ঢাকার নিয়মিত অগ্নিকান্ড এবং অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রসারে ব্যাঘাত
৩১ মে ২০২৩ ১৬:৪৫
পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে গত ৫ বছরে ১ লাখ ১০ হাজার ৪৯২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে । এসব ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। সময়ে সময়ে অগ্নিকান্ড আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা প্রকার ক্ষতির সমুখীন করছে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই বেশিরভাগ অগ্নিকান্ড ঘটে থাকে ঢাকায় ,এবং অগ্নিকান্ডের কারণ অনুসন্ধান করে দেখা যায় গ্যাসের চুলা, খোলা চুলা, শর্টসার্কিট, সিগারেটের আগুন, গ্যাসলাইনের ছিদ্র, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক স্থাপনা বা যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান বা সামগ্রী, ঘিঞ্জি পরিবেশ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সরু রাস্তা দিয়ে উদ্ধারসামগ্রী পৌঁছাতে কষ্টসাধ্য, অগ্নি প্রতিরোধের ব্যবস্থা বিল্ডিংয়ে না থাকা বা মেয়াদোত্তীর্ণ ব্যবস্থা, ঢাকার আশপাশে বা মধ্যের নদী-খালের পানিশূন্যতার কারণে উদ্ধার কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে।
কিছুদিন আগের বঙ্গবাজার অগ্নিকান্ড আর একবার আমাদের ব্যাবসায়িক শ্রেণী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তথা অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেট ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকান পুড়ে ব্যবসায়ীদের মালামাল ও অবকাঠামোগত প্রায় ৩০৩.০৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
অগ্নিকাণ্ড যেভাবেই ঘটুক, তা আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে _
চাকরির ক্ষতি: অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যবসাই ছিল ছোট ও মাঝারি আকারের উদ্যোক্তা (এসএমই), যা ঢাকার কর্মসংস্থানের একটি প্রধান উৎস। এই ব্যবসাগুলি বন্ধ হওয়ার ফলে অনেক শ্রমিক এবং তাদের চাকরি হারানো এবং আয় হ্রাস পেয়েছে।
সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধা: আগুন সরবরাহ চেইন এবং বাণিজ্য প্রবাহকেও ব্যাহত করেছে, বিশেষ করে টেক্সটাইল এবং ইলেকট্রনিক্সের মতো শিল্পে। এই ব্যবসাগুলির জন্য পণ্য সঠিক সময় সরবরাহ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিলম্ব পণ্য সরবরাহ এইসব ব্যবসা কে ক্ষতির সমুখীন করে থাকে।
উচ্চ মূল্য: সঠিক সময় সরবরাহ না করার কারণে খুচরা বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এটি নিম্ন আয়ের পরিবারের উপর একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে, যাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই হিমশিম খেতে হয়।
অবকাঠামোর ক্ষতি: অগ্নিকাণ্ডের কারণে রাস্তা, সেতু এবং অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে, যা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যকে এবং উক্ত এলাকার মানুষের সাধারণ জীবন যাপন ব্যাহত করেছ।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট: আগুন ঢাকার অর্থনীতিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থাও নষ্ট করেছে। দুর্বল নিরাপত্তা মান এবং ঘন ঘন বিপর্যয়ের জন্য কারণে বিনিয়োগকারীরা এমন একটি শহরে বিনিয়োগ করতে দিন দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে ।
