কাদের সিদ্দিকীর ফতোয়া বনাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
২৩ মে ২০২৩ ১৬:০২
এটি অনস্বীকার্য যে, মহান মুক্তিযুদ্ধই বাঙালি জাতির শ্রষ্ঠতম গর্ব ও অহংকারের অধ্যায়। অপরদিকে, এই মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতিই আমাদের মহান স্বাধীনতা যা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর প্রায় দু’শো বছর পরাধীনতার নির্মম শৃঙ্খলে বাঙালি জীবন বিষন্ন বেদনে বিপন্ন হয়ে উঠেছিল। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের অম্লস্বত্বে বাঙালিজাতি শৃঙ্খল মুক্ত হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক অপকৌশলের আশ্রয়ে সৃষ্ট শোষণনীতি বৃটিশকে ছাপিয়ে বাঙালি জীবনকে আরো বিষন্ন বিপন্ন করে তুলেছিল। বিশেষ করে ধর্মের অপব্যবহারের মাধ্যমে দাসত্বে আবদ্ধ রাখার নষ্ট মানসে পূর্ব বাঙালিদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের যে নিষ্পেষণ চালানো হয়েছিল তা সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশের মধ্যেও দেখা যায়নি।ফলে, পূর্ববাঙালিদের সাংস্কৃতিক অধিকার তাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে এক বিশেষ উপযোগ সৃষ্টি করেছিল যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক সৃষ্ট বাঙালিদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক প্রবঞ্চনা ক্রমশঃ পুঞ্জীভূত হতে-হতে তা প্রবল মুক্তিকামী শক্তিতে রুপ নেয় এবং বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ও অগ্নিমুখর নেতৃত্বে ‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সেই শক্তির বৈপ্লবিক প্রকাশ ঘটে।রক্তস্নাত সুদীর্ঘ নয় মাসে ত্রিশ লাখ বাঙালি নারী পুরুষের তাজা প্রাণ, দুই লক্ষাধিক নারীর সম্ভ্রম ও বহু রক্ত ও পঙ্গুত্বের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই সাধনার স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধে যারা বীরত্ব পূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে কাদের সিদ্দীকি একজন। মুক্তিযুদ্ধে অকুতোভয় অবদানের জন্য তিনি বীরউত্তম পদক প্রাপ্ত হন এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পরবর্তীতে ‘বঙ্গবীর’ উপাধিতে ভূষিত হন। এমন উচ্চতর ভূষণ একমাত্র তিনিই পেয়েছেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি বেশ আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তি। একজন সরব রাজনীতিক হিসাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি কখনো -কখনো বেশ বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছেন। বিগত দিনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে যখন সমগ্র দেশ আলোচনা মুখর তখন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা সাবেক আলবদর কমান্ডার মীর কাশিম আলীর মালিকানাধীন দিগন্ত টিভি চ্যানেলের টকশো-তে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গেতেন।পাশাপাশি জামায়াতের মুখপাত্র দৈনিক নয়া দিগন্ত ও দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নিয়মিত কলাম লিখতেন।অভিযুক্ত কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লা ও রাজাকার বাহিনী প্রধান নিজামীর মুক্তির জন্য তিনি প্রকাশ্যে দাবীও তুলেছিলেন। এমনকি রাষ্ট্রীয় অস্থিতিশীলতার দায়ে অভিযুক্ত দিগন্ত টিভি চ্যানেল ও দৈনিক আমার দেশ তখন সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে তিনি সেগুলো খোলার পক্ষে প্রকাশ্যে জ্বালাময়ী হয়ে ওঠেন। তার এহেন কর্মকান্ডে সচেতন মহল সহ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের তরুণ সমাজের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল।তখন যুদ্ধাপরাধীদের কঠোর বিচারের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে গড়ে ওঠা শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের গনজাগরণ মঞ্চের প্রবল জোয়ার থেকে কাদের সিদ্দিকীকে নব্য রাজাকার হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়।সে সময় এই কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধু কে ‘রাজাকারের কমান্ডার’ বলে চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেন!ঐ সময় তার আপন বড় ভাই তৎকালীন আওয়ামী সরকারের পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর এক আলোচনায় কাদের সিদ্দিকীর বিরোধিতা করে বলেছিলেন,”তরুণ প্রজন্ম তাকে (কাদের সিদ্দিকী)নব্য রাজাকার বলায় তিনি এখন বেসামাল।তিনি মধ্যরাতে দিগন্ত টিভির টকশো তে অংশ নিয়ে ও নয়া দিগন্তে কলাম লিখে যুব সমাজ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।তাই আমিও তাকে প্রত্যাখ্যান করছি।ধিক!তাকে ধিক!তিনি আরো বলেন,”একাত্তরে তুমি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলে তোমার নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য,বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে নয়।’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তুমি যে অস্ত্র ধরেছিলে তা এই হত্যার প্রতিশোধ নিতে নয়।তোমার জীবন বাঁচাতে।তাই আমি তোমার বর্তমান ভূমিকাকে ধিক্কার জানাই।ধিক!” উল্লেখ্য গত ২৯ এপ্রিল ২০২৩ এ টাঙ্গাইলের সখিপুরে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে সখিপুর বাজার বণিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ খানের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় বিধি মোতাবেক তাকে ‘গার্ড অব অনার’ জানাতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউ এন ও) ফারাজানা আলম উপস্থিত হন।সে সময় কাদের সিদ্দিকী কোনো মহিলার দ্বারা গার্ড অব অনার জানানোকে শরিয়ত পরিপন্থী বলে বাধা প্রদান করেন।এ সময় তিনি তাকে বেয়াদব বলেও ভর্ৎসনা করেন।উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,”এখন বঙ্গবন্ধু থাকলে এখানকার অনেক অফিসারদেরকে লাথি মেরে ঢাকা পাঠিয়ে দিতাম।”তার এই গর্হিত আচরণ সামাজিক শালীনতার সর্বশেষ অংশটুকুকেই শুধু ধ্বংস করেনা উপরন্তু রাষ্ট্রের প্রচলিত সংবিধানকেও চ্যালেঞ্জ করে।সংবিধানের ২৮(১) অনুযায়ী ,”কেবল ধর্ম,গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষ ভেদ বা জন্ম স্থানের কারনে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেনা।”২৮(২) অনুযায়ী,”রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।”২৯(১) মতে, ” প্রজাতন্ত্রের নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।২৯(২) অনুযায়ী, “কেবল ধর্ম,গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরষ ভেদ বা জন্ম স্থানের কারনে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হইবেনা কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবেনা।”বিগত দিনেও তিনি কুখ্যাত রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীদের মতো প্রকট রুপে নারী বিদ্বেষী অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন।আমাদের শোষণহীন সমাজ বিনির্মানে নারীর অবদান অস্বীকার করার নুন্যতম সুযোগ নেই। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রীতিলতা,সরোজিনী নাইডু সহ আরো অনেক মহিয়সী নারীর কৃতিত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক বিসর্জন কে বাদ দিয়ে এদেশের রাজনীতির ভীত ভাবা যায়না।বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত,কামিনী রায়,সুফিয়া কামাল,নীলিমা ইব্রাহিম, ইলা মিত্র, কল্পনা দত্ত প্রমুখ ইতিহাসের কিংবদন্তি মহিয়সী নারীগণ যাঁরা কুসংস্কারের আঁধার দুরিয়ে সমাজকে আলোকিত করার মহান ব্রতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।পরিশীলিত সমাজ গঠনে তাঁদের অবিস্মরণীয় অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।