Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’

সৈয়দ আমিরুজ্জামান
২ জুন ২০২৩ ১৫:০৯

(ধারাবাহিক-০১)
মহান দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-এর ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ গ্রন্থের নির্বাচিত অংশ সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নে তুলে ধরা হলো –

গ্রন্থ পরিচিতি:

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানব সমাজের বিকাশ প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এঙ্গেলস তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’র ১৮৮৪ সালের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছেন, “বস্তুবাদী ধারণা অনুযায়ী শেষ বিচারে ইতিহাসের নির্ধারক করণিকা হচ্ছে প্রত্যক্ষ জীবনের উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদন। কিন্তু এই ব্যাপারটির দ্বিবিধ প্রকৃতি। একদিকে জীবনযাত্রার উপকরণ — খাদ্য, পরিধেয় ও আশ্রয় এবং সেইজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির উৎপাদন; অপরদিকে মানবজাতির জৈবিক উৎপাদন, বংশবৃদ্ধি। একটি বিশেষ ঐতিহাসিক যুগে একটি বিশেষ দেশে, মানুষ যে সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাস করে, সেগুলি দ্বিবিধ উৎপাদনের স্তর দ্বারা নির্ধারিত হয় : একদিকে শ্রমের বিকাশের, অপরদিকে পরিবারের বিকাশের স্তর দিয়ে।

শ্রমের বিকাশ যত কম হয় এবং উৎপন্নের পরিমাণ ও সেই হেতু সমাজের সম্পদ যত সীমাবদ্ধ হয়, তত বেশি সমাজব্যবস্থা কৌলিক (বংশানুক্রমিক) সম্পর্ক দিয়ে পরিচালিত মনে হয়। কিন্তু কৌলিক বন্ধনের ভিত্তিতে গঠিত এই সমাজকাঠামোর মধ্যে শ্রমের উৎপাদিকা ক্রমশ বাড়তে থাকে; সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ পায় ব্যক্তিগত মালিকানা ও বিনিময়, ধনের অসাম্য, অপরের শ্রমশক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা এবং তার ফলে শ্রেণী বিরোধের ভিত্তি; নবজাত সামাজিক উপাদানগুলি কয়েক পুরুষ ধরে পুরাতন সামাজিক সংগঠনকে নতুন অবস্থাগুলির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করে, অবশেষে উভয়ের এই গরমিল থেকে আসে পরিপূর্ণ বিপ্লব।

বিজ্ঞাপন

কৌলিক বন্ধনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পুরাতন সমাজ নবজাত সামাজিক শ্রেণীগুলির সংঘাতে চুরমার হয়ে যায়; তার জায়গায় দেখা দেয় রাষ্ট্র হিসাবে সংগঠিত একটি নতুন সমাজ — এখানে নিম্নতন ইউনিটগুলি আর কৌলিক গোষ্ঠী নয় — আঞ্চলিক গোষ্ঠী; এরূপ সমাজে পারিবারিক প্রথা পুরোপুরি মালিকানা প্রথার অধীন এবং যে শ্রেণীবিরোধ ও শ্রেণীসংগ্রাম এযাবৎকালের সমগ্র লিখিত ইতিহাসের মর্মবস্তু, সেটা তার মধ্যে অবাধে বিকাশ পেতে থাকে।”

এই প্রসঙ্গে এঙ্গেলস, তাঁর নিজের এবং কার্ল মার্কসের বহু উপলব্ধির সাথে গ্রন্থকার এইচ মর্গান লিখিত এবং লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘প্রাচীন সমাজ’ নামক বইয়ে বিবৃত নানান উপলব্ধির বহু মিল খুঁজে পান।

মর্গান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন -“মর্গানের মহৎ কৃতিত্ব হচ্ছে এই যে, তিনি আমাদের লিখিত ইতিহাসের এই প্রাগৈতিহাসিক ভিত্তির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আবিষ্কার ও পুনরুদ্ধার করেন, এবং উত্তর আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের কৌলিক গোষ্ঠীর মধ্যে গ্রীক, রোমক ও জার্মান ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং এতদিন পর্যন্ত দুর্বোধ্য ধাঁধার চাবিকাঠি খুঁজে পান।”

একইভাবে গ্রন্থকার বাখোফেন লিখিত এবং ১৮৬১ সালে প্রকাশিত ‘মাতৃ অধিকার’ নামক পরিবারের ইতিহাস সম্পর্কিত রচনায় লিখিত বিভিন্ন প্রতিপাদ্য সম্পর্কেও এঙ্গেলস নিজের সমর্থন জাহির করেছেন। কাজেই এঙ্গেলস তাঁর রচনায় এই দুই গ্রন্থকারের লেখা বিভিন্ন অধ্যায়কে নানান জায়গায় উদ্ধৃত করেছেন এবং যেসব বিষয় এনাদের লেখায় নেই সেক্ষেত্রে এঙ্গেলস নিজের মন্তব্য ও বিশ্লেষণ হাজির করেছেন।

১৮৯১ সালের চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস লিখেছেন -“সপ্তম দশকের আগে পর্যন্ত পরিবারের ইতিহাস বলে কোনো জিনিস ছিল না। এইক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বিজ্ঞান তখনও সম্পূর্ণভাবে মোজেসের পঞ্চ পুস্তকের প্রভাবাধীন ছিল।” এরপর তিনি আরও লেখেন, “১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে বাখোফেনের ‘মাতৃ অধিকার’ প্রকাশিত হবার পর থেকে পরিবারের ইতিহাস সম্পর্কে চর্চার শুরু। গ্রন্থকার এই রচনায় নিম্নলিখিত প্রতিপাদ্য হাজির করেছেন : (১) শুরুতে মানবসমাজ নির্বিচার যৌন সম্পর্কের অবস্থায় বাস করত, গ্রন্থকর্তা তার অসন্তোষজনক নামকরণ করেছেন ‘হেটায়ারিজম’;

বিজ্ঞাপন

(২) এই নির্বিচার যৌন সম্পর্কের জন্য পিতৃত্বের সম্পর্কে কোনো নিশ্চয়তা ছিল না, কাজেকাজেই বংশধারা স্থির করা যেত কেবল নারীর দিক থেকে — মাতৃ অধিকার অনুযায়ী এবং আদিতে প্রাচীনকালের সমস্ত জাতির মধ্যেই এই ছিল অবস্থা;

(৩) সুতরাং মাতা রূপে পরবর্তী পুরুষের একমাত্র স্থির ধার্যা জন্মদাত্রী নারীদের প্রতি উচ্চমাত্রার বিবেচনা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হতো এবং বাখোফেনের ধারণা অনুযায়ী এটি বেড়ে ওঠে নারীদের পূর্ণ আধিপত্যে (গাইনিওক্রাসী);

(৪) নারী যখন নিছক একটি পুরুষেরই উপভোগ্যা, সেই একবিবাহ প্রথায় উত্তরণের অর্থ একটি আদিম ধর্মীয় নির্দেশ লঙ্ঘন করা (অর্থাৎ বাস্তবক্ষেত্রে ঐ একই স্ত্রীলোকের উপর অন্যান্য পুরুষের চিরাচরিত প্রাচীন অধিকার লঙ্ঘন), এই লঙ্ঘনের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো অথবা এই লঙ্ঘনের স্বীকৃতি আদায় করা হতো সীমাবদ্ধ সময়ের জন্য নারীটিকে অপরের কাছে সমর্পণের মূল্যে।”

বাখোফেন সম্পর্কে এঙ্গেলস আরও লিখেছেন – “তিনিই সর্বপ্রথম নির্বিচার যৌন সম্পর্কের একটা অজানা আদিম অবস্থা সম্বন্ধে ফাঁকা বুলির জায়গায় প্রমাণ দেন যে, প্রাচীন চিরায়ত সাহিত্যে অনেক চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে যে, গ্রীক ও এশিয়াবাসীদের মধ্যে একবিবাহের আগে সত্য সত্যই সেরূপ একটি অবস্থা ছিল, যখন প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রথা লঙ্ঘন না করেও শুধু যে একটি পুরুষ বহু স্ত্রীলোকের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রাখত তাই নয়, পরন্তু একজন স্ত্রীলোকও বহু পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রাখতে পারত; একবিবাহের অধিকার নারীরা যে সীমাবদ্ধ সময়ের জন্য আত্মসমর্পণ মারফত ক্রয় করতে বাধ্য হয়েছিল তার মধ্যে নিজের চিহ্ন না রেখে এ প্রথা লুপ্ত হয়নি; তাই প্রথমে শুধুমাত্র স্ত্রীলোক থেকে মাতা অনুযায়ী বংশপরম্পরার হিসাব করা হতো; এবং এইভাবে নারীবংশ পরম্পরার বৈধতা একবিবাহের যুগেও বেশ কিছুকাল বজায় ছিল যখন পিতৃত্ব সুনিশ্চিত অথবা অন্তত সর্ববাদীসম্মত হয়নি; এবং সন্তানসন্ততিদের একমাত্র সুনিশ্চিত জন্মদাতা হিসাবে মায়ের এই আদি প্রতিষ্ঠার ফলে মা এবং সাধারণভাবে স্ত্রীলোকদের জন্য এমন একটা উচ্চতর সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত ছিল যা পরবর্তীযুগে তাঁরা আর পাননি।

বাখোফেন অবশ্য এই প্রতিপাদ্যগুলি এতটা পরিষ্কার করে ব্যক্ত করেননি — তাঁর রহস্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে ব্যহত করেছে, কিন্তু তিনি প্রমাণ করলেন যে, এই প্রতিপাদ্যগুলি নির্ভুল এবং ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে এর তাৎপর্য সম্পূর্ণ বৈপ্লবিক।”

বাখোফেনের উত্তরসূরি হিসেবে একজন আইনজীবী, ফারগুসন ম্যাক লেনান-এর ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে আত্মপ্রকাশের কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি আবার কখনও বাখোফেনের নাম পর্যন্ত শোনেননি।

“প্রাচীন ও আধুনিক যুগের বহু বন্য, বর্বর এমনকি সভ্য জাতির মধ্যে ম্যাক-লেনান, বিবাহের একটি প্রথার সন্ধান পান যাতে পাত্র একাকী অথবা বন্ধুবান্ধব সঙ্গে নিয়ে পাত্রীকে তার আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে বলপূর্বক ছিনিয়ে নেবার ভান করে। এই প্রথাটি নিশ্চই কোন পূর্ববর্তী একটি প্রথার লুপ্তাবশেষ যাতে এক উপজাতির লোকেরা অন্য উপজাতি থেকে বলপূর্বক হরণ করে স্ত্রী সংগ্রহ করত। কেমন করে এই হরণ করে বিবাহের প্রথা এল? যতদিন পুরুষেরা নিজেদের উপজাতির মধ্যে যথেষ্ট সংখক স্ত্রীলোক পেত, ততদিন এর কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু প্রায়ই আমরা দেখতে পাই যে, অনুন্নত জাতিগুলির মধ্যে কিছু কিছু গ্রুপ আছে (১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে এই গোষ্ঠীগুলিকে প্রায়ই উপজাতির সঙ্গে এক করে দেখা হতো) যাদের নিজেদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ, তার ফলে পুরুষেরা তাদের স্ত্রী এবং স্ত্রীলোকেরা তাদের স্বামী এই গ্রুপের বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে বাধ্য হতো, আবার কোথাও কোথাও এমন প্রথা প্রচলিত যাতে একটি বিশেষ গ্রুপের পুরুষেরা কেবল মাত্র নিজেদের মধ্যে থেকেই স্ত্রী সংগ্রহ করতে বাধ্য ছিল।

ম্যাক-লেনান প্রথম ধরনের গ্রুপকে বহির্বিবাহিক (exogamous) এবং দ্বিতীয়টিকে অন্তর্বিবাহিক (endogamous) আখ্যা দেন এবং কোনো দ্বিধা না করে তিনি বহির্বিবাহিক ও অন্তর্বিবাহিক ‘উপজাতিদের’ মধ্যে একটা অনড় বৈপরীত্য কায়েম করে দেন। এবং যদিও বহির্বিবাহ নিয়ে তাঁর নিজের গবেষণার ফলে এই সত্যটি তাঁর চোখের সামনেই ফুটে ওঠে যে, সর্বক্ষেত্রে যদি নাও হয় তাহলেও অনেক ক্ষেত্রে, এই বৈপরীত্যের অস্তিত্ব শুধু তার কল্পনাতে, তবুও একেই ভিত্তি করে তাঁর সমগ্র মতবাদ গড়ে তোলেন। সেই হিসাবে বহির্বিবাহিক উপজাতিরা কেবলমাত্র অন্যান্য উপজাতি থেকেই তাদের স্ত্রী সংগ্রহ করতে পারে, এবং উপজাতিগুলির মধ্যে চিরস্থায়ী যুদ্ধের যে যুগ ছিল বন্য অবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য, তখন এই কাজ কেবল বলপূর্বক হরণ করেই করা সম্ভব বলে তাঁর ধারণা।”

এঙ্গেলস লিখেছেন -“বহির্বিবাহিক ও অন্তর্বিবাহিক ‘উপজাতির’ বৈপরীত্য সম্বন্ধে ম্যাক-লেনানের কিছু কিছু ব্যতিক্রম ও অদলবদল সত্বেও প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির সাধারনতঃ স্বীকৃত ভিত্তি রয়ে গেল এবং এইটাই চোখে ঠুলির মতো অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে স্বাধীন পর্যালোচনা ও তার ফলে সুস্পষ্ট অগ্রগতি অসম্ভব করে তুলল।
ম্যাক-লেনানকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করা, যা ইংল্যান্ডে এবং ইংরেজি ফ্যাশানের অনুকরণে অন্যত্রও রেওয়াজ হয়ে উঠেছিল, তার প্রতিতুলনায় উল্লেখ করা কর্তব্য যে, পুরোপুরি ভ্রান্ত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত বহির্বিবাহিক ও অন্তর্বিবাহিক ‘উপজাতিগুলির’ বৈপরীত্যের মতবাদ দ্বারা তিনি যে ক্ষতি করেছেন তা তাঁর গবেষণার সমগ্র সুফল ছাড়িয়ে গিয়েছে।”

“ইতিমধ্যে অচিরেই আরও অনেক তথ্য জানা গেল যাকে এই পরিপাটি কাঠামোর মধ্যে আর মোটেই খাপ খাওয়ানো যায় না।

ম্যাক-লেনান বিবাহের তিনটি মাত্র রূপ জানতেন — বহুপত্নী প্রথা, বহুস্বামী প্রথা ও একপতিপত্নী প্রথা। কিন্তু একবার এইদিকে দৃষ্টি আকর্ষিত হবার পর এই তথ্যের সমর্থনে ক্রমেই বেশি করে প্রমাণ আবিষ্কৃত হতে থাকল যে, অনুন্নত জাতিগুলির মধ্যে বিবাহের এমন পদ্ধতি ছিল যাতে একদল পুরুষ সমষ্টিগতভাবে একদল স্ত্রীলোকের স্বামিত্ব গ্রহণ করত, এবং জে. লাবক (তাঁর রচিত ‘সভ্যতার উৎপত্তি’, ১৮৭০) এই সমষ্টিগত বিবাহকে (communal marriage) একটি ঐতিহাসিক সত্য বলে স্বীকার করলেন।”

“এর অব্যবহিত পরেই ১৮৭১ সালে মর্গান, তাঁর নতুন এবং অনেক বিষয়ে প্রামাণ্য তথ্য নিয়ে হাজির হলেন। তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় হয় যে, ইরকোয়াসদের মধ্যে প্রচলিত বিশেষ ধরনের আত্মীয়তাবিধি যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত আদিম অধিবাসীদের সম্পর্কে প্রযোজ্য এবং সুতরাং তা একটি গোটা মহাদেশে পরিব্যাপ্ত, যদিও তাদের প্রচলিত দাম্পত্য সম্পর্ক থেকে উদ্ভুত বিভিন্ন স্তরের আত্মীতার সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ বিরোধ আছে।”

“১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে মর্গান যে জিনিসটি অস্পষ্টভাবে অনুমান করেছিলেন, ১৮৭৭ সালে তাঁর মূল রচনা, ‘প্রাচীন সমাজের কথা’য় তা পরিপূর্ণ স্পষ্টতায় বিকশিত করা হয়েছে। বহির্বিবাহ আর অন্তর্বিবাহের মধ্যে আর কোনো বৈপরীত্য নেই, আজ পর্যন্ত কোথাও কোনোও বহির্বিবাহিক ‘উপজাতি’ আবিষ্কার হয়নি। কিন্তু সেই সময়ে সমষ্টি-বিবাহ প্রচলিত ছিল — এবং খুব সম্ভবত সর্বত্রই কোনো না কোনো সময় এটি ছিল, — তখন উপজাতি গড়ে উঠত মায়ের দিক দিয়ে রক্ত সম্পর্কিত কয়েকটি গ্রুপ বা গোত্র (gentes) নিয়ে, যাদের অভ্যন্তরে বিবাহ একেবারে নিষিদ্ধ ছিল, ফলে যদিও গোত্রের লোকেরা নিজেদের উপজাতিদের মধ্যে থেকেই পত্নী সংগ্রহ করতে পারত ও সাধারণত তাইp করত, কিন্তু তা করতে হতো নিজেদের গোত্রের বাইরে থেকে। তাই গোত্রগুলি কঠোরভাবে বহির্বিবাহিক হলেও সমস্ত গোত্র একত্র নিয়ে যে উপজাতি, সেটি ছিল কঠোরভাবেই অন্তর্বিবাহিক।”

“মর্গান অবশ্য এতেই তৃপ্ত থাকেননি। আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের গোত্র থেকে শুরু করে তিনি অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আরও এক পা এগিয়ে যেতে পারলেন। তিনি আবিষ্কার করলেন যে, মাতৃ-অধিকারের ভিত্তিতে সংগঠিত এই গোত্র হচ্ছে আদিরূপ, যার থেকে পিতৃ-অধিকার অনুযায়ী সংগঠিত পরবর্তী গোত্রের উৎপত্তি হয়েছে, যা আমরা প্রাচীনকালের সভ্য জাতিগুলির মধ্যে দেখতে পাই। গ্রীক ও রোমান গোত্র, যা সমস্ত পূর্ববর্তী ঐতিহাসিকদের কাছে ছিল ধাঁধা, এখন তার ব্যাখ্যা হলো ইন্ডিয়ান গোত্র দিয়ে এবং এইভাবে আদি সমাজের সমগ্র ইতিহাসের একটি নতুন ভিত্তি পাওয়া গেল।”

“সমস্ত সভ্য জাতির মধ্যে পিতৃ-অধিকার নিয়ে যে গোত্র দেখা যায় তার পূর্ববর্তী স্তরে আদি মাতৃ-অধিকারভিত্তিক গোত্রের আবিষ্কারটি হচ্ছে আদিম সমাজের ইতিহাস সম্পর্কে ঠিক ততখানি অর্থপূর্ণ, যতখানি জৈব বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডারউইনের বিবর্তনবাদ অথবা অর্থনীতির ক্ষেত্রে মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব। এর সাহায্যে মর্গান এই প্রথম পরিবারের ইতিহাসের একটি রূপরেখা দিতে পারলেন, যাতে বিবর্তনের অন্তত চিরায়ত পর্যায়গুলি, বর্তমানের লভ্য তথ্যের ভিত্তিতে যতটা সম্ভব, খসড়াকারে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলো। মাতৃ-অধিকারভিত্তিক গোত্রই হয়ে দাঁড়াল সেই খুঁটি, যার ওপর বিজ্ঞানের ভর; এই আবিষ্কারের পর আমরা বুঝতে পারি কোন পথে গবেষণা চালাতে হবে, কোন কোন অনুসন্ধান করতে হবে এবং কেমন করে অনুসন্ধানের ফলগুলি সাজাতে হবে।

ফলে মর্গানের রচনা প্রকাশিত হবার পর এইক্ষেত্রে অগ্রগতি আগেকার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত ও ভিন্নরূপ।”

– ক্রমশ –

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ‘পরিবার ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ মুক্তমত সৈয়দ আমিরুজ্জামান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর