‘জাতির কথাশিল্পী’ শওকত ওসমানকে কতটুকু জানি
১৫ মে ২০২৩ ১৫:১১
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাশিল্পী শওকত ওসমানের ২৫তম প্রয়াণ দিবস আজ। তিনি একাধারে নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, রাজনৈতিক লেখা ও শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনা করেছেন। ১৯৯৮ সালের এদিনে তিনি ঢাকায় মারা যান।
শওকত ওসমান বিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের একজন স্বনামখ্যাত লেখক ও কথাসাহিত্যিক। জন্মসূত্রে তার নাম শেখ আজিজুর রহমান। কিন্তু তিনি শওকত ওসমান নামে লেখালেখি করতেন। ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় জন্ম নেন শওকত ওসমান। কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরুর পর তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। পরে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রিও অর্জন করেন তিনি।
আইএ (বর্তমানে এইচএসসি) পাস করার পর শওকত ওসমান কিছুদিন কলকাতা করপোরেশন এবং বঙ্গীয় সরকারের তথ্য বিভাগেও চাকরি করেন। স্নাতকোত্তর পাসের পর ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ অব কমার্সে যোগ দেন। পরে ১৯৫৮ সাল থেকে ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করে ১৯৭২ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে যান। চাকরি জীবনের প্রথম দিকে কিছুকাল তিনি ‘কৃষক’ পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেন।
বাংলা সাহিত্যের বলিষ্ঠ কথাশিল্পী শওকত ওসমান তাঁর লেখনীর মাধ্যমে শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে ও শোষিতের পক্ষে কথা বলেছেন সারা জীবন। তাঁর রচিত ‘ক্রীতদাসের হাসি’ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সবসময় প্রেরণা জুগিয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তিনি ছিলেন সরব। নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রস-রচনা, রাজনৈতিক লেখা, শিশু-কিশোর সাহিত্যসহ সর্বত্র তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।
শওকত ওসমানের ‘জননী’ উপন্যাস ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বসাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে। সাহিত্যকর্মে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরম্যান্স পদক, একুশে পদক, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, মুক্তধারা পুরস্কার, মাহবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পদক, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, টেনাসিস পুরস্কার ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পেয়েছেন।
‘ক্রীতদাসের হাসি’ তার প্রসিদ্ধ উপন্যাস। ১৯৬২ সালে তিনি লিখেছিলেন তার সবচেয়ে বিখ্যাত এই উপন্যাস। যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে। ক্রীতদাসের হাসি ছিল মূলত আইয়ুব খানের স্বৈরাচার ও সামরিক শাসনের বর্বর শাসন ও বাক স্বাধীনতার হরণের জঘন্য চরিতার্থ নিয়মের বিরুদ্ধে এক শক্ত চপেটাঘাত। মূলত স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসনব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে এ উপন্যাস লেখা হয়। সে বছরই বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন শওকত ওসমান।
১৯৬৫ সালে শওকত ওসমান অনুবাদ করেন ‘স্পেনের ছোটগল্প’। এর দুই বছর পরে প্রকাশিত হয় তার অসামান্য উপন্যাস ‘সমাগম’। তার কয়েক মাস পর প্রকাশিত হয় আরেক উপন্যাস ‘চৌরসন্ধি’। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে- রাজা উপাখ্যান, জাহান্নাম হইতে বিদায়, দুই সৈনিক নেকড়ে অরণ্য, পতঙ্গ পিঞ্জর, আর্তনাদ, রাজপুরুষ, জলাঙ্গী, বনী আদম ও রাজসাক্ষী।
শওকত ওসমানকে বলা হয় ‘জাতির কথাশিল্পী’। হুমায়ুন আজাদ তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘অগ্রবর্তী আধুনিক মানুষ’। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে একপ্রকার বিপ্লব ঘটিয়েছেন তিনি। মুক্তবাক আর সমাজের চলতি ধারাকে যিনি উঠিয়ে এনেছেন সাহিত্যে। নিজেকে তিনি পরিচয় দিতেন ‘ঝাড়ুদার’ বলে। আসলেই তো ঝাড়ুদার তিনি, সমাজের ঝাড়ুদার। সমাজের সব জঞ্জাল, অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তার আধুনিক আর বাস্তবধর্মী লেখনি সমাজের কথা বলতো। তিনি নির্দ্বিধায় বলতেন সত্য আর সুন্দরের কথা। তাকে কেবল সাহিত্যিক হিসেবে পরিচয় দিলেই হবে না, বলা যায় পূর্ণ সমাজ সংস্কারক। প্রথম জীবনে তাকে দারিদ্র্যতার সঙ্গে সংগ্রাম করে উঠে আসতে হয়েছিল।
প্রথম জীবনে অভাব-অনটন আর দারিদ্র্যতার মধ্যদিয়ে গেছেন শওকত ওসমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তার ছিল মাত্র দুটো পাঞ্জাবি। একটি পরতেন, আরেকটি ধুয়ে শুকাতেন। ধোপদুরস্ত ছিলেন বলে কেউ টেরই পেতো না, তিনি কতটা আর্থিক অনটনে আছেন। অথচ সেই সময়েও কারও কাছে বিন্দুমাত্র সাহায্যের জন্য হাত পাতেননি। বরং শিরদাঁড়া উঁচু করে দেখিয়েছেন, মানুষ একাগ্রচিত্তে আর চরম অধ্যবসায়ে চাইলে কত দূর পৌঁছাতে পারে। অভাব, দারিদ্রতা, ক্ষুধা কোনকিছুই তাকে গন্তব্য থেকে হঠাতে পারেনি। তাইতো আজীবন তিনি চলেছেন আলোকিত মানুষ হয়ে।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন মাদ্রাসার শিক্ষক ক্লাসের এক ফাঁকে বলেছিলেন, ‘সব কিছুরই খোদা আছে, মানুষও একটি জীব তারও খোদা আছে।’ তখন শওকত ওসমান শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা হুজুর, আমাদের সেই খোদাকে কে সৃষ্টি করেছেন?’ তখন সেই শিক্ষক কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। মারতে গিয়েও কী ভেবে যেন মারেননি। মুক্তচিন্তার কারণে সেই বয়স থেকেই তাকে আজীবন লড়াই করতে হয়েছিল।
ঢাকা কলেজে থাকা অবস্থায় শওকত ওসমান ক্লাসে পাঠ্যবই পড়ান না বলে একবার ছাত্ররা অভিযোগ করতে গেলেন সেই সময়ের জাঁদরেল অধ্যক্ষ জালাল উদ্দিন আহমদের কাছে। অভিযোগ শুনে জালালউদ্দিন আহমদ বললেন, ‘শওকত ওসমানকে এই কলেজে রাখা হয়েছে পড়ানোর জন্য নয়। পড়ানোর জন্য অন্য শিক্ষকেরা আছেন। শওকত ওসমান এই কলেজে আছেন এটাই তো আমাদের গৌরবের।’ অথচ সেই অধ্যক্ষের সঙ্গে শওকত ওসমানের মতের মিল ছিল না।
শওকত ওসমান তার ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানপিপাসা ও জ্ঞান জিজ্ঞাসা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। শ্রেণীকক্ষে এসে পাঠ্যবই টেবিলে রেখে বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে বলতেন। শেক্সপিয়ার, বায়রন, মিলটন, তলস্তয়, গোর্কি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের জীবনসাহিত্য নিয়ে বলতেন। বলতেন, ‘এখন তোমাদের যৌবনকাল, এখনই বিদ্রোহ করার বয়স। এখনই সবকিছু ভেঙে ফেলার ও জয় করার সময়। এ সময়কে পাঠ্যবইয়ের গণ্ডিতে বন্দি রেখো না।’
শওকত ওসমানের রসবোধ ছিল অসাধারণ। তার মৃত্যুর ২৩ বছর আগে ১৯৭৫ সালেই তিনি ‘নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত’ রম্য রচনায় লিখেছিলেন, ‘কাল মারা গেছে শওকত ওসমান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন) রোববার তেইশে অঘ্রান ইমশাল। ইং…! ডাংগুলির ভাষায় ফিরে গেছে প্যাভিলিয়নে ক্লান্ত ব্যাট কাঁধে সমস্ত জীবন যা ঘুরিয়েছে অবাধে লেটকাটে পাকা—এবার সত্যি আউট। মরহুমের বয়স নিয়ে ঝুটমুট গবেষণা। কেউ বলে ত্রিশ, কেউ বাহাত্তর, কেউ যোগ করে আরও ছিল, ছিল ক্ষুর লেজ অপি—শতাধিক বয়সের ফল মানতে বাধ্য, বার্ধক্যেও ভীষণ চঞ্চল।’
নিজের মৃত্যুর অগ্রিম শোক সংবাদ লিখে রাখা আর নিজেকে নিয়ে পরিহাস করা একমাত্র শওকত ওসমানের পক্ষেই সম্ভব ছিল।
একুশে পদক, বাংলা একাডেমি, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত শওকত ওসমানের লেখায় যেমন ওঠে এসেছে তৎকালীন সমাজবাস্তবতা, অনাচার-অবিচার, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, প্রতিবাদের ভাষ্য, ঠিক তেমনি এসেছে জীবনবোধ, সময়ের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার অনন্ত অনুপ্রেরণা।
আজ ‘জাতির কথাশিল্পী’ প্রখ্যাত সাহিত্যিক শওকত ওসমানের প্রয়াণ দিবস। প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
‘জাতির কথাশিল্পী’ শওকত ওসমানকে কতটুকু জানি ইমরান ইমন মুক্তমত