প্লাষ্টিক দূষণ রোধ করি, নিরাপদ ভবিষ্যত গড়ি
৫ জুন ২০২৩ ১৪:৫৭
পরিবেশ নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা সকলের। কারণ পরিবেশ দূষণের সাথে আমাদের অস্তিত্ত্ব জড়িয়ে আছে। আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের বহু উপাদান পরিবেশ দূষণকে আরও তরাণি¦ত করছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্লাষ্টিক। বর্তমান সময়ে প্লাষ্টিক সামগ্রী অত্যন্ত জনপ্রিয়। হালকা, সহজে বহনযোগ্য এবং নান্দনিক ডিজাইনের তৈরি বলে এর ব্যবহার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব ব্যবহৃত প্লাষ্টিক উপযোগীতা শেষ হলে আমরা আশেপাশে ফেলে দেই। এটাই সাধারণ চিত্র। অথচ এসব পণ্যের রিসাইকেল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব। এর ফলে পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাবে ধরণী। এবং অপচয়ও রোধ করা সম্ভব হবে। তাছাড়া প্লাষ্টিক ঘিরে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও প্রচুর। কিন্তু আমাদের অসচেতনতা এবং কার্যকর পরিকল্পনার অভাবে প্লাষ্টিক আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। ঘরে ব্যবহৃত প্লাষ্টিকের আসবাবপত্র আমাদের প্লাষ্টিক দূষণের আপাত প্রধান কারণ নয়। কারণ এসব পণ্য দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হয় এবং এগুলোর একটি বড় অংশই রিসাইকেল করা হয়। কিন্তু আমরা বাজার থেকে যে শ্যাম্পু, খাদ্যপণ্যের মোড়ক, প্লাষ্টিকের ব্যাগ,ষ্ট্র,ছোট বোতল বা এ ধরনের ছোট ছোট পণ্য ব্যবহার করছি এসব পণ্যই পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলছে। পানীয় পান করেই তা রাস্তায় ছুড়ে ফেলছি। তারপর তা চলে যাচ্ছে ড্রেনে। সেখান থেকে নদীতে। নদীতে এসব বোতল ভাসতে দেখা যায়। সেখান থেকে অনেকে আবার তা সংগ্রহ করে বিক্রি করছে এবং সেখান থেকে রিসাইকেল হচ্ছে। কিন্তু সেই গতি কম। করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর পরিচ্ছন্নতাসামগ্রীর কারণে প্লাষ্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ বেড়ে গেছে বলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশের সুবাদে মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে বছরে এখন ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাষ্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ২ লাখ ২৮ হাজার টনের মতো রিসাইকেল বা পুনঃব্যবহার হয়। বাকি বর্জ্য পরিবেশে পড়ে থাকে। সারা দেশে যে বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তার ৩০ শতাংশের বেশি হয় রাজধানীতে। এখানে বছরে প্রায় আড়াই লাখ টন অর্থাৎ দিনে ৬৮১ টনের মতো বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সারা দেশে এর পরিমাণ ২ হাজার ২৫০ টন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ৯ কেজি বর্জ্য উৎপন্ন করলেও রাজধানীতে এটি দ্বিগুণ বা ১৮ কেজি। অর্থাৎ এই তথ্য থেকে স্পষ্ট যে আমরা নিশ্চিতভাবেই একটি বিপদের মধ্যে পরতে যাচ্ছি যদি না প্লাষ্টিক পণ্যের বর্জ্যরে সুষ্ঠু ব্যবহার না করতে সক্ষম হই।
সাগর, নদী, পুকুর কোথাও প্লাষ্টিকের দূষণ থেকে বাদ যাচ্ছে না। সাগরের মৃত প্রাণীদের পেটে পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর প্লাষ্টিক। যা আমরা বিভিন্ন সময় সাগরের বুকে নিক্ষেপ করছি। একবারও ভেবে দেখছি না আমার ফেলে দেয়া এই প্লাষ্টিক পণ্য প্রাণীকুলের জন্য সংকট বয়ে আনবে। প্লাষ্টিক ক্ষতিকর জানা সত্ত্বে আমরা আমরা ব্যবহার করি এবং পরিবেশ দূষণের জন্য যেখানে সেখানে ফেলে দেই। কিন্তু কেন করছি? উত্তরটি পলিথিনের ব্যবহারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বহনযোগ্যতা,দাম কম এবং তুলনামূলক টেকসই হওয়ায় এর ব্যবহার বেড়ে চলেছে। প্রতিদিন হাটে-বাজারে, দোকানে, মার্কেটে জনপ্রিয় বহনকারি জিনিস হলো প্লাষ্টিক। এই মূহুর্তে প্লাষ্টিকের যোগ্য বিকল্প নেই যা ব্যবহার করলে পরিবেশ রক্ষা করতে পারি। একসময় যেখানে কাঠের তৈরি আসবাবপত্র তৈরি হতো সেখানে আজ শোভা পাচ্ছে প্লাষ্টিকের সামগ্রী। এতে কিন্তু পরিবেশের উপকার হয়েছে। কিন্তু কেবল সচেতনতা এবং রিসাইকেলের অভাবেই এসব সামগ্রী পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। তবু আমাদের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের একটি বড় অংশই রিসাইকেলের বাইরে থেকে যাচ্ছে যা মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। আমরা যখন নদীতে প্লষ্টিক ছুড়ে ফেলছি তখন তা রিসাইকেল কে করবে? আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত আগামী ২০২২ সালের মধ্যে প্লাষ্টিকমুক্ত দেশ গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
এবারের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- ‘সলিউশনস টু প্লাষ্টিক পলুশন’। মানুষের মধ্যে সচেতনা বৃদ্ধি করার জন্যই প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দিবস পালিত হয়। মাটির নিচে এই পণ্যটি ৫০০ বছরেও পঁচে না। ফলে মাটি তার স্বাভাবিক ক্ষমতা হারায়। প্লাষ্টিকের অতিক্ষুদ্র কণা মাছসহ নানা প্রাণীর দেহে প্রবেশ করছে। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। এগুলো ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। আমরা জেনেও ভুলে যাই যে প্লাষ্টিক কোনো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয় না বরং এর প্রভাব এতটা মারাত্বক যে যুগের পর যুগ তা মাটিতে দিব্যি ঠিক থাকে। মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়ায় এর ব্যবহার কমার কোনো লক্ষণ নেই। এর ব্যবহার যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায়, যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হয় তাহলে আজ পলিথিন যে বিঁষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে তখন প্লষ্টিকও বুমেরাং হবে আমাদের জন্য। প্লাষ্টিকজাত পণ্যের একটি বড় অংশই সমুদ্রে গিয়ে পৌছাছে। বিজ্ঞানের অন্যান্য কল্যাণকর আবিষ্কারের মতোই প্লাষ্টিক আবিষ্কার ছিল একটি চমৎকার। কিন্তু অনেক আবিষ্কারের মতোই আজ প্লাষ্টিক আমাদের মানব সভ্যতাকেই হুমকির ভেতর ফেলছে। এর জন্য দায়ী মানুষ। আমরা এর সঠিক ব্যবহার করতে পারছি না। আমাদের মতো দেশে জনগণ যেখানে সচেতন নয়, পরিবেশ নিয়ে কম মানুষেরই মাথাব্যথা রয়েছে সেখানে প্লাষ্টিক হুমকি হবেই।
যেখানে সেখানে ব্যবহার্য জিনিস ছুড়ে ফেলার প্রবণতা এই সংকটকে ঘণীভূত করছে। প্লাষ্টিকের বিরুপ প্রভাব থেকে পরিবেশকে মুক্ত করার জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। যদিও তা সহজসাধ্য নয়। কারণ এখন যে বিপুল ক্ষেত্রে প্লাষ্টিকের ব্যবহার করা হচ্ছে তা হুটহাট শেষ করা যায় না। বিকল্প কোনো উপায় ভাবতে হবে। যাতে প্লাষ্টিকের ব্যবহার একটু একটু করে কমিয়ে আনা যায়। একটা সময় তো প্লাষ্টিকের এত বৈচিত্রপূর্ণ ব্যবহার ছিল না। তখন পরিবেশের দূষনও ছিল কম। কিন্তু অবাধে কাঠের ব্যবহার হয়েছে। আবার প্লাষ্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে হুমকি বাড়ছে। বিশেষ করে সাগরের তলদেশ এসব প্লাষ্টিকজাত সামগ্রীতে পূর্ণ হচ্ছে। যা সমগ্র জীববৈচিত্র্যের জন্যই হুমকিস্বরুপ। প্লাষ্টিক আজ ব্যাপক জনপ্রিয়। বৈদেশিক বাণিজ্যেও প্লাষ্টিক পণ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ররাখছে। যদি ফেলে দেওয়া প্লাষ্টিকের একটি বড় অংশ রিসাইকেল প্রক্রিয়ায় আনা যায় তাহলে সমস্যার সমাধান অনেকাংশেই সম্ভব। সেই সাথে সচেতনতা। আমাদের যেখানে সেখানে ছুড়ে ফেলার অভ্যাস মজ্জাগত হয়ে দাড়িয়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজেদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করার জন্য সবাইকে এ দায়িত্বটুকু পালন করতেই হবে।
লেখক: কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
অলোক আচার্য প্লাষ্টিক দূষণ রোধ করি- নিরাপদ ভবিষ্যত গড়ি মুক্তমত