Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রতিশ্রুতিশীল লেখকের মৃত্যু হয় না

ইমরান ইমন
১৯ মে ২০২৩ ১৬:১০

প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রথম প্রয়াণ দিবস আজ। ২০২২ সালের এই দিনে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।

তাঁকে নিয়ে আলোচনা আছে, সমালোচনা আছে–সব ছাপিয়ে তিনি একজন সৃজনশীল মানুষ। আমি তাঁর সৃজনশীলতাকে শ্রদ্ধা করি। তিনি নিরপেক্ষভাবে সমালোচনা করতে কাউকে ছাড় দিতেন না–এমনকি তিনি যে দলের আদর্শ লালন করতেন সেটিকেও। তাঁর সঙ্গে আমার লেখালেখির অনেক স্মৃতি রয়েছে, রয়েছে অনেক রাসায়নিক আলাপন।

বিজ্ঞাপন

একদিন পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় দুইজন লেখকের লেখা ছাপা হয়েছে। ওপরের অংশে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম এবং নিচের অংশে ইমরান ইমনের কলাম। সেদিন নিজ থেকেই তিনি আমাকে নক করলেন এবং আমার লেখার প্রশংসা করে বললেন, “ডিয়ার ইমরান ইমন, আই হ্যাভ র‌্যাড ইওর রাইট-আপ দ্যাট ওয়াজ পাবলিশড উইথ মাই রাইট-আপ। এক্সসিলেন্ট রাইট-আপ! ওয়েল থট্ অ্যান্ড কোয়াইট ম্যাচিওর রাইট-আপ। বেস্ট উইশ্যাষ!”

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো মানুষের বার্তা পেয়ে এবং আমার মতো একজন সামান্য লেখকের লেখার প্রশংসা শুনে আমি অভিভূত হয়েছিলাম সেদিন। সেদিন থেকে গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা শুরু। সুদূর প্রবাসে থেকেও ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি আমার সঙ্গে আলাপ করে যেতেন। চলতো আমাদের চিন্তা ভাগাভাগি।

দেশে মুক্তচিন্তার দুর্দশা নিয়ে আমরা আক্ষেপ করতাম, দেশে বিদ্যমান সমস্যা ও সংকটের আশু সমাধান নিয়ে আমরা আলাপ করতাম, বলতাম সম্ভাবনার কথা–একদিন ঠিকই আলোর দেখা মিলবে। আমরা পরস্পরের লেখা নিয়ে আলোচনা করতাম–এ পয়েন্ট আরও জোরালোভাবে লেখা যেত। এ পয়েন্ট এমন হতে পারতো–আরও কত কী…

বিজ্ঞাপন

বয়সে অনেক বড়ো হওয়ায় আমি তাঁকে ডাকতাম দাদা, আর তিনি আমাকে ডাকতেন নাতি। বহুদিন তাঁর মতো একজন বরেণ্য লেখকের পাশে আমার মতো একজন সামান্য লেখকের লেখাও ছাপা হয়েছে পত্রিকায় পাতায়। সেসব এখন সবই স্মৃতি। তিনি বলতেন, “ইমন–আমি তোমার লেখার নিবিড় পাঠক ও পর্যবেক্ষক। তুমি এদেশের অনেককেই ছাড়িয়ে যেতে পারবে খুব অল্প সময়েই, অল্প বয়সেই–সেটা সম্ভব শুধু তোমার চিন্তার বিচক্ষণতার জন্য। মনে রাখবে, একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখকের কখনও মৃত্যু হয় না। তোমার মধ্যে সে প্রতিশ্রুতিশীল লেখকের গুণটি আমি দেখছি। তোমার জন্য আমার অনুরাগ, ভালোবাসা ও শুভকামনা।” চিন্তার পরিপক্কতা আমাদের বয়সের ব্যবধান গুছিয়ে দিয়েছে।

একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ‘জয় বাংলা’, ‘যুগান্তর’ ও ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় কাজ করেছিলেন। দেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়তে তিনি কাজ করেছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর তাঁর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি তাঁকে খ্যাতি এনে দেয়। প্রথমে তিনি নিজেই গানটিতে সুর করেছিলেন। পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদ এ গানে সুরারোপ করেন এবং এ সুরেই এখন গানটি গাওয়া হয়। বিবিসি বাংলা বিভাগের দর্শকদের জরিপে এই গান বাংলা গানের ইতিহাসে তৃতীয় সেরা গানের মর্যাদা পেয়েছে। জীবদ্দশায় তিনি ৩৫টি বই লিখেছেন। সাহিত্য-সাংবাদিকতায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ আবদুল গাফফার চৌধুরী পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক, ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার এবং স্বাধীনতা পদক (২০০৯)।

কলাম লেখাকে তিনি এদেশে পুরোপুরি পেশাগত মর্যাদায় নিয়ে গেছেন। স্বয়ং এবিএম মূসা তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে “জাঁদরেল কলামিস্ট” হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং তাঁর গ্রন্থ “মুজিব ভাই”-এর ভূমিকা তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছেন। তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত বলেছিলেন, বিংশ শতাব্দিতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর একবছর। কিন্তু গাফ্‌ফার চৌধুরী একটা গীতিকবিতা লেখার পরে আর না লিখলেও তাঁর আয়ু বাংলা ও বাঙালির সমান।

সম্পাদকীয় পাতায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে মিস করব ভীষণভাবে। আমি হয়তো এখন লিখে যাবো, কিন্তু তিনি আর কলম চালাতে পারবেন না। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মাঝে–যেভাবে তিনি আমাকে বলে গিয়েছেন–একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখকের কখনও মৃত্যু হয় না। জাগতিক নিয়মে তাঁর শরীরের প্রস্থান ঘটলেও তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। ওপারে নিশ্চয়ই ভালো থাকবেন। প্রয়াণ দিবসে জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ইমরান ইমন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর