড়া কোনো উদ্দেশ্য নেই। এবং এটাই হলো প্রকৃত বই পড়া। বই পড়া বলতে এই লাভহীনভাবে বইয়ের সাথে সময় কাটানোকে বোঝায়। যেমনটা আজকাল আমরা মোবাইল গেমস বা আড্ডায় সময় ব্যয় করছি, সেরকম। মূলত বই পড়ার উদ্দেশ্য আত্নার খোরাক মেটানো।

বিজ্ঞাপন

এখন বিতর্ক হলো বই পড়ার প্রবণতা কি কমে যাচ্ছে? এই প্রশ্ন সামনে আসলে বলতে হয় যে আমাদের বর্তমান সমাজে বই পড়ার সুযোগ কতখানি? অর্থাৎ আমাদের বর্তমান প্রজন্ম চাইলেই বই হাতের কাছে পায় না। যদি লক্ষ্য করি দেখি যে কম উপজেলায় অথবা একটি ইউনিয়নে সাধারণত এমন কোনো পাবলিক লাইব্রেরি থাকে যেখানে উঠতি প্রজন্ম বা অবসরে বই পড়তে ভালোবাসেন এমন কেউ কিছুক্ষণ বসে নির্বিঘেœ বই পড়তে পারে। অথচ পাড়ার অলিতে গলিতে মোবাইল ফোনের দোকান, ঘরে ঘরে ওয়াই-ফাই সংযোগ এবং চোখ আটকে থাকছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অথবা মোবাইল গেমসে। কেটে যাচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা সময়। এই যে একটি ইউনিয়নেও একটি চমৎকার পাবলিক লাইব্রেরি থাকে না এই দায় কার? আমরা একটি বই পড়া প্রজন্ম তৈরির চেষ্টা করছি। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব সেই সমাধান নেই। এখানে আরো একটি প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো পারিবারিক লাইব্রেরি। এই দেশেই একটা সময় ছিল যখন প্রায় প্রতিটি সৌখিন বাড়িতেই একটি পারিবারিক লাইব্রেরি থাকতো। সেই লাইব্রেরিতে প্রচুর বইয়ের সংগ্রহ ছিল।

বিজ্ঞাপন

বই পড়ুয়া একটি প্রজন্মই ছিল যারা বই পড়াটাকে সত্যিকার অর্থেই শখ হিসেবে নিয়েছিল। একটি পারিবারিক লাইব্রেরি বই পড়া জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিটি ভালো অভ্যাসই গড়ে ওঠা উচিত নিজের পরিবার থেকে। যদি পরিবার থেকে অভ্যাস গড়ে না ওঠে তাহলে পরবর্তীতে সেই অভ্যাস গড়ে উঠবে এমন আশা করা ঠিক না। যদিও হয় তা হবে একটি অতিরিক্ত পাওনা। কথায় বলে দেখায় শিক্ষা আর নাচনে বিদ্যা। পরিবারের সদস্যদের বই পড়া দেখে দেখে বড় হওয়া একটি শিশুর মনে কৌতুহল থাকা স্বাভাবিক। সে কৌতুহল বশে হলেও বই হাতে নিবে এবং পড়বে। একসময় কোনো একটি বই বা কোনো সিরিজের অথবা কোনো লেখকের বই তারা ভালো লেগে যাবে। সে সেসব বই কিনবে এবং গোগ্রাসে পড়বে। আর যদি তা না দেখে সে তার পরিবারের সদস্যদের সারাক্ষণ মোবাইল, ট্যাবলেট ইত্যাদি নিয়ে সময় কাটাতে দেখে তাহলে স্বাভাবিকভাবে সে ঐ অভ্যাসেই গড়ে উঠবে। এতে শিশুর দোষ দেওয়া ঠিক না। যেমন দেখবে তেমন শিখবে। পরে কপাল চাপড়ে কোনো লাভ নেই। যদি বই পড়া একটি আন্দোলন হিসেবে ধরে নেওয়া যায় তাহলে ঘর থেকেই সেই আন্দোলন শুরু করতে হবে। অথচ আজ অবস্থা এমন যে একটি সাধারণ আয়ের পরিবারেও একাধিক এন্ড্রয়েট মোবাইল ফোন, তারও বেশি মোবাইল সিম, টেলিভিশন, ফ্রিজ অর্থাৎ সবকিছু থাকলেও একটি সামান্য সংখ্যক বই নিয়ে ছোট আলমারিও নেই। স্কুল-কলেজের বই পাওয়া যাবে সঙ্গত কারণেই। কিন্তু বই পড়া বলতে যা বোঝায় সেই পাঠ্যসূচির বাইরের বই পাওয়া যাবে না। আবার নিজের সন্তানকে জন্মদিন বা অন্য কোনো উৎসবে একটি বই কিনে দেয় এমন কোনো অভিভাবকও আজ দুর্লভ। এর চেয়ে ঢের দামী উপহার দিলেও সেই তালিকায় বই থাকে না। ফলে যা হওয়ার সেটাই হচ্ছে। সন্তান স্কুল-কলেজের বইয়ের বাইরেও যে বই পড়া যায় বা চাকরির বইয়ের বাইরেও বই আছে সেই উৎসাহই আর জাগে না। পারিবারিক লাইব্রেরির চর্চা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রতিটি পরিবার হলো নৈতিকতা শিক্ষার ভিত্তিভূমি।

শিশুকাল থেকেই চাইলেই বই পড়ার প্রতি উৎসাহিত করা সম্ভব। ঘরের এক কোণে যদি একটি আলমারিতে বইয়ের সংগ্রহ রাখা হয় এবং সেখান থেকে অভিভাবক নিজেও বই পড়েন এবং সন্তানকে বই পড়তে উৎসাহিত করেন তাহলে অবশ্যই সেই পরিবারের সন্তানদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে। ”বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না”- বই পড়া নিয়ে প্রমথ চৌধুরির এই উক্তিটি বইয়ের চিরন্তন গ্রহণযোগ্যতাকে প্রকাশ করে। তবে আজকাল বইয়ের খরচও বেড়ে গেছে এ সত্য কথা অস্বীকার করারও উপায় নেই। মানুষের প্রকৃত বন্ধু হয়ে সেই তখন থেকে বই সাথে রয়েছে। মানুষও সার্বক্ষণিকভাবে বই সাথে রেখেছে। বাসে, ট্রেনে বই পড়তে পড়তে ভ্রমণ করা মানুষের দেখা পাওয়া যায়। যদিও আজ সে দৃশ্য প্রায় অপ্রতুল। তেমনি আজকের প্রজন্মও আর বইপ্রেমি হিসেবে গড়ে উঠছে না। আমরা যতই চিৎকার করি লাভ হবে না। কারণ পরিবারেই সেই চর্চা নেই। জাতি হিসেবে আমরা যত আবেগপ্রবণ ঠিক ততটাই বেহিসেবী। আজ আমরা বুঝতে পারছি যে এই প্রজন্ম ক্রমেই বই পড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং এ নিয়ে কম-বেশি আলোচনাও চোখে পরে কিন্তু কাজের কাজটা খুব একটা হচ্ছে না। অর্থাৎ পারিবারিকভাবে বই পড়া আন্দোলন শুরু হচ্ছে না। সেই বই পড়ার অতীত ফিরিয়ে আনতে পারিবারিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটি পরিবারে বই হবে উপহারের বস্তু। শিশুর জন্মদিনে আপনি অন্যসব বাদ দিয়ে বই দিন। তারপর তা আপনার বাড়ির লাইব্রেরিতে রাখুন। শিশুকে বইটি পড়তে উৎসাহিত করুন। একদিন দেখবেন সে আপনাকে দেখে ঠিকই বই পড়তে উৎসাহিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি পরিবার থেকে বই পড়া আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এজেডএস

অলোক আচার্য পারিবারিক লাইব্রেরি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর