শিক্ষার মেরুদন্ড শিক্ষকের দুরবস্থা
৪ জুন ২০২৩ ১৫:৫০
মানুষের চিন্তার ক্রমবিকাশমান ধারায় সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটে।উৎকর্ষিত চিন্তা উৎকর্ষতর সভ্যতা ও জাতির জন্ম দেয়।এই তত্ত্ববাদের নেপথ্যে যে বিষয়টি প্রবল প্রভাবক হিসাবে কাজ করে তা হলো শিক্ষা।একমাত্র শিক্ষাই সভ্যতা ও জাতি কে সৌন্দর্য ও সুরক্ষা দেয়।এই গুরুত্বের বিচারে একমাত্র শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।শিক্ষা মানুষের মৌলিক চাহিদা ও অধিকারও বটে।এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অপরিহার্য উপাদানও।বাংলাদেশের জাতীয় সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হয়েছে।একাডেমিক ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে;যথা-১)প্রাথমিক২)মাধ্যমিক ও ৩) উচ্চ বা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রাথমিক স্তর হলো ১ম হতে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত। উল্লেখ্য,বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে সর্বপ্রথম ৩৬ হাজার ১৬৫টি বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারি করনের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণের রীতি চালু করেন।তবে সরকার ২০২২ সাল থেকে দেশের ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুই বছর ব্যাপী প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে।মাধ্যমিক স্তর আবার তিন ভাগে বিভক্ত;যথা-১)নিম্ন মাধ্যমিক (৬ষ্ঠ-৮ম) ২) মাধ্যমিক(৯ম-১০ম) ও ৩) উচ্চ মাধ্যমিক (একাদশ-দ্বাদশ)।উচ্চ শিক্ষা স্তর বলতে এখানে মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা স্তরকে বোঝানো হয়েছে।প্রচলিত বিধিতে এম পি ও স্বীকৃত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনার্স ও মাষ্টার্স ক্লাসের শিক্ষকরা এম পি ও ভুক্ত হতে পারবেননা;কিন্তু একই প্রতিষ্ঠানে একাদশ-দ্বাদশ ও পাশকোর্সে পাঠদানরত শিক্ষকদের এম পি ভুক্তির সুযোগ আছে।সারাদেশে আটশতাধিক অনার্স-মাষ্টার্স কোর্স সম্পন্ন কলেজ চালু রয়েছে।এগুলোর মধ্যে ৩৫০টি কলেজই বেসরকারি যেখানে পাঁচহজারেরও বেশী শিক্ষক কর্মরত আছেন যাদের প্রচলিত বিধিতে এম পি ও ভুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের জনবল কাঠামোতে এদেরকে নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়নি;কিন্তু আবশ্যকীয় প্রয়োজন সাপেক্ষে জাতীয় বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রবিধানে এই সুযোগ রাখা হয়েছে।অথচ,তাদের আর্থিক বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদেরকে কোনোরুপ সহযোগিতা দেওয়া হয়না।সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল থেকে তাদেরকে সন্মানী প্রদানের নির্দেশনা থাকলেও তা খুবই যৎসামান্য।অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তারা বিনা পারিশ্রমিকেও শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।মাউশি,জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, সকলে তাদের প্রতি উদাসীন।প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এরা জনবল কাঠামোর বাইরে।এদিকে স্কুল,কলেজ,মাদ্রাসা ও কারিগরি মিলিয়ে দেশে প্রায় ৩২ হাজার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চারলাখেরও বেশী শিক্ষক কর্মরত আছেন।অর্থাৎ দেশে মাধ্যমিক হতে ডিগ্রি(পাশ কোর্স)স্তরের প্রায় ৯৭ ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম নির্ভর করছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন এম পি ও ভুক্ত শিক্ষকেরা।আমাদের মনে রাখা উচিৎ, মাধ্যমিক হতে ডিগ্রি(পাশ)পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তরমালা যার ওপর বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চ শিক্ষা নির্ভর করে।বর্তমানে এম পি ও ভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীরা জাতীয় বেতন স্কেলের বেসিক অংশটি পেয়ে আসছেন।জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুসারে যেখানে সরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীরা বাড়ী ভাড়া পান মূলবেতনের ৪৫%,৫০% ও ৬০% (উপজেলা ভিত্তিক) সেখানে বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের নামকেওয়াস্তে ১০০০ টাকা দেওয়া হয়।সরকারিদের চিকিৎসা ভাতা দেওয়া হয় ১৫০০ টাকা;বেসরকারিদের মাত্র ৫০০ টাকা।প্রধান ধর্মীয় উৎসবভাতা সরকারিগণ যেখানে বেসিকের শতভাগ পান সেখানে বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীগণ পান বেসিকের মাত্র যথাক্রমে ২৫% ও ৫০ %।একই জাতীয়কারিকুলামের আওতায় পাঠদানরত সরকারী শিক্ষকদের শতভাগ ধর্মীয়উৎসব বোনাস দেওয়া হয় অথচ বেসরকারিদের দেওয়া হয় মূলবেতনের মাত্র ২৫%। এ বৈষম্য খুবই দুঃখজনক।বাসস্থান,চিকিৎসা ও উৎসবের মতো মৌলিক ইস্যুগুলোতে বৈষম্যের প্রচলন থাকা কখনই শুভকর হতে পারেনা।এটা শিক্ষকদের মনোসামাজিক চেতনায় যথেষ্ট আঘাত করে যার নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষার ওপর পর্যবসিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয়করনের জন্য আন্দোলন করে আসছেন।যদিও দেশের এতো বিপুল সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করন করা ব্যাপক আর্থিক সংশ্লেষের বিষয় যা বর্তমানে জাতীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি সাপেক্ষে খুবই কঠিন।তাছাড়া জাতীয় করন হলেই শিক্ষার মান ভাল হবে এটা সত্যতত্ত্ব নয়।বাস্তবতা হলো,অনেক সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে শিক্ষার মান তুলনামূলক ভাল।এ পরিস্থিতিতে এম পি ও শিক্ষক ও কর্মচারীদের ঘর ভাড়া,চিকিৎসা ও উৎসব ভাতা বর্তমান মূল্যস্ফীতিকে মাথায় রেখে যৌক্তিক পরিমাণ বাড়ানো খুবই যুক্তি যুক্ত।বলাবাহুল্য,সরকারি কর্মজীবিদেরকে দূর্নীতি থেকে দূরে রাখার লক্ষ্যে এই সরকারের আমলেই তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছিল।কিন্তু কার্যত: তা পুরোপুরি বুমেরাং হয়েছে বলা চলে। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে দূর্নীতি কিছুটা কমলেও তা বেতন-ভাতা বৃদ্ধির কারণে নয়। বরং ডিজিটালাইজেশন ও কিছুটা কঠোর অনুশাসনিক ব্যবস্থার কারনে তা সম্ভবপর হয়েছে। অথচ শিক্ষার মতো এমন রাষ্ট্রীয় ও জাতিগত স্পর্শকাতর সেক্টরে কর্মরত অধিকাংশ এম পি ও ভুক্ত মানব সম্পদের জীবন মান উন্নয়নের বিষয়ে বাস্তব ভিত্তিক কোনো পদক্ষেপ অদ্যাবধি গ্রহন করা হয়নি।ফলে সামাজিক ভাবেও এসকল শিক্ষকরা গ্রহন যোগ্যতা পায়না।যেমন,নবম গ্রডের একজন শিক্ষক কে একই গ্রেডের একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী সাধারণত নিম্ন দৃষ্টিতে তুলনা করে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট শিক্ষকের টানাপোড়েন জীবনের কারণে।যদিও নীতিগত ভাবে একজন শিক্ষকের মর্যাদাকে কোনো গ্রেডের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা চলেনা;যদিও এই নীতিকথা আমাদের সমাজে এখন স্রেফ কথার কথায় পরিণত হয়েছে।