পরিবেশের আর্তনাদ আমরা কি বুঝি
৫ জুন ২০২৩ ১৬:২৩
উফ! গরম! গা ঘেমে পুরো শরীর ভিজে যাচ্ছে। রাস্তায় ছাতা নিয়ে বের হতে হয়। তারমধ্যে আবার তীব্র গরমে রাস্তার পিচ গলে নিচ থেকে তাপমাত্রায় গা ঝলসে যাওয়ার মত অবস্থা তৈরী হয়। লোডশেডিং পিছু ধরেছে। উফ! এ ভাবে কি জীবন চলে। গ্রীষ্মের সবুজ সোনালী বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ প্রতি মুহূর্তেই হাহুতাশ করে। পরিবেশের পরিবর্তনে মানুষ জীবন কেন নাজেহাল হচ্ছে?
আমাদের চারপাশে পাড়া, মহল্লা, প্রতিবেশী, গ্রাম, শহর, মাটি, পানি, বায়ু, আকাশ, গাছপালা, পশুপাখি জীবজন্তু, সূর্যের আলো ইত্যাদি নিয়ে গঠিত হয় পরিবেশ। তবে পরিবেশের ওই উপাদান গুলোর মধ্যে প্রধান উপাদান হলো তিনটি মাটি,পানি ও বায়ু। একটুবার ভেবে দেখুন তো পরিবেশের সেই উপাদান গুলো যদি পৃথিবীতে না থাকত তাহলে পৃথিবীতে মানুষ বসবাস করতে পারতাম?
যত দিন যাচ্ছে ততই যেন মানবজাতির অবহেলায় পৃথিবীতে বসবাসের অযোগ্য করে তুলতেছি এবং পরিবেশের প্রধান উপাদান গুলোকে দূষিত করে মানবজাতি হুমকির মধ্যে পড়ছে। বাড়ি কিংবা অফিস থেকে বের হয়ে দেখবেন অলিতে-গলিতে পায়ের নিয়ে পড়ে আছে প্লাস্টিক টুথ ব্রাশ, ক্যান, বিভিন্ন প্রকারের প্লাস্টিকের বোতল। এছাড়াও শহর কিংবা গ্রামে ছোট, অনুষ্ঠানে প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম গ্লাস ও প্লেট ব্যবহার করা হয়। ব্যবহার শেষে যত্রতত্র ফেলে রাখা দেখা যায়। যা পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণের একটি।
এভাবে নিয়মিত প্লাস্টিক পদার্থের ব্যবহার এবং প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে পরিবেশ দূষণের মাত্রাকে বহুগুণে বেড়ে গেছে। যার ফলে মানুষের পাশাপাশি সামুদ্রিক ও বন্যপ্রাণীর বাস্তুতন্ত্রেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। প্লাস্টিকে বিদ্যমান বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ভূগর্ভস্হ পানি ও ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে মিশে উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় বলে দিচ্ছে, জীবাণুবিয়োজ্য প্লাস্টিক ভাঙনের মাধ্যমে মিথেন গ্যাস উৎপাদন হয়, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী।
সারাদেশে ইট প্রস্তুত ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন- ২০১৩ কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নামে-বেনামে সরকারি জমি দখল করে, আবাসিক এলাকায় ইটভাটা ও কৃষি জমির পাশে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইটে ভাটা স্থাপন করা হয়। এতে করে ভাটা চালু ও বন্ধের আগে গরম বাতাসে ও গ্যাসে কৃষিজমিতে ফসল উৎপাদন হয় না। ফলের বিভিন্ন উদ্ভিদে ফল ধরে না। ইট ভাটার আশেপাশে বাসা বাড়িতে ধুলাবালু ও ছাই পড়ে রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয়।
শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট তথ্য মতের রাজধানী ঢাকার মানুষের আয়ু প্রায় সাড়ে সাত বছর কমেছে। এর প্রধান কারণ যানবাহনের কালো ধোঁয়া, মিলকারখান ও ইট ভাটার কালোধোঁয়া ইত্যাদি। পরিবেশের অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যাওয়া মানে মানবজাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার সমান।
শহরে যানজটকালে যানবাহন থেকে নির্গত শব্দ, উড়োজাহাজ, ট্রেন, শিল্পকারখানা ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট শব্দ। এভাবে যদি শব্দের মাত্রা বেড়েই যেতে থাকে তাহলে উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে একজন মানুষের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চ শব্দ মানুষের ঘুমেও ব্যাঘাত ঘটায়। উচ্চ শব্দে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ ও উদ্বেগজনিত সমস্যা দেখা দেয়। ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের দেশ প্রাণ প্রকৃতি সংরক্ষণ কতটুকু আগ্রহী তা স্পষ্ট হয় যখন সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন চলে।
অথচ এক মাত্র সুন্দরবনেই ঘূর্ণিঝড়, ঝড়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সুন্দরবন রক্ষা না করে আমরা ধ্বংস করার কাজে ব্যস্ত থাকি। আমাদের একটুও স্মরণ হয় না যে সুন্দরবন ধ্বংস হলে বিপন্ন জাতিতে পরিণত হবে। রাষ্ট্রযন্ত্র উন্নয়নের লেবাস পড়ে সুন্দরবন ধ্বংস করতে প্রস্তুত। “মা মাটি মোহনা মরুভূমি হবে না, প্রাণ প্রকৃতি বাঁচাও দেশ বাঁচাও” এমন স্লোগানে পরিবেশেবাদী সংগঠন গুলোর রাজপথে আন্দোলন করে থাকে। প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস করে দেশের উন্নয়ন কতটা কার্যকর তা করোনা মহামারী বুঝিয়ে দিচ্ছে।
প্রকৃতিকে অত্যাচারের পরিনাম কি হতে পারে তা অদৃশ্য এক ভাইরাসের কাছে সারা বিশ্বের মানুষ অসহায় হয়ে উপলব্ধি করতেছে। আর জীবন দিতে হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। সময়ের পরিবর্তনে পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি সাথে বাড়তেছে মানুষের জীবনযাপনের নিত্যপণ্যের চাহিদা। আর সেই চাহিদা যোগান দিতে নির্ভর করতে হচ্ছে কল কারখানার উপর।
ফলে কল কারখানা থেকে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বনডাইঅক্সইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে ফলে পরিবেশের তাপমাত্রায় বেড়েই চলছে। যা মানবজাতির জন্য বসবাসের অযোগ্য পৃথিবী গড়ে উঠতেছে। বিশ্বজুড়ে এখন পরিবেশ দূষণের মাত্রা ভয়াবহ।
মানব জাতির চরম অবহলো ও অসচেতনতার কারণে পৃথিবীর পরিবেশ এখন হুমকির মুখে। অত্যধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, দ্রুত শিল্পায়ন, সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, ওজোন স্তরের ক্ষয়, অপরিকল্পিত গৃহনির্মাণ, দারিদ্র্য, প্রসাধনসামগ্রী, প্লাস্টিক দ্রব্যের অতিমাত্রায় ব্যবহার ইত্যাদি কারণে পরিবেশ দূষণ সমস্যা প্রকট হওয়ায় মানবসভ্যতা আজ মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত।
যেখানে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয় “গাছ লাগান পরিবেশে বাঁচান”। সেখানে সুন্দরবন রক্ষা করতে রাষ্ট্রের আয়োজন কতটুকু তা প্রশ্ন থেকেই যায়। আমরা উন্নয়ন চাই তাই বলে প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস করে নয়। দেশ ও পৃথিবীকে বাঁচাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে দেশের মানুষকে মুক্ত বায়ু সেবন করতে দিতে হবে। পরিবেশবান্ধব যানবাহনের ওপর জোর দিত হবে।
গাড়ির নির্গত ধোঁয়া বায়ুর সঙ্গে মিশে দূষণ ঘটাতে পারে। তাই দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পরিবেশবান্ধব যানবাহন ব্যবহার করতে হবে। পরিবেশের ইকোসিস্টেমকে সুস্থ রাখতে হবে। কীটনাশক ও কেমিক্যালের ব্যবহার কমতে হবে। বর্জ্য পদার্থ রিসাইকেল করতে হবে। পরিবেশ রক্ষা করলে পরিবেশেও আমাদের রক্ষা করবে। ফলে দেশ ও পৃথিবী বাঁচার দায়িত্ব আমাদের সবার।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই