প্রতিবাদের ভাষা প্রতিহিংসা নয়
২৬ মে ২০২৩ ১৭:৩৭
জীবন যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে প্রতিনিয়তই পার হতে হয় প্রতিবাদ, সংগ্রাম, আন্দোলন, বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। এই রণাঙ্গনে কেউ কারো জন্যে নয়; কেউ কারো পরিপূরকও নয়। প্রত্যেকেই একক, প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র। প্রত্যেকেই বন্দী তার ‘নিজ-নিজেস্ব’ নামক গণ্ডিতে। এই গণ্ডির বাইরে গিয়ে চিন্তা করার ফুরসত যেন কারো নেই! তাই নিজের দাবী-দাওয়া, ন্যায্য পাওনা, অধিকার নিয়ে কথা বলতে হয় নিজেকেই। নিজের সাথে হওয়া অন্যায়, জুলুমের প্রতিবাদে স্বেচ্ছার হতে হয় নিজেকেই। এই প্রতিবাদ করতেই হবে। এই দাবী জানাতেই হবে। নতুবা টিকে থাকা দায় হবে। নিজের অধিকারটুকু, ন্যায্য পাওনাটুকু অন্যকে বিলিয়ে দেবার জন্য কেউ পৃথিবীতে আসেনি। বেঁচে থাকার জন্য, জীবন রণাঙ্গনে টিকে থাকার জন্য তাই আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রতিবাদ চালিয়ে যেতেই হবে অনবরত। তবে সে প্রতিবাদেরও রূপ আছে, কাঠামো আছে; রং আছে, ঢং আছে। কেবল সুর তুললেই হবে না; সুরের সাথে তাল, লয়, মাত্রা মিলিয়ে মাধুর্যতা সৃষ্টি হচ্ছে কিনা কিংবা জটলা পাকিয়ে বেসুরা তৈরি হচ্ছে কিনা সেদিকেও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। নিজের ন্যায়সঙ্গত দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য; নিজের অধিকার ফিরে পাবার জন্য অন্যের অধিকার হরণ করে নেওয়া বা সম্পদ নষ্ট করে ফেলার অধিকার কারো নেই। এমনটা কখনোই সমীচীন নয়; বরং ঘোর অন্যায়। এই অন্যায়ের চর্চা সামাজিক বিশৃঙ্খলাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। প্রতিবাদের ভাষা হবে যৌক্তিক, আর পন্থা হবে ন্যায়সঙ্গত। প্রতিবাদের খোঁচায় যে ক্ষত সৃষ্টি হবে তার তিক্ততা পৌঁছাবে শুধু অন্যায়কারীর দিকে, বিরুদ্ধাচরণের অঙ্গুল উঠবে কেবল সুনির্দিষ্ট দোষীর বিরুদ্ধে। সমাজের সাধারণ মানুষ বা আমজনতা কোন অবস্থাতেই তার ভুক্তভোগী হবেন না।
দেশে প্রায়শই রাজনৈতিক বা ধর্মীয় আন্দোলনের নামে ঘরে, বাইরে, রাস্তায় সহিংসতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। পুড়িয়া দেওয়া হচ্ছে যানবাহন, ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে দোকানপাট, ককটেল-বোমা ফুটিয়ে আহত করা হচ্ছে সাধারণ পথচারীদের। আন্দোলনের নামে এই সহিংসতার চর্চা অবশ্য নতুন কিছু নয়; চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু প্রতিবাদ জানাবার বা অধিকার আদায়ের ভাষা তো এমনটা নয়। প্রতিবাদের ভাষা বস্তুনিষ্ঠ। সেখানে প্রতিহিংসা বা ব্যক্তিগত আক্রোশ কাম্য নয়। ধরুণ আপনার সাথে ঘটে যাওয়া মহা কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আপনি একটি নির্দোষ গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করলেন, এখন এই বাহনের মালিক তার সাথে ঘটা এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এবার কোন বাহনকে দগ্ধ করবেন?
গত কয়েক বছরে আমাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা, আন্দোলন-সংগ্রাম নজর কেড়েছে দেশবাসীর। তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। নিজেদের দাবীতে অনড় থেকেছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থেকেছে। দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র নিয়ে ভবিষ্যৎ কর্ণধরদের এমন ভাবনা, এমন বীরুত্বপূর্ণ আচরণ আমাদেরকে দারুণ আশাবাদী করে তোলে। কিন্তু হতাশার কথা হলো প্রতিবাদের ভাষাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই অপসংস্কৃতি থেকে তারাও মুক্ত হতে পারেনি পুরোটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের দ্বারা যানবাহনে অগ্নিসংযোগের খবর আমাদের কানে এসেছে; বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, শ্রেণীকক্ষ ভাংচুরের মত ঘটনা আমরা দেখেছি। এ দায় অবশ্য পুরোটা তাদের নয়। তারা তরুণ, তারা নবীন। তারা যা শুনবে, যাই দেখবে তাই শিখবে; কাজে-কর্মে তার-ই প্রতিফলন ঘটাবে।
মানুষের মত প্রকাশের মাধ্যমই হলো ভাষা। প্রাগৈতিহাসিক কালে পাথরে ছবি এঁকে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ হওয়ার কথা আমরা জানতে পারি ইতিহাসের মাধ্যমে। যুগে যুগে মানুষের প্রতিবাদের ভাষার বৈচিত্রতা এসেছে সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে কিংবা মানুষের ন্যায্য অধিকারে। একটি প্রতিবাদের ভাষা ধারণ করতে পারে ভিন্নতা ক্ষেত্র বিশেষে, কখনো বা বাক্য দিয়ে বা কখনো নীরবে, অনশনে অথবা আরো অনেক বিচিত্র উপায়ে। প্রতিবাদকে কখনোই খাটো করে দেখার প্রয়াস করা উচিৎ নয়। প্রতিবাদ করতে দরকার হয় সমাজের তথাকথিত নিয়মের ছকের বাইরে গিয়ে এর বিপরীত হাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো দুঃসাহসিকতা। নির্জীব মানুষের খোলস থেকে বের হয়ে একটি ভাষায় নিজেকে তুলে ধরা। সত্যকে আলিঙ্গন করার স্পর্ধা, সত্যকে আবাহন জানানোর প্রক্রিয়া। প্রতিবাদ প্রত্যেকের গণতান্ত্রিক অধিকার। এই নিয়ে কারও কোন দ্বিমত থাকতে পারে না, তবে প্রতিবাদের ভাষা কেমন হবে তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, প্রতিবাদের ভাষা যে সহিংস হবে না, প্রতিবাদে পুড়ে অঙ্গার হবে না থানা, সরকারী অফিস, রেল স্টেশন আর বেসরকারী বাসা আর প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। এর পক্ষে অচল যে কোন যুক্তি। প্রতিবাদের ভাষাকে হতে হবে যুগোপযোগী। সময় উপযোগী। আন্দোলন, সংগ্রাম বা প্রতিবাদ জানাতে আবেগ প্রয়োজন। তবে বিবেক বর্জিত হলে চলবে না। খোলা রাখতে হবে বিবেকের জানালা। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্র গুলোতেও মাঝেমধ্যে নাগরিকদের অধিকার ক্ষুন্ন হয়ে থাকে। তারাও প্রতিবাদ জানান। বিদ্রোহ, আন্দোলন, সংগ্রামে অংশ নেন। তবে তাদের প্রতিবাদের ভাষা ভিন্নতর। সে ভাষায় রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগত সম্পদের বা জান-মালের ক্ষতি সাধন করে নিজেদের দাবি উপস্থাপন করার ঘটনা থাকে না। তাদের প্রতিবাদেও থাকে নান্দনিকতার ছোঁয়া। আমাদেরকেও এই প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আমরা প্রতিনিয়তই সমৃদ্ধ হচ্ছি, আধুনিক হচ্ছি। তাই আমাদের প্রতিবাদের ভাষাকেও হতে হবে অত্যাধুনিক। কেবল পেশিবল আর কণ্ঠের জোড় ব্যবহার করেই অন্যায়কারীকে কাবু করা যাবে না । প্রয়োজন সুকৌশল আর দূরদর্শিতার। অন্তত ইতিহাস সে কথা-ই বলে।
লেখক: কলাম লেখক
সারাবাংলা/এজেডএস