বাঙালির প্রবাদ প্রতিম মহাপুরুষ জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের কালজয়ী নেতৃত্বের নেপথ্যে দেশমাতৃকার সেবায় মহান ব্রত সাধনে যিনি অকৃত্রিম ত্যাগ দিয়েছিলেন সেই মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছাও বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।অসংখ্য নারীর জীবন ও দুই লক্ষাধিক নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই সুদীর্ঘ সাধনার স্বাধীনতা।সুনাম গঞ্জের শাল্লা উপজেলার উজান গাঁও গ্রামের বীরাঙ্গনা পিয়ারা বেগম, মুক্তাবান বিবি,জমিলা’র জীবন্ত বিদগ্ধ দীর্ঘশ্বাস আজো বাংলার আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়। জীবন্ত বীর প্রতীক তারামন বিবি ও সিতারা বেগমের মহাবিপ্লবী নারীত্ব প্রজন্ম পরম্পরায় কালান্তরে অনুরণিত হতে থাকবে;তৎকালীন রক্ষণশীল ঘুনে ধরা সমাজের জরাজীর্ণতা পেরিয়ে নিদারুণ প্রান্তিক স্তরের অবলা নারী হয়েও তাঁরা যে অকুতোভয় ঐতিহাসিক অবদান দেশমাতৃকার জন্য রেখেছিলেন তা জনাব কাদের সিদ্দিকীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয় বললে অত্যুক্তি হবেনা।নির্যাস নিরপেক্ষ বিচারে,বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অবদানকেও নুন্যতমও অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যিনি একজন নারী হয়েও একুশে আগষ্টের ভয়াবহতম গ্রেনেড হামলা সহ ১৯-২০ বার প্রকাশ্য দেশবিরোধী চক্রের হত্যার ষড়যন্ত্র হতে বেঁচে যেয়েও যিনি দেশের ও জনগণের অস্তিত্ব রক্ষায় সেবাব্রতী হয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।এদেশের বিগত তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতাও নারী।বর্তমান সংসদের অত্যন্ত পরিমার্জিত স্পীকারও একজন নারী।বর্তমান সংসদে ৫০ টি সংরক্ষিত আসনে নারী যারা জনগণের সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন।এরকম অসংখ্য নারীর মনশীল মেধা ও প্রতিভার অংশীদারিত্বে তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা কাটিয়ে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিষ্ময়কর রাইজিং কান্ট্রি হিসাবে সমাদৃত হয়েছে।অথচ কাদের সিদ্দিকীর মতো এমন রাষ্ট্রীয় ও বিশেষ খেতাব প্রাপ্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছ থেকে এমন নারী বিদ্বেষী আচরণ এবং প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার ‘রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার’ এ বাধা প্রদান স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনাকে চ্যালেঞ্জ করে বৈকি!আঘাত হানে লাখো শহীদের পুণ্যাত্মায়।রাষ্ট্রীয় উচ্চতর পদক প্রাপ্ত এমন সেলিব্রিটির কাছ থেকে এমন গর্হিত আচরণ মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে সন্দিগ্ধ করে তুলবে। আমাদের মনে রাখা উচিৎ, ধর্মান্ধ কূপমন্ডুকতা থেকেও পূর্ববাংলাকে রক্ষা করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন মানবিক বাংলাদেশ সৃষ্টি করাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সৃজনশীল দর্শন।একজন রাষ্ট্রীয় সেলিব্রিটি হিসাবে রাষ্ট্রের সেই আদর্শগুলোকে বারংবার আঘাত করে ‘বঙ্গবীর’ উপাধি তিনি ধারন করার কতটুকু নৈতিক অধিকার রাখেন তা এখন সচেতন মহলে একটি জ্বলন্ত প্রশ্ন হিসাবে দেখা দিয়েছে।কেননা, কৃতিত্ব অর্জনের চেয়ে কৃতিত্ব রক্ষা করা বড়ই কঠিন।যে আদর্শের উপর ভিত্তি করে কৃতিত্ব সৃষ্টি হয় সেই আদর্শ যদি ব্যক্তির কৃতকর্মের দ্বারা বিনষ্ট হয় তবে সেই কৃতিত্বের অস্তিত্ব থাকেনা।আমার মনে হয় কাদের সিদ্দিকী তার সেই বীরত্বের কৃতিত্ব হারাতে বসেছেন।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
কাজী মাসুদুর রহমান কাদের সিদ্দিকীর ফতোয়া বনাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুক্তমত