এটি অনস্বীকার্য যে, শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে শিক্ষক হলো শিক্ষার মেরুদণ্ড।আবার শিক্ষককে সেই মেরুদণ্ডের মজ্জা বললেও অত্যুক্তি হবেনা।মজ্জা সতেজ না থাকলে মেরুদণ্ড যেমন অচল হয়ে পরে,তেমনি শিক্ষকদের জীবন-মানের প্রতি অবহেলা করে, শিক্ষকদের শারিরীক-মানসিক হীনতায় রেখে কখনোই একটি উৎপাানশীল, শিক্ষিত, আদর্শিক জাতি গঠন করা সম্ভব নয়।আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি যে,কোনো-কোনো এম পি ও ভুক্ত শিক্ষক একটু দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য তাকে প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও সাহায্যের জন্য হাত পাততে হয় যা গভীর দুঃখজনক।এরকম পরিস্থিতিতে অনেকেই দূর্বিষহ দৈন্য জীবন পার করে কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে তারা সাহায্যের জন্য হাত বাড়ান না।অনেকেই নীরবে নিভৃতে অকালেই মৃত্যুবরণ করেন।সারা জীবন সমাজকে শিক্ষা সেবা দানের পরও নিজের যৎসামান্য পাওনাদি প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট অফিসপাড়া গুলোতে সকল পেশার জন্মদাতা এরকম শিক্ষকদেরকে যে কত নিদারুণ নাযেহাল হতে হয় তা আর কারোর অজানা নয়।এমনকি সংশ্লিষ্ট বিভাগের পিয়ন,কেরানির কাছেেও তারা যথাযোগ্য আচরণ পাননা যা খুবই দুঃখজনক।সমাজ,রাষ্ট্র,সরকার কর্তৃক অবহেলিত এই পেশাতে এখন কোনো এম পি ও শিক্ষকই তার নিজ সন্তানকেও ভেরাতে চাননা।এটা দ্বৈর্থহীন চিত্তে বলা যায় যে,আমাদের দেশের এম পি ও শিক্ষকদের মতো এমন কষ্টার্ত,দৈন্যদশাগ্রস্ত শিক্ষকগোষ্ঠী পৃথিবীর কোনো দেশে বা সমাজে আছে কিনা সন্দেহ জাগে।ইতোপূর্বেও আমরা দেখেছি যে,বাঙালির প্রানের উৎসব ‘বৈশাখ’ উদযাপনের জন্য সকল সরকারি কর্মজীবিদের ভাতা প্রদান করা হলেও এম পি ও ভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের দেওয়া হতোনা যা ছিল খুবই লজ্জাস্কর।ফলে, তাদের পরিবার পরিজনও এই প্রবঞ্চনায় সামজিক ভাবে যথেষ্ট হীনমন্যতায় ভুগতো। অথচ,সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী একমাত্র এম পি ও শিক্ষকরাই বাধ্যবাধক হয়ে প্রতিষ্ঠানিক ভাবে সশরীরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে এই দিনটি উদযাপন করতো।অনেক আন্দোলন সংগ্রামের পর অবশেষে তাদেরকে মূল বেতনের ২০% হিসাবে এখন দেওয়া হচ্ছে।একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে যে সমাজের তথা রাষ্ট্রের শিক্ষক সমাজকে তার নুন্যতম ও মৌলিক চাহিদা আদায়ের জন্য রাজপথে দাঁড়াতে হয়,সে সমাজ বা রাষ্ট্র কখনোই যথার্থ মর্যাদার দাবীদার হতে পারেনা।এ সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রকে বাস্তবিক ভাবে স্বপ্রণোদিত হওয়া উচিৎ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশ বিচিত্র প্রতিকূলতা পেরিয়ে তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা কাটিয়ে এখন বিষ্ময়কর উদীয়মান দেশ হিসাবে বিশ্বের সর্বত্রই সমাদৃত হচ্ছে যা সত্যিই গর্বের।কিন্তু শিক্ষকদের একটা বিরাট অংশকে এরকম অবহেলিত রেখে সেই গর্ব কতটুকু টেকসই হবে তা সন্দিহান বটে!তবে অনেক হতাশার মধ্যেও আশার শিখা প্রজ্বলিত হওয়ার গর্বিত রেকর্ডও আমাদের আছে।আমাদের বিশ্বাস, আসন্ন বাজেটে এই জনবান্ধব সকার এসকল অবলা শিক্ষকদের বিষয়ে যথেষ্ট দায়িত্বশীল আচরণ করে জাতীয় এই লজ্জাকে নিবারণ করবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
কাজী মাসুদুর রহমান মুক্তমত শিক্ষার মেরুদন্ড শিক্ষকের দুরবস্থা