আমার যদি পিছিনে তাকাই তাহলে আরো অনেক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা লক্ষ্য করবো, যেমন নিমতলী ফায়ার (2010), তাজরিন ফ্যাশন ফায়ার (2012), চকবাজার অগ্নিকাণ্ড (2019), বনানী ফায়ার (2019। এই প্রতিটি আগুন স্থানীয় অর্থনীতি এবং সমাজের উপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল এবং তারা ঢাকায় উন্নত নিরাপত্তা বিধি ও প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এই বিপর্যয়গুলি শহুরে এলাকার কার্যকর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে, সেইসাথে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিপজ্জনক উপকরণ সংরক্ষণ ও পরিচালনা প্রতিরোধে শক্তিশালী বিধিবিধানের ওপর জোর দিয়েছে। আমাদের দেশে বহুবার অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কাজেই এ ব্যাপারে প্রত্যেকেরই সতর্ক থাকা দরকার । ব্যাপক সচেতনতা ও সতর্কতা অগ্নিকাণ্ডের বড় ক্ষতি থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে।ভবন নির্মাণে ত্রুটি এবং সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করার কারণে রাজধানীতে বারবার অগ্নিকাণ্ড ঘটছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে অবকাঠামো নির্মাণে সব আইন যথাযথভাবে অনুসরণ করার বিকল্প নেই । পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ও আরো বাড়ানো জরুরি।
বিল্ডিং কোড: নতুন স্থাপনা নির্মাণে যথাযত বিল্ডিং কোড মেনে চলার বিকল্প নেই। আমাদের সবার এই ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আমাদের বিল্ডিং এ আগুন নির্বাপক সরঞ্জামাদি নিশ্চিত করতে হবে।
সরঞ্জাম সংরক্ষণ: অগ্নি সুরক্ষা সরঞ্জাম (যেমন অগ্নি নির্বাপক, নিয়ন্ত্রণ প্যানেল, ইত্যাদি) সহজেই যেন ব্যৱহাৰ এমন জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে । এছাড়াও ফায়ার স্প্রিংকলার বা ফায়ার অ্যালার্মকে ধুলো, ধ্বংসাবশেষ বা পেইন্টের মতো কোনো কিছু দিয়ে ব্লক করা যাবে না।
নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ: সমস্ত অগ্নি সুরক্ষা সরঞ্জাম নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, যেন নিশ্চিত হওয়া যায় যে সবকিছুই ঠিক থাকে আছে। অতিরিক্ত গরম বা ঘর্ষণ থেকে সৃষ্ট স্ফুলিঙ্গ প্রতিরোধ করার জন্য আপনার বিল্ডিংয়ের যে কোনও মেশিন সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে তা নিশ্চিত করতে হবে।
নিরাপদ গুদামঘর: বিল্ডিংয়ে রাসায়নিক, দাহ্য পদার্থ বা অন্যান্য বিপজ্জনক পদার্থ থাকলে,সেগুলি একটি নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। দাহ্য পদার্থের জন্য অগ্নি সুরক্ষা সরঞ্জামগুলি স্টোরেজ এলাকার কাছাকাছি রাখা যেতে পারে।
ঝুঁকি কালীন ব্যাবস্থা: পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটির ক্ষেত্রে অগ্নি নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের যথাযথ ব্যবহার জানা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটু বিষয়।এটি আপনার বিল্ডিংয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়লে আগুন ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করতে সাহায্য করব। এজন্য আপনার বিল্ডিং অবস্থান করে এমন সকল মানুষ কে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার শেখাতে হবে। অগ্নি ঝুঁকি প্রশমনে মহড়া ও প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম।
জরুরী পরিকল্পনা: আগুন লাগলে ক্ষয়ক্ষতি বা জীবন নাশের ঝুঁকি এড়াতে জরুরি পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সাহায্যের জন্য ফায়ার সার্ভিস কে কল করা, তারা কিভাবে বিল্ডিং সহজে খুঁজে পাবে তা বর্ণনা করা ৷ সংঘটিত আগুন প্রতিরোধ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আগুন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি কমাতে পারে, যা আরও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সর্বোপরি অসতর্কতা অগ্নিকান্ডের প্রধান কারণ। তাই নিজেরা সচেতন হলে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে এবং আমাদের উর্ধমুখী অর্থনীতি বাধার হাত থেকে রক্ষা পাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঢাকার নিয়মিত অগ্নিকান্ড এবং অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রসারে ব্যাঘাত প্রতাপ চন্দ্র রায় মুক্তমত