মায়ের প্রতি খোলা চিঠি
৯ মে ২০২৩ ১৫:৪০
চিঠির শুরুতে আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা নিও। আশা করি খুব ভালোই আছো। আজকে খুব আনন্দ লাগছে যে জীবনের প্রথম চিঠি তোমাকেই লেখছি। মা আমি স্বর্গ দেখিনি, কিন্তু তোমাকে দেখেছি। পৃথিবীতে তুমি আমার একমাত্র স্বর্গ, আশ্রয়স্থল ও নিরাপদের জায়গা। আমাদের পরিবারের স্থপতি মা তুমিই কারণ তোমার চাকরির উপার্জনের অর্থ দিয়ে আমরা তিন ভাই লেখাপড়া করে মনুষ্যত্ববোধের জায়গায় দাঁড়াতে পেরেছি।
তুমি নিজেই জানো যে, বাবা সংসারের প্রতি উদাসীন। কারণ তিনি একটা দর্শন নিয়ে রাজনীতি করেন। তার স্বপ্ন নির্যাতিত নিপীড়িত শোষিত নিষ্পেষিত মানুষের মুক্তি আসবে। এজন্য তিনি মানবমুক্তির সংগ্রামের জন্য রাজপথে লাল ঝাণ্ডা নিয়ে স্লোগানে স্লোগানে ব্যস্ত সময় কাটান। গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকের কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
আমাদের বাড়ির পাশে তিস্তা নদী। প্রতিবছর মার্চ মাসে তিস্তার পানি ন্যায্য হিস্যার দাবিতে আন্দোলন গড়তে তুলেন। জাতীয় ভাবে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল – বাসদের উদ্যোগে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি ন্যায্য হিস্যার রোডমার্চ সফল করা লক্ষ্যে গণচাঁদা সংগ্রহ এবং মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
যার ফলে পরিবারের সংসারের দায়ভার মা তোমাকে একাই বহন করতে হয়। মাস শেষে তোমার চাকরির বেতনের টাকা দিয়ে আমাদের কাপড়চোপড় এবং লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছ। ফলে আমাদের পরিবারের চালিকাশক্তি তুমি নিজেই।
কোষের বিভাজনের মাধ্যমে মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারে, কিন্তু দেহ-মনে জ্ঞানে বিকশিত মনুষ্যত্ববোধের মানুষ হওয়ার জন্য চাই শিক্ষা আর হাতেখড়ি শিক্ষা তুমি দিয়েছ। বর্ণমালার সাথে পরিচয়ের প্রথম ব্যক্তি তুমি। মা তোমার একটা উপদেশ আমার কানে ভাসে। তুমি বলেছিলে ‘বাবা, জীবনে একটা কথা মনে রাখবে সবসময়, সত্য পথে থাকবে এবং সত্যকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করবে।’
মা তোমার কথা আমার কাছে মহান বাণী হিসাবে থাকবে কারণ ‘জান ও জবাবের স্বাধীনতা’ রাষ্ট্রের কাছে চেয়ে তো পবিত্র কালি ও কলম হাতে ধরেছি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের সত্য কথা তুলে ধরতে এবং পেশা হিসাবে পথ বেছে নিয়েছি সংবাদকর্মী হিসাবে। সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ করতে গিয়ে কত মায়ের চোখের কান্না দেখি। মাঝে মাঝে উদ্বিগ্ন থাকি। মা তুমি কি ভালো আছো? আমি সবসময় তোমার পাশে থাকতে পারি না। দিনের পর দিন শুধু মুঠোফোনেই খোঁজখবর রাখা হয়। ঈদ উদযাপন করার জন্য বাড়িতে গেলেই আনন্দে যেন চোখে জল আসে। মা তোমার হাতের রান্না খুবই মনে হয়। বিশেষ করে তোমার হাতের পিঠা, যা আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার।
যখন সারাবিশ্বে মানুষ করোনা ভাইরাসের আক্রমণে টালমাটাল। তখন আমাদের দেশেও ব্যতিক্রম নয়। কঠোর লকডাউন দিয়েছে। করোনায় মানুষ ভিতর চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে ঠিক তখনি সর্দি, জ্বর ও প্রচন্ড মাথার ব্যথায় নাজেহাল হয়েছিলাম। জয়পুরহাট সদর হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করতে গিয়েছিলাম। আমার কাছ থেকে নমুনা নিয়েছিল কিন্তু ফলাফল দুদিন পর জানাবে। মেসের মধ্যে এই খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আমাকে একঘরে করে রাখা হয়। কেউ কাছে আসে না। দূর থেকে ওরা নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করেছিল করোনার রোগী কাছে যাওয়া যাবে না। কেউ ওষুধ পর্যন্ত এনে দেয় নি। ফলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিয়ে পরে দিন আমি বাড়িতে চলে আসি।
বাড়িতে এসে নিজেকে সব সময় একা রাখার চেষ্টা করেছিলাম। তুমি আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছ। তাই তো আমাকে সব সময় মনের মধ্যে সাহস জুগিয়েছিলে, একা থাকতে দাও নি। মা তোমার স্নেহ ভালোবাসার বন্ধন দিয়ে আমাকে বুঝি পৃথিবীতে ঠিকে থাকার সর্বোচ্চ সহযোগিতা পেয়েছি। রাতে গভীরে যখন শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তখনি তুমি আমার জন্য পানি গরম করে আমাকে দিয়েছ। ওষুধ দিয়েছ, শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়েছি আর তোমার ভালোবাসা পেয়ে সত্যি অবাক হয়েছি। পৃথিবীতে সবাই ছেড়ে গেলেও মা সন্তান নিজের জীবন উৎসর্গ করে সন্তানকে বাঁচিয়ে তার প্রমাণ তুমি নিজেই। তুমি আমাকে পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছ আবার দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে বাঁচার স্বপ্নও দেখিয়েছ। তোমার দেওয়া উপহারের বইগুলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার হিসাবে থাকবে। ভালো থাক মা।
ভালো থাকুক বিশ্বের প্রতিটি মা। সকল মায়ের প্রতি অবিরাম ভালোবাসা শ্রদ্ধা রইল। পৃথিবীর কোনো মা’কে যেন না খেয়ে থাকতে না হয়। বিশেষ করে পুঁজিবাদী সমাজে নারীদের ছোট করে দেখা হয়। আমাদের দেশেও অনেক মা’কে দেখেছি না খেয়ে ফুটপাতে পড়ে থাকতে। চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর পদযাত্রী হতে দেখেছি। ফলে মা দিবসে রাষ্ট্রের উচিত অবহেলিত, সুবিধা বঞ্চিত ও ছিন্নমূল মায়ের মৌলিক অধিকার গুলোর মধ্যে যা যা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করা।
তাহলে মা দিবসের সার্থক হবে। তা না হলে প্রতিবছর মা দিবস আসবে আর যাবে! কাজের কাজ কিছু হবে না। শুধু হবে একটি বিষয় ফেসবুক কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জন্য একটা আবেগ মিশ্রিত একটা স্ট্যাটাস। আসুক মা’কে হৃদয়ে ভিতর থেকে ভালোবাসি। এই ভূখণ্ড, এই দেশ আমাদের মায়ের মত। তাই দেশের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত করি। প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশ বাঁচাই দেশ অর্থাৎ মা’কে রক্ষা করি। অন্যায়, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলি। তাই শোষণহীন বৈষম্যহীন দেশ গড়ি। মা জাতিকে সুস্থ রাখি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস