নজরুল স্মৃতিতে ভরা নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন
৯ মে ২০২৩ ১৫:৩১
উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রসরমান বিশ্বের সাথে সঙ্গতি রক্ষা ও সমতা অর্জন এবং জাতীয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা, বিশেষ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধুনিক জ্ঞানচর্চা ও পঠন-পাঠনের সুযোগ সৃষ্টি ও সম্প্রসারণের নিমিত্ত ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনকল্পে ২০০৬ সালের ০৯ মে জাতীয় সংসদে একটি আইন প্রণীত হয়। মূলত এই আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে উদাযাপন করা সিদ্ধান্ত নেয়। আজ ০৯ মে, ২০২৩ উদযাপন করা হবে ১৮তম নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় দিবস।
ব্রিটিশশাসিত ভারতের অখণ্ড বঙ্গভূমির বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নিলেও কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। শৈশবে নজরুল আসানসোলের বখশ মিয়ার রুটির দোকানে ৫ টাকা মাইনের ময়দা মাখার কাজ করতেন। আসানসোলের সেই রুটির দোকানেই নজরুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয় পুলিশের কর্মকর্তা রফিজউল্লাহর।
নজরুল প্রতিভায় তিনি মুগ্ধ হন। রফিজউল্লাহর মাধ্যমে প্রথম ময়মনসিংহের ত্রিশালে আসেন কাজী নজরুল ইসলাম। জাতীয় কবির আগমনের প্রায় ৯৩ বছর পর সেই ত্রিশালেই কবি স্মৃতিবিজড়িত নামাপাড়ার বটতলায় প্রতিষ্ঠা করা হয় কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৭ এর ২৪ মে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে দুটি অনুষদের কার্যক্রম উদ্বোধন এবং ৩ জুন ২০০৭ এ প্রথম ব্যচের ক্লাস শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে কলা অনুষদের অধীনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, সংগীত বিভাগ এবং বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের অধীনে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইন্জিনিয়ারিং বিভাগে ১৮৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-কার্যক্রম শুরু হয়। দেড় দশকের ব্যবধানে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের অধীনে রয়েছে ২৪টি বিভাগ। একই সাথে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় আট সহস্রাধিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের অধীনে যোগ হয়েছে থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ, ফিল্ম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ ও দর্শন নামক তিনটি বিভাগ। বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদেও বেড়েছে তিনটি বিভাগ, ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইন্জিনিয়ারিং বিভাগ, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইন্জিনিয়ারিং বিভাগ, পরিসংখ্যান বিভাগ।
ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের অধীনে রয়েছে পাঁচটি বিভাগ, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, ফিনান্স ও ব্যাংকিং বিভাগ, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও মার্কেটিং বিভাগ।
সর্বোচ্চ সাতটি বিভাগ রয়েছে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে; অর্থনীতি বিভাগ, লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগ, ফোকলোর বিভাগ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ, স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ। আইন অনুষদের অধীনে রয়েছে আইন ও বিচার বিভাগ। চারুকলা অনুষদের অধীনে চারুকলা বিভাগ।
নজরুলময় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ই যেন কবির ছোঁয়ায় ও স্মৃতিতে জীবন্ত। নজরুলের সাহিত্যকর্মের ওপরে গবেষণার জন্য রয়েছে ‘ইন্সটিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ’ নামে একটি ইন্সটিটিউট। জাতীয় কবির বিভিন্ন গান, কবিতা, উপন্যাস, নাটক সর্বোপরি তার জীবনী এবং জীবনকর্মের উপর গবেষণা চলমান রাখার জন্য বিভিন্ন শাখায় পিএইচডি এবং এমফিল প্রোগ্রাম কোর্স চালু রয়েছে। প্রতিটি বিভাগই ‘নজরুল স্টাডিজ’ নামের একশত নাম্বারের বাধ্যতামূলক একটি কোর্স পড়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতেও রয়েছে নজরুলের আলাদা কর্ণার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পরিবহনের জন্য ধূমকেতু, প্রভাতী, প্রলয়শিখা, বাঁধনহারা নামের বাস কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে খানিক এগোলেই নজরুলের ভাস্কর্য, আরও রয়েছে ‘চির উন্নত মম শির’ স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা ‘গাহি সাম্যের মঞ্চ’, ‘চুরুলিয়া মঞ্চ’। আরও দেখা মিলবে কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘দোলনচাঁপা’র নামে শিক্ষার্থীদের হল, কাব্যগ্রন্থ ‘চক্রবাক’-এর নামে ক্যাফেটেরিয়া। ছোটগল্প ‘ব্যথার দান’–এর নামে মেডিকেল সেন্টার কিংবা কবির ডাকনাম দুখু মিয়ার নামে নামকরণকৃত উপাচার্যের বাসভবন। এমন নামকরণে এ নজরুল তীর্থে বিদ্রোহী নটরাজের আবেদন বাড়িয়েছে।
ক্যাম্পাসে পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি প্রশাসনিক ভবনের পাশাপাশি রয়েছে পাঁচতলা বিশিষ্ট দুটি ও দশতলা বিশিষ্ট দুটি একাডেমিক ভবন। দশতলা বিশিষ্ট আরেকটি একাডেমিক ভবন নির্মানাধীন। আরও রয়েছে পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি সমৃদ্ধ ও অত্যাধুনিক ‘কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার’ ও শেখ রাসেলের নামে নামকরণৃত একটি কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ। শিক্ষকদের আবাসনের জন্য রয়েছে দুটি চারতলা ও তিনটি পাঁচতলা ভবন। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের জন্য উদ্বোধন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার নামে দুটো হল, ছাত্রদের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও ছাত্রীদের জন্য ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব’ হল। ৫৭ একরের বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নজরুল ভাস্কর্যের পাশাপাশি আরও রয়েছে বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য ও জয় বাংলা ভাস্কর্য। রয়েছে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা ও নজরুলের ম্যুরাল। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য আছে একটি পুলিশ ফাঁড়ি।
উৎসবমুখর সাংস্কৃতিক আবহে মুখরিত এ নজরুল প্রাঙ্গণে বিভিন্ন ক্রিয়াশীল সংগঠনের কার্যক্রমও উল্লেখ করার মতো। রয়েছে সংবাদকর্মীদের সংগঠন প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক সমিতি। ক্যারিয়ার ও আত্মোন্নয়নের জন্য রয়েছে ক্যারিয়ার ক্লাব, স্কিল ডেভেলপমেন্ট ক্লাব, রিসার্চ সোসাইটি, ডিবেটিং সোসাইটি, ফিল্ম এন্ড ফটোগ্রাফি ক্লাব, মান ক্লাব প্রমুখ। একইভাবে রয়েছে গ্রীন ক্যাম্পাস, রংধনু, সেভ দ্য টুমরো, নির্ভয় ফাউন্ডেশন, অরণ্য, শুভসংঘ, বন্ধুসভা, ইনলেপ্ট, রোটারেক্ট ক্লাবের মতো স্বেচ্ছাসেবী ও পরিবেশবাদী সংগঠন। নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করে উইমেন পিস ক্যাফে, উইমেন লিডার্স এর মতো উদ্যোগ। আরও রয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন।
সাংস্কৃতিক মননে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর উদযাপিত হয় নজরুল জয়ন্তী, রবীন্দ্র জয়ন্তী, বারামখানা’র উদ্যোগে লালন স্মরণোৎসবের মতো আয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎসবমুখর আরও একটি অনবদ্য আয়োজন হচ্ছে ‘কুয়াশা উৎসব’। সংগীত, নাট্যকলা, ফিল্ম কিংবা চারুকলার মতো বিভাগগুলো এসব আয়োজনে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। এর প্রতিফলন পাওয়া যায় আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায়। সর্বশেষ তিনবারের আয়োজনে দুইবারই চ্যাম্পিয়ন ও একবার রানার্সআপ হয় নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়।
রাজধানী থেকে ১০০ কিলোমিটার ও বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহ থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয়। সড়কপথে রাজধানী থেকে যে কোনও যানবাহনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশাল হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আসতে পারবেন। বিভাগীয় শহরগুলো থেকে ময়মনসিংহগামী বাসে বা অন্যান্য যানে ময়মনসিংহ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারবেন। রেলযোগে ক্যাম্পাসে আসতে চাইলে ঢাকা থেকে এসে ময়মনসিংহ জংশন স্টেশনে নেমে ময়মনসিংহ হয়ে একইভাবে ক্যাম্পাসে আসতে পারবেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
নজরুল স্মৃতিতে ভরা নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন মুক্তমত মো. আশিকুর রহমান সৈকত