জীববৈচিত্র্য দিবস; অস্তিত্ত্ব সংকটে প্রকৃতি ও প্রাণ
২২ মে ২০২৩ ১৪:৪৪
২২ মে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস। সারাবিশ্বেই দিবসটি পালন করা হয়। আজ যখন বিশ্বের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে তখন এই দিবসটির গুরুত্ব অপরিসীম। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থান। মানুষ ও প্রকৃতি মিলিয়েই এই সুন্দর ধরণী। একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্ব যেন অর্থহীন। কিন্তু ক্রমাগতভাবে নিজের স্বার্থে মানুষ প্রকৃতির এতটাই বিরুদ্ধাচরণ করেছে যে আজ প্রকৃতি বিরুপ। হুমকির মুখে বহু প্রাণ। জীববৈচিত্র্য ধংসের নানা আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত আমাদের প্রকৃতির বা প্রাণের বিপক্ষে দাড় করিয়েছে। সৃষ্টির শুরুতে মানুষ বুঝতে পেরেছিল প্রকৃতিই তাদের বেঁচে থাকার পথ। তাদের খাদ্য,আশ্রয় আর নিরাপত্তা সবই দিতে পারে প্রকৃতি। তাই প্রকৃতির ওপর মানুষের দখল বাড়তে থাকে। প্রতিনিয়ত অত্যাচারের ফলে প্রকৃতি হয়েছে ভারসাম্যহীন। প্রকৃতির এই ক্ষত যে কতটা ভয়ানক হতে পারে তা মানুষ প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। আবার বুঝতে পারলেও তা থেকে শিক্ষা কোনোদিনই নেয়নি। প্রকৃতির প্রতিশোধ অবশ্যই ফিরে আসে। ফিরে আসে বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে। জীববৈচিত্র্যই পৃথিবীর সৌন্দর্য। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হলো কার্বন নিঃস্বরণ। প্রতিটি দেশই শিল্পে উন্নত হওয়ার প্রতিযোগীতায় রয়েছে। এই প্রতিযোগীতায় কার্বন নিঃস্বরণ ঘটছে। বিশ্বের ৪০ শতাংশ কার্বন নিঃস্বরণকারী দেশ হলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের এই কর্মকান্ড বায়ু,পানি,মাটি ও সবুজায়নের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। আমরা মূলত এরকম বড় বড় শিল্পোন্নত দেশের কার্বন উৎপাদনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার। তার সাথে রয়েছে নিজেদের ভারসাম্যহীনতা। জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় ফ্রান্সের রাজধানী প্যাি রসে ২০১৫ সালে সম্পাদিত বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি ছিল একটি বড় পদক্ষেপ। এতে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলো আশাবাদী ছিল যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোকে আমরা পাশে পাবো। বাস্তবিকভাবে যদি বর্তমানে এর অগ্রগতি দেখা যায় তাহলে তা সামান্যই। প্রতি বছর বিশ^ নেতারা জলবায়ু সম্মেলনে একত্রিত হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি গত দুই বছর দেখা যায়নি। এই জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের দেশের দায় তুলনামূলকভাবে কম কিন্তু ফল ভোগ করছি আমরাই বেশি। বিশ্বের ১৮০ টি দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাংলাদেশের মত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা। যে অর্থ ঝুঁকি মোকাবেলায় কাজ করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তিত হয়েছে এবং সারাবিশ্ব এখন এর ফল ভোগ করছে। উন্নত বা অনুন্নত দেশ কেউ এর প্রভাব থেকে বাদ যাচ্ছে না। তবে সক্ষমতা বিবেচনায় এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণে কারও ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সামর্থ রয়েছে আর কারও সে সামর্থ্য কম। আজ জলবায়ু পরিবর্তনে দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়। এক. জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় করণীয় ঠিক করা। দুই. অভিযোজন করা অর্থাৎ পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া। গত বছর বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সব দেশ সম্মত হয়েছে। কার্যত গত পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের খারাপ দিক বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। তীব্র শীত বা খরা, অতিবৃষ্টি, প্রলয়ঙ্করী ঝড়, তীব্র তাপদাহ, অসময়ে বন্যা,ভূমিধস, টর্ণেডো ও সুনামীর মত মারাত্বক সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশ্বকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আমাদের দেশে বহু নদনদীর আজ অস্তিত্ব নেই। বহু প্রাণী আজ বইয়ের পাতায়। গাছাপালার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
আমাজানকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হলেও বাস্তবিকপক্ষে প্রতিটি বনাঞ্চলই পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবে কাজ করে। প্রতিটি বনাঞ্চল রক্ষা করার দায়িত্বই মানুষের। আজ উন্নয়নের নামেও আমাজন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যে উন্নয়নের নামে বনাঞ্চল ধ্বংস করে সম্পদের পাহাড় গড়ছি সেই সম্পদ একদিন মানুষের কাধেই বোঝা হয়ে সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হবে। মানুষ যে প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছে বা ধ্বংস করেছে তা পৃথিবী উন্নয়নের তাগিদে। নগর সভ্যতার বিকাশ লাভ হয়েছে আর বিপরীতে বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন মানুষের অস্তিত্তকেই আজ হুমকিতে ফেলেছে। পৃথিবীর বাতাস ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠছে। অথচ এই পৃথিবীর বায়ুমন্ডল একসময় সুশীতল, বিষমুক্ত ছিল। সেই আগের মতো বাযুমন্ডল পেতে হলে পক্ষে এক লাখ কোটি গাছ লাগালে বায়ুমন্ডল হয়ে উঠবে সেই ১০০ বছর আগের মতো। এমনটাই জানিয়েছেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখে সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ইটিএইচ জুরিখ) একটি গবেষণা। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ’সায়েন্স’ এ গবেষনাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধুমাত্র গাছ লাগালেই আসন্ন সংকট থেকে সমাধান সম্ভব। বৈশি^ক উষ্ণায়নের জেরে যে হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে তাতে অনেরক নিচু শহর মারাত্বক হুমকিতে রয়েছে। আর শিল্পায়নের জোয়ারে বাতাসে কার্বনডাইঅক্সাইড বেড়েই চলেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এক লাখ কোটি গাছ লাগাতে জমির অভাব হবে না। হিসেব করে দেখিয়েছে, যদি আপনার সদিচ্ছা আর আন্তরিকতা থাকে দ্রুত এক লাখ কোটি গাছ বসিয়ে ফেলার তাহলে অন্তত জায়গার অভাবে সেসব গাছের বেড়ে উঠতে ও বেঁচে থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না।
ক্ষতির প্রকারে পার্থক্য থাকলেও বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোও রয়েছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের একটি হলো এর ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার নারীদের গর্ভের সন্তান মারা যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ হিসেবে বলছেন, মাটিতে বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ। ফসল নষ্ট হচ্ছে, মরে যাচ্ছে মিঠা পানির মাছ, কমে যাচ্ছে বিশুদ্ধ খাবার পানি। সেই লবণাক্ত পানি পানের কারণেই বাড়ছে রোগ আর গর্ভের সন্তান মৃত্যুর ঝুঁকি। তারপরও আমাদের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ জীববৈচিত্র্যই হলো পৃথিবীর প্রাণ। প্রকৃতি অরক্ষিত করে আমরা নিজেদের সুরক্ষিত করতে পারি না। মানুষের খামখেয়ালিপনায় হারিয়ে যেতে বসা বহু উদ্ভিদ,প্রাণীর অস্তিত্ত রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন সমণি¦ত পরিকল্পনা। কোনো একক প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। আজ হয়তো আমরা ভাবছি জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হলে আমাদের আর কতটুকু ক্ষতি হয়? কিন্তু একদিন এর মাসুল আমাদের দিতেই হবে। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ ঠিক নিতে জানে। আমাদের বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন বহুবার ঘূর্ণিঝড়ে নিজেন বুক পেতে দাড়িয়ে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেছে। তা কি আমরা ভুলতে পারি? অথচ এই বনের গাছ কেটে, প্রাণীকুল বিনষ্ট করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ের ফায়দা তুলতে ব্যস্ত। তাই সবাই মিলে দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। রক্ষা করতে হবে প্রকৃতি ও প্রাণ।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
অলোক আচার্য জীববৈচিত্র্য দিবস; অস্তিত্ত্ব সংকটে প্রকৃতি ও প্রাণ মুক্তমত