চলন্ত ট্রেনে ঢিল এবং কয়েকটি ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫ মে ২০২৩ ১৭:০১
প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে যেখানে-সেখানে ঢিল ছোঁড়া বাঙালির একটি স্বভাব। হাতের কাছে ঢিল পেলেই হলো তা ছুঁড়ে নিজের হাতের শক্তি যাচাই করতেই হবে। এতে কারও ক্ষতি হলে হোক, কারও চোখ নষ্ট হলে হোক আর ট্রেনের কাঁচ ভাঙলে ভাঙুক। ঢিল প্রদানকারীর কিছু যায় আসে না। ছোটবেলায় আমরা অনেকেই মৌমাছির চাকে ঢিল ছুঁড়েছি। তারপর মৌমাছি পিছু নিয়েছে। কেউ বেঁচেছে আবার কেউ মৌমাছিল হুল খেয়েছে। মৌমাছি নেই কিন্তু সেই ঢিল ছোঁড়ার অভ্যাস প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে চলেছে। আবার কারও গাছে আম-জাম দেখলেই ঢিল ছুঁড়ে তা মাটিতে ফেলতে হবে। ছোটবেলায় এটাও আমরা কম করিনি। নদীতে গিয়েও ঢিল ছুঁড়েছি। এই তো কয়েকদিন আগেই ফেসবুকে পরিচিত এক সাংবাদিকের স্ট্যাটাসে জানতে পারলাম চলন্ত ট্রেনে বাইরে থেকে ছোড়া ঢিলে অল্প থেকে তার সন্তানের চোখ বেঁচে গেছে। এ ঘটনা কিন্তু নতুন না। মাঝে মধ্যেই ঘটে। তার চোখ তো বেঁচে গেছে কিন্তু চোখ হারানোও অস্বাভাবিক না।
এই যে মেট্রোরেলের মতো একটা আধুনিক যান আমাদের দেশের ইতিহাসে যোগ হয়েছে এখানেও কেউ কেউ ঢিল ছোড়াতে ব্যস্ত আছে! কি আজগুবি মানসিকতা নিয়ে কেউ কেউ রয়েছেন ভাবলে অবাক হতে হয়। দেশের একটি সম্পদ, গর্ব সেটির ক্ষতি করে কি লাভ এই সহজ হিসাবটুকু কেউ বোঝে না। এই হুঁশ যে কবে ফিরবে কে জানে। না ফেরার সম্ভাবনাই বেশি। ঢিল ছোঁড়া মনে হয় আমাদের স্বজাত হয়ে গেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, মেট্রোরেলের একটি কোচ আগারগাঁও থেকে উত্তরা-উত্তর স্টেশনে যাওযার পথে রাজধানীর কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়ার মধ্যবর্তী স্থানে ঢিল ছোড়ার ঘটনা প্রায় ১০ লাখ টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আজকাল নানাভাবে রাস্তায় চলতে মানুষের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে। এসব ঝুঁকি বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে আমাদের গড়ে ওঠা মানসিকতা। যে ঘটনাগুলো একটু সচেতন হলেই রোধ করা সম্ভব ছিল সেই দুর্ঘটনাগুলো রোধ করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে একটি হলো চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ এবং তাতে ঘটে চলা দুর্ঘটনা আমাদের মনের বিবেককে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। আমরা সঠিক শিক্ষা দিতে পারছি না। যারা এই কাজটি করছে তাদের বোঝাতে ব্যর্থ যে এর ফলে ট্রেনের এবং কোনো মানুষের ক্ষতি হতে পারে যা উচিত নয়। এটি একটি শিক্ষা যা পরিবার এবং সমাজ থেকেই পাওয়া উচিত। অন্যের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা এই প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘাটতি রয়েছে।
চলন্ত ট্রেনে পাথর বা ঢিল ছুড়ে মারায় কখনো কেউ আহত হয় আবার কখনো ক্ষতিগ্রস্থ হয় ট্রেনের কোনো অংশ। এ কোন শিক্ষা আমাদের? অন্যের ক্ষতি করার মানসিকতা এই ঘটনার পেছনের কারণ। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু এসবের পরেও এ ঘটনা থামছে না। আরে ট্রেনেরও যদি ক্ষতি হয় সেটাও তো দেশেরই সম্পদ। আর দেশের সম্পদ মানে নিজের ক্ষতি করা। আমিও তো এই উন্নয়নের অংশীদার। আমাদের একজনের কাছে যা খেলা অন্যজনের কাছে তা বিপদের কারণ হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে তা বড় কোনো ক্ষতির কারণও হতে পারে। আমরা বুঝে অথবা না বুঝে অন্যকে বিপদে ফেলার মতো কাজ করি। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে – what is play to the cat is death to the rat। এই চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে মারার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। আবার এই ঘটনাই যে শেষ সেটাও বলা যায় না। এই যে চলন্ত ট্রেনে পাথর বা অন্য পদার্থ ছুড়ে মারার মতো বদ অভ্যাস সেটা যে কতটা ক্ষতিকর হতে পারে তা কি সেই ব্যক্তি অনুধাবন করতে পারে? এই নিরপরাধ শিশুটির চোখের কোনো ক্ষতি হলে তার দায় কার? এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছুঁড়লে যে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এই জ্ঞানটুকু সবারই আছে। তা জানা সত্ত্বেও এ কাজটি করছে কেউ। একটি গল্প আছে। এক পুকুরে বাস করতো কয়েকটি ব্যঙ। একদিন সেই পুকুরের তীরে দাড়িয়ে একটি শিশু সেখানে পাথর ছুঁড়ে মারছিল। এতে কয়েকটি ব্যাঙ মারা যায়। শেষ পর্যন্ত একটি ব্যাঙ উঠে এসে বালকটিকে জিজ্ঞ্যেস করে কেন সে এভাবে পাথর ছুঁড়ে মারছে? জবাবে বালকটি বলে যে সে খেলা করছে। তখন ব্যাঙটি জানায় যে তোমার জন্য যা খেলা আমাদের জন্য তা মৃত্যু। এই গল্পটি আমাদের এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমরা প্রায়ই সচেতনভাবেই যেসব কাজ করি তা অন্যের জীবনের ঝুঁকি তৈরি করে। রাস্তায় কলা খেয়ে তার খোসাটি রাস্তায় ফেলে রাখি। একবারও ভাবি না যে এতে যে কারও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এমনকি নিজেরও। এটা বোঝা যায় যখন নিজের পরিবারের কেউ এ ধরনের ঘটনায় আহত হয়।
আমাদের অভ্যাস যা সমাজটাকে আরও সুন্দর ও স্বাভাবিক করতে পারে সেই অভ্যাসগুলো রপ্ত করার বিপরীতে বদ অভ্যাসগুলো রপ্ত করছি। এই অভ্যাসের বিষয়টি একজন থেকে অন্যজনে প্রবাহিত হচ্ছে। যদি কেউ রাস্তায় নোংরা ফেলে যায় তাহলে অপরজনও সঠিক স্থানে ময়লা না ফেলে সেখানেই ফেলে যাবে। অর্থাৎ তার কাজ যদি অন্যায় না হয় তবে আমি করলে অন্যায় হবে কেন? ঠিক এই নিচু মানসিকতাই সমাজ অধঃপতনের কারণ। এ অভ্যাসগুলো আমাদের কাছ থেকেই এই প্রজন্ম শিখছে। তাদের বদলাতে হবে। যদিও এই বদলে যাওয়াটা অভ্যাস করতে হবে। এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
এলাকাগুলোর আশেপাশের সবাইকে এই সচেতনতার আওতায় আনতে হবে। বিশেষ করে কিশোরদের। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরাই এই কাজটি করে। ঢিল ছুঁড়লে ক্ষতি হতে পারে এটা যে তারা জানে না সেটা নয় কিন্তু ঐ যে অভ্যাস। মজা করার অভ্যাস। অন্যকে কষ্ট দিয়ে নিজে আনন্দ পাওয়ার এক ধরনের কুৎসিত মানসিকতা আমাদের রয়েছে। সেখান থেকে বের হতে পারি না। তাই এদের বোঝাতে হবে। পরিবার থেকেও এই কাজটি করা যেতে পারে। অর্থাৎ বাঙালির এই অযাচিত ঢিল ছোঁড়াটা এবার বন্ধ হওয়া দরকার। এতে দেশের সম্পদ এবং মানুষের জীবনের অঙ্গহানির ঝুঁকি দুই-ই রক্ষা পাবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
সারাবাংলা/এজেডএস