রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ: আধিপত্য বিস্তারের জন্য খুন-অপহরণ
১২ মে ২০২৩ ২০:০৩
বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় গত সাড়ে পাঁচ বছরে অন্তত ১৬৪টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্য গত দুই বছরে এ সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। ক্যাম্পগুলোতে হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, গোলাগুলি অনেকটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই সহিংসতার নেপথ্য কারণগুলো কী? কারা রয়েছে এর পেছনে?
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় যে একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, সেটা যেন ‘ওপেন সিক্রেট’। কিন্তু কেউ এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোন কথা বলতে চান না। কারণ তাদের ভয়, কেউ ‘ফোকাস’ হয়ে গেলেই তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। কারণ, যারাই এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছে, এমনকি প্রশাসন-গোয়েন্দাকে তথ্য দিয়েছে বলে সন্দেহ হয়েছে, তারাই পরবর্তীতে এসব গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় একের পর এক সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে তা খুবই দুঃখজনক। ক্যাম্পে সহিংসতার মূল কারণ হিসাবে ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের এবং মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা।
রোহিঙ্গা সূত্রগুলো জানিয়েছে, এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আর রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। এর বাইরে নবী হোসেন গ্রুপ, মুন্না গ্রুপ, ডাকাত হাকিম গ্রুপ, ডাকাত সালেহ গ্রুপ, ইসলামিক মাহাস গ্রুপ রয়েছে। আরসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে আল-ইয়াকিন নামেও পরিচিত। আরএসও আগে থেকেই কুতুপালং ক্যাম্পে সক্রিয় ছিল। ২০১৭ সালের পর থেকেই আরসা এবং অন্য সংগঠনগুলো আরো বেশি সক্রিয় আর শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এসব গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি এসব নিয়েই এখন সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।
আরসা এবং আরএসও আলাদাভাবে কাজ করলেও তাদের মধ্যে বিরোধ ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই দুটি সংগঠন পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে আরসার বিরুদ্ধে আরএসও গত দুই বছরে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কর্মহীন, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের এই রোহিঙ্গাদের ঘিরে মাদক, পাচার, অপহরণসহ নানারকম অপরাধের সাম্রাজ্য তৈরি করেছে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। মাদক পাচার, অপহরণ নিয়ে কোন দ্বন্দ্বের তৈরি হলেই তারা একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। নিজেদের প্রভাব অক্ষুন্ন রাখতে তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে রেখেছে। যখন তারা সেই প্রভাব আরো বিস্তারের চেষ্টা করে, তখন আরেকটি গ্রুপের সঙ্গে গোলাগুলি বা হত্যাকা- শুরু হয়ে যায়। ক্যাম্পের সব জায়গায় এসব দলের লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ক্যাম্পে কাজের সুযোগ সীমিত হওয়ায় টাকা পয়সা আর শক্তি দেখানোর লোভে অনেক রোহিঙ্গা তরুণ এসব গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
নিজেদের কৌশলও পরিবর্তন করেছে এসব সন্ত্রাসী দল। এখন আর আগের মতো তারা দল বেধে অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে ক্যাম্পের ভেতরে চলাফেরা করে না। কাউকে টার্গেট করা হলে সুবিধা মতো সময়ে এসে তারা হামলা করে। কোনো সশস্ত্র গ্রুপ একটি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর আরেকটি গ্রুপ এসে পাল্টা হামলা করে সেই এলাকার দখল নেয়ার চেষ্টা করে। ফলে আরসা সদস্যদের লক্ষ্য করে হামলা করছে আরএসও, আবার আরএসও সদস্যদের ওপর পাল্টা হামলা চালাচ্ছে আরসা। এসব কারণে গত দুই বছরে ৪০টির বেশি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে।
সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বে এর বেশ কয়েকবার ক্যাম্পে আগুন দেয়া হয়েছে। এক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় আরেক গ্রুপ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাম্প্রতিক যেসব গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, প্রায় তার সবই আরসা আর আরএসও সশস্ত্র দুটি গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে ঘটেছে। তবে ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে।
আগে আরসার লোকজন নাইক্ষংছড়ির শূন্য রেখায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই শক্ত ঘাটি তৈরি করেছিল। শূন্য রেখা থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে দেয়ার পর তারা অন্য ক্যাম্পগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অর্থের মূল উৎস মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে মাদক পাচারের ব্যবসা। মিয়ানমারের ইয়াবা তৈরিকারীদের সঙ্গে এসব গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাদের কাছ থেকে সীমান্তের পাহাড়ি এলাকা, নদী থেকে ইয়াবা বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। পরে এই চক্রের কাছ থেকে সেটা বাংলাদেশি মাদক কারবারিদের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়া মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে যেসব পণ্য পাচার হয়ে দেশে আসে, সেটাও নিয়ন্ত্রণ করে এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী। সেই সঙ্গে রয়েছে ক্যাম্প থেকে মানব পাচার, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করার মতো অপরাধ। যে এলাকা যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেই এলাকার দোকান থেকে, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও এরা চাঁদা নেয়। কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাবে, ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আড়াই হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, মানব পাচার ও পুলিশের ওপর হামলার মতো অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত দুই বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় মোট ২২২টি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬৩টি আগুন নাশকতামূলক বা ইচ্ছে করে লাগানো হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কবে এই হত্যাকা–সহিংসতা শেষ হবে তা কেউ বলতে পরে না।
লেখক : কবি, সাংবাদিক
সারাবাংলা/এজেডএস