সৃজনশীল স্বপ্ন দেখুন এবং তার বাস্তবায়ন করুণ!
২ মে ২০২৩ ১৪:৫০
জানেন বাংলাদেশের একটি নদী, নাম তার নবগঙ্গা। সে আজও বয়ে চলেছে তবে গতিহীনভাবে, যার ফলে কচুরিপানায় সে নদী এখন ভরপুর। স্থানীয় মানুষ এখন আর নৌকায় করে নদী পার হতে পারছে না। এই নদীটিকে সংরক্ষণ করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে বলেছি – এটাই আমার অপরাধ। নদী সংরক্ষণ হোক এটা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই, তবে মাথা ব্যথা আমি বিদেশে থাকি, আমি কেন এটা নিয়ে কথা বলছি? অনেক কষ্টে একটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে একজন মুমূর্ষ রোগীকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানালেন, রোগীকে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখতে হবে। কিন্তু হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি নেই। অতি সাধারণ মানুষগুলো বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে, সমস্যা নেই। সমস্যা আমি দূরপরবাসে থাকি, আমি কেন তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি? নিশ্চয়ই রাজনীতি করবো, এটাই অনেকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ঊর্ধ্বতন প্রশাসন মহলে একই কথা। উনিও কি রাজনীতি করবেন?
এ ধরনের ভাবনা আসবেই বা না কেন! মনে কি পড়ে সিলেটের সেই ব্যারিস্টার মি. সুমন যখন জন এবং গণদরদী হয়ে উঠেছিলেন, তিনি রাস্তাঘাটের ময়লা নিয়ে কথা বলতেন। সবাই কিন্তু মানুষটাকে বেশ ভালোভাবে নিয়েছিল। কী দাঁড়ালো পরে? তিনি ঘোষণা দিলেন তিনি নৌকার মাঝি হতে চান, গেল বারোটা বেজে। দেশের যে পরিস্থিতি তাতে করে আমি চিৎকার করে বলতে চাই যেখানে বেশিরভাগ মানুষ দুর্নীতি এবং অনীতিকে মনের মাঝে নীতিতে পরিণত করেছে সেখানে কী করে ভাবা যায় কোনো ন্যায়-নীতি সেখানে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে বা সৎ লোকের জায়গা হতে পারে?
দেশে সহজ এবং সরল পথে চলে এদের সংখ্যা কত জন তা আমি জানিনে তবে যদি কেউ মনে করেন আমার কোনো শত্রু নেই তবে ধরে নিতে হবে সে ব্যক্তি কোনো প্রতিবাদ করেন না। এমন একটি দেশে কোনো ভালো লোক জনগণের ভোটে পাশ করবে এ ধারণাটা থাকা আহাম্মকের পরিচয় মাত্র।
যাইহোক আমি দেশ ছেড়েছি প্রায় চল্লিশ বছর আগে। আমি লং ডিসটান্স ম্যানেজমেন্টে আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাজ করে অভ্যস্ত। বাংলাদেশের জন্য আমি যাই করিনা কেন সেটা দূর থেকে করি। এতে করে কাজগুলো সাফল্যের সঙ্গে করা যায় একই সাথে আমি মনে করি দেশের সেবা করতে দায়িত্ব পেতে হবে এটা আমি বিশ্বাস করিনে। কারণ দায়িত্ব, কর্তব্য এগুলো পালন করা কেবলই আমার বিবেকের তাড়নায়। কারণ আমি হাসতে পারি, আমি কাঁদতে পারি, আমার অনুভূতি আছে, আমি বিপদে, আপদে, ভালো বা মন্দ সময়ে অন্যান্য প্রাণীর পাশে দাঁড়াতে পারি। আমি যে মানুষ, নিজের কাছে সেটা প্রমাণ করতেই আমি মানুষের জন্য কাজ করি। রাজনৈতিক বা অন্য কোনো স্বার্থ হাসিল আমার লক্ষ্য নয়। তবে রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি, লাখোপতি, কোটিপতি, পুঁজিপতি, সভাপতি এসব পদবি অর্জন করতে কিন্তু অনেক স্বপ্ন, অনেক ত্যাগ, অনেক সাধনা, অনেক চেষ্টা, অনেক সময় বর্জন করতে হয়। সবাই কম বেশি জীবনের শুরুতে কিছু না কিছু হতে চায়। কেউ সেটা হয় কেউ হতে পারেনা। আমার বিশ্বাস শুরুতে সবারই একটি সৎ উদ্দেশ্য থাকে। সৎ উদ্দেশ্যের এই যাত্রা জ্ঞাত বা অজ্ঞাত অবস্থাতে যদি সেটা অসৎ উদ্দেশ্যে পরিণত হয় তখন সে ক্ষতি সামলাতে হয় সমাজের সাধারণ মানুষের। কারণ এ সকল অসৎ ‘পতিরা’ যখন ক্ষতি করা শুরু করে তখন সাধারণ মানুষের বেচেঁ থাকা দায় হয়ে পড়ে। এমনটি যদি একটি সমাজ বা দেশে সত্যিই হয় তখন কী হবে উপায়? জানতে মন চায়। এই জানতে চাওয়াটা একজন নাগরিকের অধিকার। আমি যখন এই চাওয়া পাওয়া থেকে বঞ্চিত তখন ধরে নিতে হবে জাতি হিসেবে আমার গর্ব করার আর কিছু নেই। আমি তখন স্রষ্টার শরণাপন্ন হই। হে মহান, তোমার শক্তি কত তা বুঝার ক্ষমতা কিছুটা থাকলেও বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই তবে গ্রাভিডি সম্পর্কে যতটুকু বুঝতে শিখেছি তাতে মনের মধ্যে যে চেতনা জেগেছে সেটাও বর্ণনা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। তুমি তোমার ওয়াদা পুরণ করে চলেছ। প্রতিদিনই সূর্য উদয় এবং অস্ত যাচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে নিশ্বাস নিতে যে পরিমাণ অক্সিজেনের দরকার তা না চাইতেই পাচ্ছি। তাহলে আমি কেন আমার নাগরিকের অধিকার থেকে বঞ্চিত? আমরা মানুষ জাতি শপথের বাণীতেও মিথ্যা কথা বলি। সমাজ আমাকে জ্ঞানের উপদেশ দিবে, তুমি ভুলে যেও না, মনের কথা বলতে, তুমি ভয় পেয়ো না, সত্য কথা বলতে। কোটিপতি হতে হবে এমন কথা নয়, থাকো যদি তুমি সর্বক্ষণ সত্য পথে আর কী চাই ইত্যাদি।
যদি প্রশ্ন করি, স্বপ্ন যখন দেখেছিলেন রাষ্ট্রপতি হবেন, এটা করবেন, ওটা করবেন, সেটা করবেন। জনগণের জন্য সব করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। হবার পরে কী করলেন? এ ধরনের প্রশ্ন করলে বলবে ওটা আসল কথা নয়, ওটা সত্য কথা নয়, ওটা হলো মুখের কথা, ওটা হলো কথার কথা। আসলে সত্য কথা এখন আর কেউ বলে না, যদি কেউ বলেও সেটা নিশ্চিত ভুলবশত বলে।
লেখার হেডিং-এ বলেছি সৃজনশীল স্বপ্ন দেখুন এবং তার বাস্তবায়ন করুণ! তাহলে চলুন জানি স্বপ্ন কী, স্বপ্ন কারে কয় এবং কীভাবে তা বাস্তবে পরিণত করা সম্ভব?
আমার মতে স্বপ্ন হলো কিছু পাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন দর্শন হতে পারে জীবন শুরুর এক কাল্পনিক দিকনির্দেশনা; যা বয়ে নিয়ে যেতে পারে জীবনের শেষ গন্তব্যে। যেতে যেতে পথে বাধা পড়বেই, তবে নতুন স্বপ্নের আবির্ভাব হবে, সেগুলোকে সঙ্গে নিয়েই নতুন গতি এবং নতুন উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে স্বপ্ন জীবন সঙ্গী হয়ে থাকবে।
এখন স্বপ্নের, ধরণ, বরণ, গঠন যদি পরিকল্পিতভাবে না নির্ধারণ করা হয় তখন ভাগ্য নির্ধারণ করে জীবন। আমরা আবার ভাগ্যের অপেক্ষায়ও মগ্ন থাকি এবং ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্যও স্বপ্ন দেখি যেমন- কী পেলাম, কী নিলাম, কী দিলাম ইত্যাদি।
জন্মের পর থেকে সাধারণ দৃশ্যপটে শিশুর সবচেয়ে আপন তার মা, মায়ের সঙ্গেই কাটে সবচেয়ে বেশি সময়। তাই মায়ের সঙ্গে সন্তানের যে বন্ধন তৈরি হয়, ঠিক একই বন্ধন তৈরি হয় মায়ের মুখের ভাষার সঙ্গেও। শিশুর প্রথম বুলি থেকে প্রথম বর্ণপরিচয়। বড় হওয়ার প্রতিটি ধাপেই থাকে মাতৃভাষার সম্পৃক্ততা।
নিজের ভাব ও চিন্তাধারাকে মাতৃভাষায় যত সহজে প্রকাশ করা যায়, অন্য ভাষায় প্রকাশ তত সহজ নয়। এর পেছনে আরেকটি বিষয় আছে তা হলো অন্য ভাষা রপ্ত করার প্রক্রিয়া। যেকোনো স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তার মানুষই অন্য কোনো বিদেশি ভাষা শিখতে মাতৃভাষার সাহায্য নেয়।
আমরা যখন শিশুদের প্রশ্ন করি তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও, তখন শিশুরা আজ থেকে দশ বা পনেরো বছর পরে কী হবে তা কল্পনা করে উত্তর দেয় না। সে তার বর্তমানের ভাবনা তার ইচ্ছারূপে প্রকাশ করে। এ কারণে তারা মেঘ, বৃষ্টি, রোদ, পাখি, বিড়াল অনেক কিছুই হতে চায়।
একটি বাচ্চা শিশুকাল কিংবা কৈশোরে যা হতে চায় তার সঙ্গে সে ভবিষ্যতে কী হবে তার মিল নাও থাকতে পারে। তবে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে বর্তমান ভাবনার প্রকাশের মাধ্যমে সে তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়। তার আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় বিকশিত করে। সে নিজেকে বুঝতে শেখে এবং সেই ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা অর্জন করে।
মনোবিজ্ঞানীদের মতো আমিও মনে করি স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। স্বপ্নশূন্য মন হতাশা আর বিষন্নতায় পরিপূর্ণ থাকে। হঠাৎ শিশুকে প্রশ্ন করা হলো, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও? শিশুটি বিষন্ন চিত্তে উত্তর দিল- আমি কিছুই হতে চাই না, কিছু হতে না চাওয়া কি তাহলে বিষন্নতা?
শুধু স্বপ্ন নামের আশার পেছনে ছুটে চলার গতি ধীর থেকে ধীরজ হয়ে যায়। স্বপ্নভঙ্গের ভয়ে স্বপ্ন তাড়না থেকে পালিয়ে বেড়ানো কি আদৌ সম্ভব বা স্বপ্ন দেখা থেকে দূরে থাকা যাবে? স্বপ্নের রঙিন জগতের ছোঁয়া ছাড়া কি বাঁচা সম্ভব? স্বপ্নহীনভাবে বাঁচার মধ্যে যেমন কোনো শান্তি নেই আবার দুঃখও নেই।
স্বপ্ন প্রেরণা দেয় বাঁচার। উদ্যোগী হওয়ার সম্ভাবনার সঙ্গে দ্বার উন্মোচনের পথ দেখায়। স্বপ্নীল জীবনের সূত্রপাত হয় স্বপ্ন দেখা থেকেই। আর বাঁচার জন্য স্বপ্ন যেহেতু দেখতেই হবে, তাহলে বড় স্বপ্ন দেখাই শ্রেয়।
মানুষ মাত্রই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সবাই বেড়ে ওঠে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ও মতামত নিয়ে। এই ব্যক্তিত্বই আকর্ষণ করে একে অপরকে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের জন্যই ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়। আর এই নিজস্বতা বাদ দিলে মানুষের অস্তিত্বই থাকে না, তাই যার যার স্বাতন্ত্র্যকে যতটা সম্ভব মেনে নেওয়া উচিত।
আমি যেমন সুইডেনে বাংলাদেশি শাক-সবজি উৎপাদন করতে চেষ্টা করছি। লাউয়ের বিচিকে সরাসরি বাইরে লাগানো হয়েছে দুই সপ্তাহ আগে, তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে চারা গজাচ্ছে না। পরে ঘরের ভেতর একটি টবে বপন করেছি সপ্তাহখানেক আগে। হুড় হুড় করে লাউয়ের গাছ বেড়ে উঠছে। এখন সেটাকে বাইরের পরিবেশে রোপন করবো। ভাবনা ঢুকেছে মাথায়, একই বীজ বপণ করেছি প্রথমে বাইরে, পরে ঘরে। শুধুমাত্র বীজ বপনে পারিপার্শ্বিকতার কারণে গজিয়ে উঠলো লাউয়ের গাছ।
স্বপ্নও বীজের মতো অঙ্কুরে বিনাশ হতে পারে সঠিক পারিপার্শ্বিকতার অভাবে। বীজ বপণে যে গাছ উৎপাদন হবে তা নির্ভর করছে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর। তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার যে আমাদের জীবনেও পারিপার্শ্বিকতার একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সেক্ষেত্রে সহজ করে বলা কঠিন জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভালো।
জন্ম যথাযত হলে কর্ম ভালো হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, যদি কিনা ভাগ্য সেটাকে নিয়ন্ত্রণ না করে। জীবনে ভাগ্যকে জড়িত করা মানেই ভাগ্যের উপর নিজেকে হস্তান্তর করা। সতেরো কোটি মানুষের জীবনের স্বপ্নকে যদি ভাগ্যের উপর সোপর্দ করা হয় তবে মনে হয় না আমরা আশানুপাত ফল পাবো।
সে ক্ষেত্রে আমাদের হৃদয়ে যে স্বপ্নের গাছটি বপণ করেছি তাকে জীবিত রাখতে হবে। আর স্বপ্নের সেই গাছটিকে জীবিত রাখতে দরকার সঠিক গাইড লাইন। আমাদের জীবনের গাইড লাইনই হচ্ছে পারিপার্শ্বিকতা। এই পারিপার্শ্বিকতার একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, যার ফলে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ তার সর্বাঙ্গীন পরিকাঠামোর দিকে গুরুত্ব দেওয়া খুবই জরুরি।
স্বপ্নের গাছে সুন্দর পাতাসহ রঙিন ফুল ফুটবে, তাতে রঙিন প্রজাপতি আসবে। স্বপ্নের গাছে ফল ধরবে আর ফলটি সুমিষ্ট হবে। সেক্ষেত্রে সম্মোহনী শক্তিতে উদ্ভাসিত হোক প্রতিটি জীবন। একই সঙ্গে ঝুলে থাকা স্বপ্নগুলো বর্ধিত হোক। নিভু নিভু স্বপ্নগুলো আলোর মুখ দেখুক। স্বপ্ন পূরণের উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হোক দিগ্বিদিক। পূর্ণ হওয়া স্বপ্নগুলো ধাবিত করুক নতুন কোনো স্বপ্ন দেখার স্বপ্নিল পথ।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই
মুক্তমত রহমান মৃধা সৃজনশীল স্বপ্ন দেখুন এবং তার বাস্তবায়ন করুণ!