আমাদের বিদ্রোহী কবি
২৫ মে ২০২৩ ১৩:৪৬
বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহ শব্দটি প্রকৃতপক্ষে ছিল সমাজের অসাম্যের বিরুদ্ধে। সেই অর্থে তিনি বিদ্রোহ করেছেন। সমাজের বদলের জন্য কাজী নজরুল ইসলামের মতো মানুষের সাহসী উচ্চারণ বিদ্রোহী মনোভাব খুব বেশি প্রয়োজন। তিনি শিখিয়েছেন কিভাবে শির উচু করে সমাজে বাঁচতে হয়। মাথা তুলে দাঁড়াতে হয়। শৃঙ্খল ভাঙার সাহস তার কবিতা জুগিয়ে আসছে বহুকাল ধরেই। চেতনার বোধদয় বলতে আমরা যা বুঝি তা কাজী নজরুল ইসলামে কবিতায় রয়েছে। তার লেখনী যেন এক শাণিত অস্ত্র।
নজরুলের কবিতায় অসাম্য বলতে বোঝায় ভেদাভেদ বা পার্থক্য। তিনি পাপী-তাপীদেরও দূরে ঠেলে দেননি। তিনি বলেছেন, ‘সাম্যের গান গাই/যত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই। এ পাপ মুলুকে পাপ করেনিকো কে/ আছে পুরুষ নারী? আমরা তো ছার; পাপে পঙ্কিল পাপীদের কান্ডারী।’ এই ভেদাভেদ মানুষের সাথে মানুষের, মানুষের ধর্মের, গোত্রের, জাতির, বর্ণের, দেশের, সমাজের এবং মানুষের হাতে গড়া কিছু শৃঙ্খল যা তিনি ভাঙতে চেয়েছেন। তিনি ঘৃণা করেছেন সকল নিচুতার, হীনতার। তিনি স্রষ্টার কাছেও ফরিয়াদ করেছেন যেন তার মন কখনও নিচুতার প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ না হয়। তিনি আকুল মিনতি করে বলেছেন, ‘ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমার /হৃদয়ের পরিসর /যেন সম ঠাঁই পায় /শত্রু-মিত্র-পর।’
নজরুলের বুকে ঠাঁই ছিলো সব ধরনের মানুষের। তাতে কোনও জাতপাতের বালাই ছিল না কোনওদিন। এসব দেখেশুনে তিনি বিদ্রোহ করেছেন। তার অন্তর এসব কলুষতার, মূর্খতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। তার কবিতাগুলো যেন এক একটি বহ্নিশিখা। সমাজের সব অনিয়ম ভাঙতেই তিনি লিখেছেন।
মাথা উঁচু করে বাঁচার অনুপ্রেরণা কাজী নজরুল জুগিয়েছে যুগের পর যুগ। দুনিয়ার যত মজলুম, মজুর, তাতী, কৃষক, জেলে তাদেরই তিনি অধিকার ফেরাতে চেয়েছেন। চেয়েছেন অসাম্প্রদায়িকতার মন্ত্র সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে। তিনি জানতেন, সবকিছুর ক্ষমা হলেও ক্ষমা হয়না নিচুতার। তিনি বিশ্বাস করেছেন-বল গেছেন, ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’। বিদ্রোহী কবিতায় তাই লিখেছেন, ‘বল বীর /বল উন্নত মম শির /শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রি ‘। বিশ্বজুড়েই যেখানে সর্বত্রই আজ সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা, অরাজকতা, রক্তপাত, ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানোর ঘটনা ঘটছে। সেখানে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এইসব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, স্বচ্ছ এক মানুষ। যিনি সত্যিকার অর্থেই একজন মানুষ ছিলেন। যিনি প্রভেদ করতে শেখেননি। সাহেব-কুলি সব এক কাতার অর্থাৎ মানুষের এক রেখায় দাড় করিয়েছেন।
মানুষ, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সাম্য, একতা এসব মানবিক উপাদান বহু কবির কবিতায় যুগে যুগে প্রতিধ্বনিত হয়েছে এবং আজও যারা লিখছেন তাদের কবিতায়ও তা হচ্ছে। কারণ এসব মানবিক বোধ কবিকে ভাবায়। কবিকে কলম দিয়ে এসবের বিরুদ্ধে কথা বলতে অনুপ্রাণিত করে। কারণ কবিতা তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা। কবিতা তখন হয়ে ওঠে শাণিত অস্ত্র। কবি তার কলম দিয়ে যুদ্ধ করে। সবাইকে ছাপিয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অনন্যসাধারণ। যার বিদ্রোহ ছিল শাসকের বিরুদ্ধে, প্রথাগত শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে,কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, অসাম্য নীতির বিরুদ্ধে,বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে, জাতিগত বিভেদের বিরুদ্ধে, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে।
শাসকের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেই অথবা সমাজের গেঁথে থাকা শিকল ভেঙে কবি নজরুল মানুষকে চিনেছেন তার মনুষ্যত্ব দিয়ে। বন্দীত্বের শিকল তিনি ভাঙতে চেয়েছেন তার কবিতার শব্দ দিয়ে। ‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ভেঙে ফেল কর রে লোপাট/রক্ত-জমাট, শিকল পূজার পাষাণ বেদী।/ ওরে ও তরুণ ঈশান/বাজা তোর প্রলয় বিষাণ/ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর ভেদি।’ শাসকের জুলুমের প্রতি এই সকন্ঠ অকুতোভয় উচ্চারণ কাঁপিয়ে দিয়েছে শাসকের ভিত। তিনি তার কবিতার জন্য কারাবরণও করেছেন। তবু সত্য উপলদ্ধি থেকে পিছপা হননি। তার হৃদয় ছিল হিমালয়সম। যেখানে প্রভেদের কোনও ঠাঁই ছিল না কোনওদিন। তিনি হৃদয়কে মনে করতেন মন্দির স্বরুপ। এই হৃদয়ের মাঝেই তিনি খুঁজেছেন ঈশ্বরকে। তিনি বলেছেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই/এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনও মন্দির-কাবা নাই’। তিনি কাউকে তার বর্ণ দিয়ে, দারিদ্রতা দিয়ে কিংবা সমাজের প্রচলিত ধনী-গরীবের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করেননি। যে বাধা আমরা আমাদের সমাজে আজও ভাঙতে পারিনি, যে কুসংস্কার আজও সমাজে সংস্কার রুপে প্রভেদ সৃষ্টিতে ব্যস্ত, সেই শৃঙ্খল আমরা না ভাঙতে পারলেও তিনি ভেঙেছিলেন তার কবিতায়। জন্মতিথিতে এই মহান কবিকে স্মরি পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
লেখক: শিক্ষক ও লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই