Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সার্টিফিকেট পোড়ানো জাতির জন্য অশুভ বার্তা

মুহম্মদ সজীব প্রধান
৪ জুন ২০২৩ ১৫:৪১

একটি সার্টিফিকেট দেখতে এক পাতার একটি কাগজ মনে হলেও সেটা একজন শিক্ষার্থীর ১৫-১৬ বছরের অনেক সংগ্রামের অর্জন। একটি সার্টিফিকেটের সাথে একজন শিক্ষার্থীর, একটি পরিবার, একটি সমাজ ও একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। তাই সার্টিফিকেট পোড়ানো আর জাতির ভবিষ্যৎ পোড়ানো একই কথা। বর্তমানে অনেক তরুণ তরুণী তাদের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমলব্ধ সার্টিফিকেট প্রকাশ্য দিবালোকে আগুনে পোড়াচ্ছেন। এর পিছনে অনেক কারণ থাকলেও প্রথম ও প্রধান কারণ একটি অর্থাৎ সোনার হরিণ! চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই সময়ে অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি সহ রাষ্ট্র যন্ত্রের সকল ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে ক্যারিয়ারের ধারনাও অনেক বিস্তৃত। উন্নত দেশে তরুণ তরুণীরা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ক্যারিয়ার এবং উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে ঝুকছে। ফলশ্রুতিতে, এসব দেশের তরুণ প্রজন্ম দ্রুততম সময়ে জনসম্পদে পরিণত হয়ে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশে। এখানে তরুণ প্রজন্ম হাতেগুণা কয়েকটি চাকরির পিছনে ছোটার কারণে নিজেরা হতাশ হচ্ছে এবং দেশে জ্যামিতিক হারে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষত, সরকারী চাকরির প্রতি আমাদের অত্যধিক আগ্রহ এক প্রকার সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আর এই ব্যাধির একটি বড় লক্ষণ হচ্ছে ফেসবুক লাইভে এসে সার্টিফিকেট পোড়ানো যা জাতির জন্য অশনিসংকেত। কেউ কেউ সহানুভূতি নিয়ে চাকরি পাওয়ার আশায় সার্টিফিকেট পোড়াচ্ছে যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভয়ংকর ট্রেন্ডে রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে, অনেক তরুণ তরুণী হতাশায় আত্মহত্যাও করছে প্রতিনিয়ত। এক অজানা ও অদ্ভুত যুক্তিতে আমরা বিশ্বাস করি চাকরি পরীক্ষাই জীবনের চূড়ান্ত পরীক্ষা। তাই এই পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়া মানে জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া! সেজন্যই তরুণ প্রজন্ম দীর্ঘ সাধনার স্বীকৃতি সার্টিফিকেট পোড়াতেও দ্বিধা করেনা। আমাদেরকে বুঝতে হবে যতোই চেষ্টা করা হোক না কেন সবার দ্বারা সরকারী চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। কারণটা খুবই সহজ। একটি সরকারি চাকরি পরীক্ষায় দু–তিন হাজার আসনের বিপরীতে লড়াই করে প্রায় কয়েক লাখ প্রার্থী। এটা স্বাভাবিক যে এখানে সবাই তুখোড়, মেধাবী ও পরিশ্রমী হলেও দু–তিন হাজার বাদে বাকি প্রার্থীরা ওই সরকারি চাকরিটা পাবেন না। এর মানে এই নয় যে ওই হাজার হাজার প্রার্থী অযোগ্য এবং তাঁদের মধ্যে কোনো সম্ভাবনা নেই। এতো সহজ হিসেবটা চাকরি প্রার্থীরা বুঝলেও আমাদের পরিবার ও সমাজ কখনো বুঝার চেষ্টা করেনা। যখন কিছু উদ্যমী তরুণ স্রোতে গা না ভাসিয়ে চাকরির পরিবর্তে নতুন কিছু করার চেষ্টা করে আমাদের সমাজ তখন হতাশার জল ছিটিয়ে তাদের এগিয়ে চলার পথকে রুদ্ধ করে দেয়। ধরুন, স্নাতক শেষ করা একটি ছেলের বিজনেস আইডিয়া চমৎকার এবং সে ছোট্ট একটি বিজনেস শুরু করেছে। কিন্তু আমরা তাকে বিজনেসে নিরুৎসাহিত করার মাধ্যমে তাকে বাধ্য করি চাকরিতে যেতে। আমরা যদি তাকে উৎসাহ দিতাম তাহলে সে একদিন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রুপ অব কোম্পানির একটির মালিক হতো। আর এজন্যই হয়তো আমাদের দেশে বিল গেটস, জ্যাক মা কিংবা ইলন মাস্কের মতো ব্যক্তির জন্ম হয়না। অথচ আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছি। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এবং তরুণ প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যৎ এর জন্য আমাদের উচিৎ স্মার্ট ক্যারিয়ারের প্রতি জোর দেওয়া। কেননা, স্মার্ট ক্যারিয়ারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন প্রজন্মের প্রতিভার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে বেকারত্ব নির্মূল করা এবং দেশের অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব জোয়ার আনা। স্মার্ট ক্যারিয়ার কেমন হবে সেটার কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেই। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজের প্রতিভা কাজে লাগিয়ে ভিন্নতা, সৃজনশীলতা ও সততার মাধ্যমে সম্পন্ন যেকোনো উপার্জন মাধ্যমই স্মার্ট ক্যারিয়ার। যেমনঃ অনেক তরুণ হাস-মুরগি কিংবা গরুর খামার করে কোটিপতি হয়েছে। আবার অনেক তরুণী ফ্রিল্যান্সিং করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। এরকম ব্যতিক্রমী ক্যারিয়ারের জন্য চাই আত্মবিশ্বাস এবং পরিবার ও সমাজের উৎসাহ।

বিজ্ঞাপন

এখানে আরো দুইটি কঠিন বাস্তবতা রয়েছে। প্রথমত, বেশিরভাগ তরুণ অর্থ সঙ্কটের কারণে প্রতিভা ও ইচ্ছে থাকা সৃজনশীল কিছু করার জন্য এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়না। দ্বিতীয়ত, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার সাথে ক্যারিয়ারের প্রস্তুতি অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় সদ্য স্নাতক শেষ করা শিক্ষার্থীরা হতাশায় ভেঙে যায়। একটা বিষয় আমাদেরকে নিঃসন্দেহে মানতে হবে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা এখনো আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। সেজন্য বেশিরভাগ শিক্ষার্থী চাকরির বাজারে গিয়ে হোঁচট খায়। কেননা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা আন্তর্জাতিক মানের না হলেও মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি এবং কর্পোরেট সেক্টরে জব করতে আমাদেরকে ঠিকই আন্তর্জাতিক মানের হতে হয়। এজন্যই বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা অনেক শিক্ষার্থীও বাধ্য হয়ে সরকারী চাকরির জন্য রাত জেগে বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞান মুখাস্ত করে। এখানে আরেকটি নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী স্মার্ট ক্যারিয়ারের আশায় বিদেশে পাড়ি জমায় যাকে সহজ কথায় মেধা পাচার বলে । মেধা পাচারকে আমি জাতির ভবিষ্যৎ পাচার বলি কারণ একটি দেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নির্ভর করে ঐ দেশের তরুণ প্রজন্মের প্রতিভা, সৃজনশীলতা ও মেধার ওপর। আর আমাদের সেই প্রতিভা চলে যাচ্ছে বিদেশে! এমতাবস্থায় সর্বপ্রথম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হবে যদি সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যৌথভাবে স্নাতক পর্যায়েই তাদেরকে ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার উপযোগী করে তৈরি করে। সেটা হতে পারে একাডেমিক পড়াশোনার বাহিরে কম্পিউটার স্কিল, কমিউনিকেশন হ্যাকস, টিম ওয়ার্ক, লিডারশীপ, ইউনিক আইডিয়া জেনারেট, প্রবলেম সলভিং এন্ড ইন্সট্যান্ট ডিসিশন মেকিং এবং ফিল্ড ওয়ার্ক সহ ক্যারিয়ার ভিত্তিক বাস্তবিক অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বহুমুখী উদ্যোগ নেওয়া। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথকে সুগম করার জন্য। এক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে ইন্টারন্যাশনাল সেমিনারের আয়োজন করাটাও খুব প্রয়োজন যেখানে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং সফল ব্যক্তিবর্গরা যুক্ত হবেন। এতে তরুণ সমাজ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারবে এবং সে অনুযায়ী নিজেদের তৈরি করবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এখানে পথ প্রদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এটা সত্য যে, আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশে বিশাল এই তরুণ সমাজকে এভাবে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে তোলা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জস্বরূপ তবে সরকার, বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা এবং আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে যদি এই চ্যালেঞ্জ সফল করা যায় তাহলে তরুণ প্রজন্ম দ্রুততম সময়ে জনসম্পদে পরিণত হবে। তরুণ প্রজন্ম তখন সার্টিফিকেট জ্বালানোর পরিবর্তে নিজেদের প্রতিভার আলো জ্বালাতে ব্যস্ত থাকবে। তাদের প্রতিভার উজ্জ্বল আলো পুরো জাতির জন্য আলোকবর্তিকা হবে যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের জন্য ঈর্ষণীয় সাফল্য বয়ে আনবে। তাছাড়া, তরুণ সমাজ জনসম্পদে রূপান্তরিত হলে স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি ভিত্তি অর্থাৎ স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সমাজ খুব সহজেই প্রতিষ্ঠা করা যাবে। তাই ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে আমাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের উচিৎ তরুণ প্রজন্মকে তথাকথিত ক্যারিয়ারের বাইরে সৃজনশীল ও স্মার্ট ক্যারিয়ারের প্রতি আকৃষ্ট করা এবং তাদের এগিয়ে চলার পথে প্রেরণা ও প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করা।

বিজ্ঞাপন

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

মুক্তমত মুহম্মদ সজীব প্রধান সার্টিফিকেট পোড়ানো জাতির জন্য অশুভ বার্তা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর