মে দিবস এবং বাংলাদেশ
৩০ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:৩৪
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রম শোষণ সকল সময়েই বিদ্যমান। শিল্প বিপ্লবের ফলে শ্রমিকের উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যায়। শ্রমিকদের কারখানার অসাস্থ্যকর ও অনিরাপদ পরিবেশে ১০-১৬ ঘন্টা কাজ করতে হতো। যেখানে ক্ষত, পঙ্গু ও মৃত্যু ছিল খুবই স্বাভাবিক যার লোমহর্ষক বর্ণনা পাওয়া যায় উপ্টন সিনক্লেয়ারের “দি জাঙ্গল” এবং জ্যাক লন্ডন্সের “দি আয়রন হিল” বই দুটিতে। শ্রমঘন্টা হ্রাসের আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৮৬০-এর দশকে যার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ১৮৮৬ সালে হলেও আজ ও চলছে আমাদের সংগ্রাম। “ফেডারেশন অব অরগানাইজড ট্রেডস এন্ড লেবার ইউনিয়ন” শিকাগো জাতীয় সম্মেলন ১৮৮৪-এ সর্বপ্রথম ১লা মে, ১৮৮৬ সাল বা এর পর থেকে ৮ ঘন্টা কাজ করার আইন পাশের দাবি জানায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, যে কোন মুল্যে এমনকি শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও ৮ ঘন্টা কাজ করার অধিকার আদায়ের জন্য শিকাগো শহরের হে মার্কেটের সামনে সমবেত হয় লাখো শ্রমিক। একই দিনে, এই দাবির সমর্থনে আমেরিকাতে প্রায় তিন লাখের বেশি শ্রমিক কর্ম বিরতি দেয়। শ্রমিকদের প্রতিরোধ করতে সরকার ও ব্যবসায়ীরা ভয়ে শ্রমিকদের পুলিশ দিয়ে ঘিরে ফেলে। পুলিশ শ্রমিকদের গুলি করার সুযোগ তৈরি করতে নিজেদেরই কাউকে দিয়ে পুলিশের উপর বোমা নিক্ষেপ করে এবং তৎক্ষনাত শ্রমিকদের উপর গুলি বর্ষণ করে। যাতে একজন পুলিশ সদস্যসহ ৮-১০ শ্রমিক নিহত এবং অনেকেই আহত হয়। দাবি মেনে নিলেও নেতৃত্ত্বস্থানীয় আট জনকে নৈরাজ্যকারী আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় যাদের মধ্যে আলবার্ট পারসন্স, অগাস্ট স্পাইস, জর্জ এঙ্গেল ও এডলফ ফিশারকে ১১ই নভেম্বর, ১৮৮৭ সালে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। হাসি মুখে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে ৮ ঘন্টা কাজ করার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে শ্রমিকদের নির্যাতন আর বঞ্চনার কথা। এ রাষ্ট্রে শ্রমিকদের গার্মেন্টস এর ভিতরে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দেয় মেইন গেইটে, অবর্ণনীয় কষ্টকর পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে রেখে শ্রমিকদের খাটানো হয়, নিয়োগপত্রহীন-মনুষ্যোচিত বাঁচার মতো মজুরী ব্যতীত ১৪ থেকে ১৬ ঘন্টা বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করতে বাধ্য করা হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ১,৫০০ শ্রমিক মারা গেছে, ২৫০ এর বেশি ঘটেছে দুর্ঘটনা যার মধ্যে ৮০টি বড়। হত্যালীলা চলছে বিগত ৪২ বছর ধরে। শ্রমিক মরছে আগুনে পুড়ে বা পদদলিত হয়ে বা বিল্ডিং ভেঙ্গে – একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে। কিন্তু কেন? কারণ এই সব ঘটনার পেছনে যারা আছেন, তাদের কোন বিচার নেই। আইনের শাসন তো থাকতে হবে। ২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল সাভারের স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ভবন ধ্বসে প্রায় ৮০ জন মারা যায়। ভবন ধ্বসের ঘটনায় হাইকোর্টের জারি করা রুলের জবাব দীর্ঘ আট বছরে দেয়নি সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা। ওই ঘটনায় সরকারের তদন্ত রিপোর্টও আদালতে দাখিল করা হয়নি। ২০১২ সালে তাজরিন ফ্যাশনস লিমিটেড নামের ওই কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ২০০ এর বেশি শ্রমিক, আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে অনেককে। কিন্তু কারো বিচার হয়েছে কি তাজরিন ফ্যাশন লিমিটেড এর মালিক পক্ষীয়দের? ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের জীবন এবং ভাগ্যও রয়ে গেছে দূর্ঘটনার মতই বিশ্রী এবং শোচনীয় অবস্থাতেই। ঘটে গেলো সাভার ট্রাজেডী, লাশ হলো প্রায় পাঁচশ নিরীহ শ্রমিক, আহত হাজারের মত! এই অবর্ণনীয় ক্ষয়-ক্ষতির কি কোন পূরণ সম্ভব হবে? কখনই সম্ভব নয়। যারা শারীরিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই বরণ করে নিয়েছেন মানসিক ভারসাম্যহীনতাকেও।
রাষ্ট্রীয় শাসক এবং মালিকদের শোষণের ইতিহাস এখনও বদলায়নি এই বাংলাদেশে। মে দিবসকে ঘোষণ করা হয়েছিলো রক্তাক্ত অগ্নি শপথের দিন হিসাবে – বলা হয় এই দিবসই শ্রমজীবি মানুষের নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের এক রক্তাক্ত ফসল। কিন্তু সে ফসল আবাদ কি ভোগ করতে পারছে বাংলাদেশের শ্রমজীবি মানুষজন? এই প্রশ্নের পরেও প্রশ্ন থাকে ১ মে দিবসের বিপ্লব এবং চেতনা কি ডুকরে কেঁদে ওঠে না আমাদের দেশের দুর্ঘটনায় কবলিত হতাভাগা শ্রমিকদের লাশ এবং রক্তের মধ্যে?
১৮৮৬ সালকে ভিত্তি ধরলে ১ মে ২০২৩ হবে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবসের ১৩৭ বছর। এ সময়ে পৃথিবীতে অনেক বড় বড় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মানুষের সামাজিক অগ্রযাত্রায় অনেক অর্জন ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আজ স্বীকৃত মানবাধিকার। মে দিবসের প্রধান দাবী আট ঘন্টা কাজ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আইন কে বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং শ্রমিকের মৌলিক অধিকার, যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কাজের নিশ্চয়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তা করাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। শ্রম আইনে শ্রমিকওে আট ঘন্টা কাজ, বিশ্রাম, ছুটিসহ অন্যান্য অধিকারকে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের আলোকে নিশ্চিত করা হয়েছে, যা ছিল মে দিবসের আন্দোলনকারী শ্রমিকগণের প্রধান দাবী। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই যে, এত সব অর্জনের পরেও সামগ্রিক লক্ষ্য অর্জনে এখনও অনেক পথ বাকি আছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে এমন অনেক পেশা রয়েছে যেখানে লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ এখনও মে দিবসের পূর্বের জমানায় রয়ে গেছে।
লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এজেডএস