মাগুরছড়া ব্লো-আউটের ২৬ বছর: ক্ষতিপূরণ আদায়ে সরকারের করণীয়
১৩ জুন ২০২৩ ১৪:২১
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন দিবাগত রাতে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ও মহামূল্যবান গ্যাসক্ষেত্র ‘মাগুরছড়া’য় মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি অক্সিডেন্টালের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে যে ব্লো-আউট ঘটেছিল এবং এতে গ্যাস সম্পদ, পরিবেশ-প্রতিবেশসহ অন্যান্য বহুমাত্রিক অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এবার মৌলভীবাজার গ্যাসফিল্ডের মাগুরছড়া ব্লো-আউটের ২৬ বছর পূর্ণ হলো।
ক্ষতিপূরণ আদায়সহ দেশের খনিজ সম্পদ ও ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থেই প্রতিবছর ১৪ই জুন মাগুরছড়া দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশের জন্য অতি দরকারি অাবিষ্কার মৌলভীবাজারের ১৪ ব্লকের অন্তর্ভুক্ত এই গ্যাসক্ষেত্রটিতে ব্লো-আউটের ২৬ বছর পূর্ণ হলেও অক্সিডেন্টাল-ইউনোকলের উত্তরসূরি শেভরনের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৪ হাজার কোটি টাকা অাদায় করতে পারেনি সরকার। মার্কিন ‘ভিসানীতি’, সাংশন, ‘বাণিজ্যে নিষোধাজ্ঞা’ আরোপের নতুন নতুন কৌশল নিয়ে সরকার যে কথা বলছেন, তা যৌক্তিক ও প্রশংসনীয়। কিন্তু মাগুরছড়ার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য বর্তমানে সরকারের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।
আমরা অনেক আগেই উল্লেখ করেছিলাম, বাংলাদেশের প্রধান এবং প্রায় একক জ্বালানী উৎস গ্যাস সম্পদ সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানীর নগ্নথাবার কবলে। গ্যাস সম্পদ নিয়ে এবারও বাংলাদেশ এক মহা সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। উৎপাদন অংশীদারী চুক্তির নামে সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানীগুলো দেশীয় কমিশনভোগীদের সাহায্যে তেল-গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের নামে অধিক মুনাফা লুন্ঠনের উম্মত্ততা চলছে। এসব কমিশনভোগীদের ক্ষমতা যেন অসীম। প্রতিটি কূপ থেকে বিদেশি কোম্পানিসমূহের তাদের ভাগের ৭৯ ভাগ গ্যাসক্রয় বাবদ শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণ, দেশপ্রেমিক বিশেষজ্ঞ এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি এইসব হাস্যকর পদক্ষেপ ও প্রতারণামূলক যুক্তির আসল চেহারা উন্মোচন করে দিয়েছেন। বিগত সরকারসমূহ বেপরোয়াভাবে সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠনের খেদমতে নিযুক্ত ছিলেন। জনগণ এক্ষেত্রে বর্তমান সরকারকে ব্যতিক্রম হিসেবে দেখতে চাইলেও এর নমুনা উল্লেখ করার মত নয়।
অক্সিডেন্টাল, ইউনোকল, নাইকো, শেভরণ, কেয়ার্ন, টাল্লো ইত্যাদি বহুজাতিক কোম্পানী সারা দুনিয়ার তেল-গ্যাস সম্পদ লুন্ঠনের এক উন্মত্ত খেলায় নিযুক্ত। পৃথিবীর অন্যতম তেল সমৃদ্ধ দেশ নাইজেরিয়াকে ডলার ও সমৃদ্ধির লোভ দেখিয়ে ভিখিরি বানিয়েছে। ইন্দোনেশিয়াকে করেছে সর্বশান্ত। দেশ সর্বশান্ত হলেও লুটের ভাগ পেয়ে স্থানীয় শাসকরা ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় বানিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা দেশে দেশে এই লুটপাট নিশ্চিত করার জন্য সামরিক শাসন অথবা বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। নির্যাতনমূলক আইন করে, সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে লুটের বিরুদ্ধে যে কোন প্রতিরোধকে দমন করেছে। বাংলাদেশও এই লুন্ঠন প্রক্রিয়ারই শিকার। গ্যাসের মজুদ যা দেশের জন্যই অতি সামান্য, সেটাও এরা লুটে নিতে চায়। বাংলাদেশের বিগত শাসকরা নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্য এই লুন্ঠনের প্রত্যক্ষ সহযোগী।
মাগুরছড়া ব্লো-আউটের ২৬ বছর, জনমনে হাজারো প্রশ্ন:
১৪ই জুন মাগুরছড়া দিবস। ১৯৯৭ সালের এইদিনে মাগুরছড়ায় দায়িত্বহীনতার কারণে যে ব্লো-আউট ঘটেছে এবং গ্যাস সম্পদ, পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এবার মৌলভীবাজার গ্যাসফিল্ডের মাগুরছড়া ব্লো-আউটের ২৬ বছর পূর্ণ হলো। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ, পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মার্কিন কোম্পানী অক্সিডেন্টাল-ইউনোকল-শেভরনের কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি সরকার। সরকার এর দায়-দায়িত্ব না এড়িয়ে, দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।
বিদেশী একটি কোম্পানী আমাদের দেশের গ্যাস সম্পদ, পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করলো, তাও তাদের অবহেলা-ত্রুটির কারণে, তাতে আমাদের সরকার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবে না। সম্পদ ধ্বংসের জবাবদিহিতা চাওয়া যাবে না- পাওয়া যাবে না। তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ নিয়ে চিনিমিনি খেলা মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের দেশের তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদের এভাবে ধ্বংসযজ্ঞ ও লুণ্ঠন কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না।
মাগুরছড়া ব্লো-আউট, গ্যাস সম্পদ, তদন্ত রিপোর্ট ও আমাদের পরিবেশ: মৌলভীবাজার গ্যাসফিল্ডের মাগুরছড়া ১৪ নং গ্যাস ব্লকের অন্তর্গত একটি সমৃদ্ধ গ্যাসক্ষেত্র। এটি দেশের খনিজ সম্পদের মানচিত্রে পূর্ণিমার চাঁদের মতো রৌশন ছড়িয়ে জনগণের স্বার্থে স্বাবলম্বী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ঘটাতে পারতো। বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীর বিনিয়োগের জন্য আগত বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী ও অংশীদারেরা ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন দিবাগত রাতে মাগুরছড়া ১নং অনুসন্ধান কূপে খনন চলাকালে বিস্ফোরণ ঘটায়। মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পরপরই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি এক মাসের মধ্যে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ১৯৯৭ সালের ৩০শে জুলাই মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিবের কাছে দু’টি ভলিউমে প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টটি জমা দেয়। পরবর্তীতে বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এ বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, ক্ষতিপূরণ পাওয়া ও বিতরণের বিষয়ে ৩ সদস্যের একটি সাব কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি সাব-কমিটিকে জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে অক্সিডেন্টালের ব্যর্থতার জন্যই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। কমিটির তদন্তে অক্সিডেন্টালের কাজে ১৫/১৬টি ত্রুটি ধরা পড়ে। অক্সিডেন্টালের কর্মকর্তা ২/৩টি ত্রুটির ব্যাপারে আপত্তি জানালেও বাকিগুলো স্বীকার করে নিয়ে তদন্ত রিপোর্টে স্বাক্ষর করে। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, মার্কিন কোম্পানী অক্সিডেন্টালের খামখেয়ালিপনার কারণেই ঘটে যাওয়া এ বিস্ফোরণে চা বাগান, বনাঞ্চল, বিদ্যুৎলাইন, রেলপথ, গ্যাসপাইপলাইন, গ্যাসকূপ, মৌলভীবাজারস্ট্রাক্চার, গ্যাস রিজার্ভ, পরিবেশ, প্রতিবেশ, ভূমিস্থ পানি সম্পদ, রাস্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
তদন্ত রিপোর্টে মাগুরছড়া বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া ভূ-গর্ভস্থ গ্যাসের পরিমাণ ৪৮৫.৮৬ বিসিএফ এবং এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ ২৪৫.৮৬ বিসিএফ উল্লেখ করা হলেও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়নি। এক্ষেত্রে প্রতি ১০০০ সিএফ গ্যাস ২.৬ মার্কিন ডলার হিসাবে বাংলাদেশী টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী মাগুরছড়া বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া ভূ-গর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫.৮৬ বিসিএফ গ্যাসের দাম বাংলাদেশী মুদ্রায় ৩৮৩৪.৪৮ কোটি টাকা।
তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ছোট বড় ৩৯টি চা বাগানের ক্ষতির পরিমাণ ৪৬ কোটি ৬ লক্ষ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকা। বনাঞ্চলের ৬৯.৫ হেক্টর এলাকার ২৫ হাজার ৬৫০টি পূর্ণ বয়স্ক গাছ আগুনে পুড়ে গেছে বলে হিসাব করা হয়, যার ক্ষয়ক্ষতি ধরা হয় প্রায় ৩৩.৬১ কোটি টাকা। একটি বনের স্বাভাবিক উচ্চতার গাছ বাড়তে প্রয়োজন হয় ৫০ থেকে ৬০ বছর। এ বনের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে ১১০ বছর সময় লাগবে। প্রতি বছর ৮০.৩০ কোটি টাকা হিসাবে ১১০ বছরে বনাঞ্চলের পরিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ দেখানো হয় ৮,৮৩৯ কোটি টাকা। বনাঞ্চলের আংশিক ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ৮,১০০ গাছ এবং ২২.৫০ হেক্টর ভূমি; উক্ত ক্ষতি থেকে উদ্ধার পেতে সময় লাগবে ২০ বছর; উক্ত ক্ষতি বাবদ ধরা হয়েছে ৫০৭.১২ কোটি টাকা। এছাড়া বনাঞ্চলের সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ধরা হয়েছে ৪০ হেক্টর ভূমি এবং ১৫,৪৫০ গাছ; উক্ত ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধার পেতে সময় লাগবে ১০ বছর এবং ক্ষতি বাবদ ধরা হয়েছে ৪৮৪.৫৮ কোটি টাকা।
অর্থাৎ বনাঞ্চলের মোট ক্ষতি ধরা হয়েছে ৯,৮৫৮ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা। বিস্ফোরণের ফলে ২ হাজার ফিট রেলওয়ে ট্র্যাক ধ্বংস হয়েছে, এতে ক্ষতি দেখানো হয়েছে ৮১ লক্ষ ৫৪ হাজার ৩৯৫ টাকা (রাজস্ব ব্যতীত)। সড়ক পথ (রাজস্ব ব্যতীত) বাবদ ক্ষতি ২১ কোটি টাকা। গ্যাস পাইপ লাইন (রাজস্ব) বাবদ ক্ষতি ১৩ লক্ষ টাকা। বিদ্যুৎ লাইন (রাজস্ব ব্যতীত) বাবদ ক্ষতি ১ কোটি ৩৫ লক্ষ ৯১৮৬ টাকা। খাসিয়া পানপুঞ্জির অধিবাসীদের পানের বরজ সমূহ (রাজস্ব ব্যতীত) বাবদ ক্ষতি ধরা হয়েছে ১৮ লক্ষ টাকা। বাস মালিকদের রাজস্ব ক্ষতি ধরা হয়েছে প্রতিদিন ৪৭,৭৫০ টাকা হারে মোট ১২ লক্ষ টাকা। (তথ্যসূত্র: তদন্ত রিপোর্ট, ৩০শে জুলাই, ১৯৯৭ইং)
তদন্ত রিপোর্টের ৮.৪.৬ ও ৮.৬ অনুচ্ছেদে যথাক্রমে ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদ ও পরিবেশের ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণ দে’য়া হয়েছে, কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়নি। ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদ ও পরিবেশের ক্ষয়-ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নিরূপণের সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী মাগুরছড়ার মোট ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ১৪ হাজার কোটি টাকা।
মাগুরছড়া গ্যাসকূপ এলাকায় দুর্ঘটনার সময় ৬ জন শ্রমিক, ৫ জন সিকিউরিটি ও ১ জন রিগম্যান কর্মরত ছিলেন। রাত প্রায় একটার দিকে গ্যাসকূপে প্রথম মৃদু ভূকম্পন, তারপর বিদঘুটে আওয়াজ শুরু হলে রিগম্যান দ্রুত রিগ থেকে নেমে পড়েন। কূপ খননের জন্যে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানী অক্সিডেন্টাল যে উপ-ঠিকাদার নিয়োগ করে গ্যাসকূপ খননে তাদের অভিজ্ঞতা ছিল আনকোরা। খননকাজে জার্মান ডয়টেগ-এর অভিজ্ঞ লোকবলের যেমন অভাব ছিল তেমনি পূর্ব কোন সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা ছিলো না। ছিলনা কার্যোপযোগী প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। কূপ খনন কাজে ডয়টেগের যন্ত্রপাতি ছিল পুরানো ও ত্রুটিযুক্ত। এর মান চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ছিল না। দায়িত্বরত রিগম্যানও ছিল সহকারী পর্যায়ের। উৎপাদন বণ্টন চুক্তির শর্তানুসারে কূপ খননের প্রকল্প এলাকায় অক্সিডেন্টাল থেকে একজন, পেট্রোবাংলা থেকে একজন খননবিদ সার্বক্ষণিকভাবে উপস্থিত থাকার কথা। অক্সিডেন্টাল চুক্তির এ শর্তকে তেমন কোনো গুরুত্ব প্রদান করেনি। বিস্ফোরণকালে কূপ এলাকায় কোনো খননবিদ উপস্থিত ছিলেন না।
দুর্ঘটনা এড়ানো ও খনন কাজ সহজ করার উদ্দেশ্যে কূপ খননের সময় যে কেসিং প্রতিরক্ষা বহিরাবরণ তৈরি করা হয় তার নকশায় ছিল মারাত্মক ধরনের ত্রুটি। অক্সিডেন্টাল ও ডয়টেগের আনাড়ি প্রযুক্তিবিদরা এ নকশা তৈরি করে। অক্সিডেন্টালের খনন কাজে আনাড়িপনা, অনভিজ্ঞতা, দায়িত্বে অবহেলা, উদাসিনতা, ত্রুটি, অযোগ্যতা দুর্ঘটনাকে অনিবার্য করে তোলে। দায়িত্ব পালনে অক্সিডেন্টালের অযোগ্যতা ও খনন কাজের নিম্নমান হওয়ার প্রধান কারণ হলো টাকা বাঁচানোর উদ্দেশ্যে সস্তায় লোকবল নিয়োগ করা। উন্নয়ন অংশীদার আমেরিকার কোম্পানি অক্সিডেন্টাল এদেশের গ্যাসক্ষেত্র লুণ্ঠনে অত্যন্ত দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে বিনিয়োগ তত্ত্ব প্রয়োগ করেছে বৈকি। এ তত্ত্বকে কার্যকর করার জন্যে অক্সিডেন্টাল কোম্পানী সব সময় চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে পেট্রোবাংলার কাছে তথ্য গোপন রাখে। চুক্তির শর্তানুসারে গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে তাদের গৃহীত যাবতীয় কর্মসূচি, পদক্ষেপ ও অত্যাবশ্যকীয় টেকনিক্যাল বিষয়ে জানাতে হলে অক্সিডেন্টাল তা পেট্রোবাংলাকে জানায় একেবারে শেষ মুহূর্তে অথবা কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর।
নির্দিষ্ট তথ্যটি অবগত হওয়া ছাড়া পেট্রোবাংলার তখন আর কিছুই করার থাকে না। গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে অক্সিডেন্টালের তথ্য গোপন করার অভিযোগে অক্সিডেন্টালকে ইতিপূর্বে নাইজেরিয়া থেকে পাততাড়ি গুটাতে হয়েছে। লিবিয়া থেকেও তাড়া খেয়ে ফিরে যায়। তাদের অপকর্মে নাইজেরিয়ার গ্যাস-তেল সম্পদ নিঃশেষীকরণ, পরিবেশ ও উর্বর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। মানুষ রোগে ভূগছে। পরিবেশ বিষাক্ত আকার ধারণ করেছে। অনুসন্ধান কূপ খনন করার সময় বিস্ফোরণ ঘটাতে হয়। এ কাজে সাধারণত ডিনামাইট জাতীয় বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু অক্সিডেন্টাল চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে মাগুরছড়ার গ্যাস কূপ খনন কাজে বিস্ফোরক হিসেবে প্রাণঘাতী ও পরিবেশ বিনাশী তেজস্ক্রিয়যুক্ত ‘রেডিও একটিভ সোর্স’ ব্যবহার করে। পেট্রোবাংলা এ সংবাদ জানতে পারে গ্যাস কূপ বিস্ফোরণের কয়েক মাস পর। পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য খনন কাজ স্বল্পতম সময়ে সম্পন্নকরণ। যত কম সময়ে কাজ সম্পন্ন করা যায় তত বেশী মুনাফা লাভ করা যায়।
জনগণের স্বাস্থ্য, জীবন ও পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে আমেরিকার কোম্পানী অক্সিডেন্টালের বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসেনি। বহুজাতিক পুঁজির আগমন ঘটেছে বহুজাতিক তান্ডব ও লুণ্ঠনের আদর্শ নিয়ে আমাদের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে নয়।
মাগুরছড়া ব্লো-আউট, বিশেষজ্ঞদের প্রথম দিকের প্রাথমিক ধারণা: মূল গ্যাস জোনের আয়তন ছিল দীর্ঘ ৫ কিলোমিটার এলাকা। এ কূপে এক ট্রিলিয়ন ঘনফুটেরও অধিক গ্যাস মজুদ ছিল বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মূল্য ছিল ৮ হাজার কোটি মার্কিন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫৮ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা। টাকার বারবার অবমূল্যায়নের কারণে এ মূল্য বর্তমানে আরো অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। জীব বৈচিত্রে সমৃদ্ধ এ সংরক্ষিত প্রাচীন অরণ্য ভূমির পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে তার অর্থনৈতিক মূল্যও হবে সমপরিমাণ। যদি প্রয়োজনীয় অর্থ বিনিয়োগ করা হয় তা হলেও ১৯৯৭ সালের ১৪ জুনের পূর্বেকার পরিবেশগত অবস্থা ফিরিয়ে আনতে লাগবে একশত বছরের অধিক কাল।
গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ও বন সম্পদের যৌথ ক্ষতির পরিমাণ ১ লক্ষ ১৬ হাজার ৮শ’ কোটির টাকারও বেশি। বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জাপানের ঋণ এবং এক দশকেরও অধিককাল ধরে জনগণের পকেট থেকে সংগৃহীত যমুনা সারচার্জের টাকায় নির্মিত যমুনা সেতুর নির্মাণ ব্যয় ৩ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। ১ লক্ষ ১৬ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা দিয়ে একচেটিয়া ঋণমুক্ত স্বাধীন অর্থনীতির নীতিমালায় ৩২টি যমুনা সেতুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেত। মাগুরছড়ার ভূমিতে ও আকাশে বিলীন হয়ে যাওয়া সম্পদের বিনিময়ে স্বাধীন জাতীয় বাজেট দেয়া যেত। এরফলে আমরা হয়তো চিরদিনের জন্যে অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ স্বাধীন-স্বয়ম্ভর হতে পারতাম।
গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিপরীতে ব্যয় দেখিয়ে অক্সিডেন্টাল ৩ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলারের মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের একটি হিসেব পেট্রোবাংলায় দাখিল করে। যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২৬২ কোটি ৮০ লাখ টাকা দাঁড়ায়।
গ্যাসকূপ খনন কাজে নিয়োজিত রয়েছে পেট্রোবাংলার অঙ্গ সংস্থা বাপেক্স। এ সংস্থার কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি যুক্ত পেট মোটা করে হজম সম্পন্ন করার পরও সার্থকভাবে একটি কূপ খননে সর্বোচ্চ ব্যয় হয় ৭৫ কোটি টাকা।
২৬ বছর পূর্ণ হলেও অক্সিডেন্টাল বা অক্সির উত্তরসুরী ইউনোকল পরবর্তীতে শেভরনের কাছ থেকে মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ আদায় করতে না পারাটা, রহস্যজনকই থেকে গেলো। মাগুরছড়া গ্যাসকূপ এলাকা পরিত্যাগকালে অক্সিডেন্টাল প্রচারণার সর্বোচ্চ মারণাস্ত্র প্রয়োগ করে। আড়াইশত বছরেরও অধিককাল ধরে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণ ও বহুজাতিক একচেটিয়া পুঁজির অধীনে শেকল টানা এ বিধ্বস্ত জনগোষ্ঠীর মুখে লেপন করে দেয়া হয় লুটেরা ও সন্ত্রাসীর কালিমা।
অক্সিডেন্টালের প্রচারণা বাস্তবতার সাথে যে সংগতিপূর্ণ নয় এ সত্যটি জনগণের কাছে অনেক আগেই পরিস্কার হয়ে যায়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ লক্ষণ দেখে বাস্তবতা উপলব্ধির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। কোন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বা বিচারকের রায়ের ওপর নির্ভর না করেই ঘটনা জাত সম্পর্ক, পরিবেশ ও লক্ষণসমূহ বিশ্লেষণ করে সঠিক অনুমানে পৌঁছে যেতে পারে মানুষ।
অক্সিডেন্টালের প্রচারণা সত্ত্বেও শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ এলাকার জনগণসহ বৃহত্তর সিলেটবাসী অক্সিডেন্টালের বিরুদ্ধে আক্রোশে-আন্দোলনে মাগুরছড়া গ্যাস কূপের আগুনের মত জ্বলে উঠতে থাকে। ছয় মাসেরও অধিককাল ধরে আগুনের গ্যাস উদগীরনকারী গ্যাস কূপের উৎস মুখ সিল করার কাজ সম্পন্ন হয় ৯ জানুয়ারি ১৯৯৮। তারও আগে ২০ ডিসেম্বর ১৯৯৭ থেকে অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া থেকে রাতের আঁধারে প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া জিনিসপত্র আস্তে আস্তে সরাতে আরম্ভ করে। চোরের মতো অবস্থান পরিবর্তন করতে দেখে জনগণের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ১০ জানুয়ারি ১৯৯৮ সালে কমলগঞ্জের রাস্তায় বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বামগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, ন্যাপ, জাসদ, বাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, সিপিবি-এর উদ্যোগে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ-মৌলভীবাজার সমগ্র সিলেট বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, পদযাত্রা আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু জনগণের আন্দোলনেও জনগণের সম্পদ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব হয়নি।
পিএসসি চুক্তি: সরকারের সঙ্গে ১৯৯৫ সনের ১১ জানুয়ারী সম্পাদিত উৎপাদন অংশীদারী চুক্তি ১৯৯৪ (Production Sharing Contract)- এর আওতায় অক্সিডেন্টাল কোম্পানী বাংলাদেশের তেল, গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য মৌলভীবাজার এলাকার ১৪ ও ১৩ নং ব্লক দু’টি ইজারা নেয়।
সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে সাত বৎসর পর্যন্ত অনুসন্ধান কাজ চালাতে পারতো। অবশ্য এই সাত বৎসর সময় ৩+২+২ এই তিনভাগে বিভক্ত। তিন বছর অনুসন্ধান কার্যক্রম সফল হলে চুক্তি মেয়াদ প্রথমবারের মতো দু’বছর বৃদ্ধি, পরবর্তীতে পুনঃ দু’বছর বৃদ্ধির সুযোগ থাকে। অবশ্যই গ্যাস উত্তোলন/আবিষ্কারে ব্যর্থ হলে সমস্ত এলাকা ছেড়ে দিতে হয়। তবে অনুসন্ধান কাজে যেকোন দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির দায়দায়িত্ব অক্সিডেন্টাল বহন করতে হবে।
অক্সিডেন্টালের উপর বাধ্যতামূলক করণীয়: মূলচুক্তি’ ৯৪-এর আর্টিক্যাল ১০-এর গুরুত্বপূর্ণ উপাংশে অক্সিডেন্টালের উপর আরোপিত বাধ্যতামূলক করণীয় নিম্নরূপ। খনিজের সম্পদ দক্ষ ও নিরাপদে উত্তোলন ও আহরণে খনি খনন পরিচালিত হতে হবে প্রযোজ্য আইন, সম্পাদিত চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক মানের পরিকল্পনা, বিবেক-বুদ্ধি প্রসূত এবং সুদক্ষ কারিগরী কায়দায়। সেক্ষেত্রে-যেকোন খনিজের সম্পদ, জলাদার এবং আর সব প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি প্রতিরোধে সকলপ্রকার যুক্তিযুক্ত সর্তকতা অবলম্বন করতে হয়।
পিএসসি আর্টিক্যাল-২৮: এ চুক্তির বৈধ্যতা, ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত হতে হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী।
সম্পুরক চুক্তি ’৯৮: ১৯৯৮ সালের ১০ জানুয়ারী অক্সিডেন্টালের সাথে চুক্তির মেয়াদ সাফল্যের সাথে শেষ না হলেও কুপ খনন চলাকালে মাগুরছড়া গ্যাস ফিল্ডের ব্লো-আউট হওয়া সত্ত্বেও ১৯৯৮ সালের ২৫ নভেম্বর Supplemental Agreement (Block-13 & 14) সম্পাদিত ও স্বাক্ষরিত হয় এবং চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি পায়।
সম্পুরক চুক্তির উদ্দেশ্য: নির্ধারিত প্রাথমিক সময়সীমার মধ্যে পিএসসি-৯৪ অনুযায়ী অক্সিডেন্টাল তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়নি বিধায় মূল চুক্তির (পিএসসি ’৯৪) সুনির্দিষ্ট কিছু বিধানে পরিবর্তন এনে অর্পিত দায়িত্ব সম্পন্ন করার সুযোগ দেয়ার জন্য আইনগত দিক দিয়ে অক্সিডেন্টালকে উক্ত কাজের যোগ্য ও উপযুক্ত করার অভিপ্রায়ে এ সম্পুরক চুক্তি।
সাপ্লিমেন্টাল এগ্রিমেন্টের ৩.৩ অনুচ্ছেদ: বিরূপ প্রচার হতে পারে বিধায় অক্সিডেন্টাল ব্যতীত এ চুক্তির কোন কিছু কেউই কোনক্রমেই জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারবে না। যদি প্রকাশ পায়, তাহলে বিরূপ প্রচার মোকাবেলার জন্য সরকার অক্সিডেন্টালকে সমর্থন ও সহযোগিতা দেবে।
ভূপাল দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ আদায়ের দৃষ্টান্ত: ১৯৮৪ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের ভূপালে ইউনিয়ন কার্বাইড লিমিটেড কর্তৃক পরিচালিত কীটনাশক কারখানায় ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়। ১৯৮৫ সালে ভারত সরকার ইউনিয়ন কার্বাইডের বিরুদ্ধে ভূপাল দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে নিউইয়র্কে দেওয়ানী মামলা দায়ের করে। আমেরিকার বিজ্ঞ আদালত প্রমাণ করেন যে, ভূপাল দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ মামলার আইনী নিষ্পত্তি ভারতীয় আদালতেই হওয়া আইনগত দিক দিয়ে যুক্তিযুক্ত। তারপর ভারত সরকার ইউনিয়ন কার্বাইডের বিরুদ্ধে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণের মামলা ভারতে দায়ের করে। ১৯৮৯ সালে ৪ মে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় আইনে এ ক্ষতিপূরণের মামলাটি নিষ্পত্তি করেন। ভূপাল দুর্ঘটনার কারণে ইউনিয়ন কার্বাইডের নির্বাহীদের বিরুদ্ধে ভারত সরকার কর্তৃক আনীত ফৌজদারী অভিযোগও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট নিষ্পত্তি করেন। তারপরও ইউনিয়ন কার্বাইড লিমিটেড ক্ষতিপূরণ প্রদানে এগিয়ে আসেনি। ২০০১ সালে ডো ক্যামিকেল নামের অপর এক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন কার্বাইডের সাথে একীভূত হলে নতুন প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিপূরণ প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে রশিদা বী এবং চম্পা দেবী শুক্লা’র নেতৃত্বে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আন্দোলন শুরু হয়। তারা এ দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের দাবীতে আন্তর্জাতিক প্রচারনা চাঙ্গা করে গড়ে তুলেন। তারা তাদের মতো নিম্নআয়ের এবং অশিক্ষিত মহিলাদের এ আন্দোলনে যুক্ত করেন। ২০০২ সালে দিল্লিতে ১৯ দিনের অনশন ধর্মঘট করে তারা তাদের এ দাবী আদায়ে সোচ্চার হন। বিশ্বের ১০টি দেশ থেকে প্রায় দেড় হাজার মানুষ মাসব্যাপী এই র্যালী ও অনশন ধর্মঘটে এসে যোগ দেয়। ভূপালের ক্ষতিগ্রস্থদের সমর্থনে এটাই ছিল সর্বপ্রথম বিশ্ব অনশন ধর্মঘট। ২০০৩ সালে তারা ডো ক্যামিকেলের বোম্বাই ও হল্যান্ড অফিসে হাজির হয়ে দুর্ঘটনার বিষাক্ত বর্জ্য সরবরাহ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ১০টি শহরে তাদের সমর্থনে আন্দোলনের কর্মসূচী পালন করেন। নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ষ্ট্রিটের সামনে ১২ দিনের অনশন পালন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ২৫টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন শহরের হাজার হাজার মানুষ আন্দোলনে শরীক হন। তারা যুক্তরাজ্য, চীন, স্পেন, থাইল্যান্ড ও কানাডায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। যুক্তরাষ্ট্রের সেকেন্ড আপীল কোর্ট রশিদা বী এবং চম্পা দেবী শুক্লা’র পক্ষে এই মামলার রায় ঘোষণা করেন এবং ডো ক্যামিকেলকে ক্ষতিপূরণের সমুদয় অর্থ পরিশোধ করার নির্দেশ দেন। আন্দোলনে নেমে দাবী আদায়ের যে দৃষ্টান্ত রশিদা বী এবং চম্পা দেবী শুক্লা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা অনেক দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৪ সালে রশিদা বী এবং চম্পা দেবী শুক্লাকে ‘গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল’ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
বিশ্লেষণ: ১. সম্পুরক চুক্তি’ ৯৮ অনুযায়ী অক্সিডেন্টাল বীমা কোম্পানীর নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ একশত মিলিয়ন ডলার পায়। গ্যাসকুপ বিস্ফোরণের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিপরীতে ব্যয় দেখিয়ে অক্সিডেন্টাল ১টি হিসাব পেট্রোবাংলায় দাখিল করে এবং সে হিসাব অনুমোদিত হয়।
বিশ্লেষণ ২ : কিন্তু সম্পুরক চুক্তির উদ্দেশ্য সফল করতে মৌলভীবাজার গ্যাস ফিল্ডের ১৩ ও ১৪নং ব্লকের গ্যাস উত্তোলনে পুনঃ নিয়োজিত না হয়ে ১৯৯৯ সালের কোন এক সময় বাংলাদেশে তার সমস্ত সম্পদ ও কার্যক্রম ইউনোকলের নিকট বিক্রয় বা বিনিময়ের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়ে সবার অগোচরে চলে যায়। সে সূত্রে ইউনোকল অক্সিডেন্টালের স্থলাভিষিক্ত হয় এবং পিএসসি চুক্তি ’৯৪ ও সম্পুরক চুক্তি ’৯৮-এ অক্সিডেন্টাল ইউনোকলের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। অক্সিডেন্টালের সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব ইউনোকলের উপরে অর্পিত হয়। পরবর্তীতে শেভরনের উপর এই দায়িত্ব অর্পিত হয়।
বিশ্লেষণ ৩ : অতঃপর ২০০২ সালের ২ জুলাই পেট্রোবাংলা আনুষ্ঠানিকভাবে পুরে যাওয়া গ্যাসের ক্ষতিপূরণ দাবী করে। সম্পুরক চুক্তি ’৯৮-এর আওতায় ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে এবং ঐ সম্পুরক চুক্তিতে ক্ষতিপূরণ হিসাবে ৫% অতিরিক্ত গ্যাস দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে ইউনোকল ক্ষতিপূরণের দাবী নাকচ করে দেয়।
আমাদের করণীয়:
ক) অক্সিডেন্টাল পিএসসি ’৯৪ আর্টিকেল-১০ লঙ্ঘন করেছে। গ্যাস উত্তোলন পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিল। কুপ খননে নিষ্ঠা, বুদ্ধি বিবেচনা ও কারিগরী দক্ষতার পরিচয় অনেক ক্ষেত্রে পাওয়া যায় নি। যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়েছে তা অবহেলা ও দক্ষতার প্রমাণ হিসাবে বিবেচ্য। অক্সিডেন্টালের অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে বিস্ফোরণ ঘটেছে, কারিগরী ও আইনগত দিক দিয়ে অক্সিডেন্টালকে অভিযুক্ত করা যায়।
খ) সম্পাদিত চুক্তি ’৯৪-এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন না করে অক্সিডেন্টাল সম্পূরক চুক্তি ’৯৮-এর আওতায় সম্পাদিত চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। পিএসসি ’৯৪ এর আর্টিকেল-১০ লঙ্ঘন করে অক্সিডেন্টাল তেল গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধান কাজের অযোগ্য ও অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগ এবং বেলা কর্তৃক হাইকোর্টের দায়েরকৃত ৬১০৫/১৯৯৭ নং রীট আবেদনে আনীত অভিযোগ সমূহ নিষ্পত্তি ব্যতীত সম্পূরক চুক্তি ’৯৮ সম্পাদিত হওয়ায় আইনী বৈধতার প্রশ্নে এক চুক্তি এখন বিতর্কিত।
গ) ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন ব্লো-আউটের পর থেকেই মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা ছিল। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। সরকারের যেসব নির্বাহী কর্মকর্তারা যেসব অর্থ ও স্বার্থে অক্সিডেন্টালের সাথে সম্পূরক চুক্তি ’৯৮ সম্পাদন করেছেন এবং পরবর্তীতে চুক্তি অনুযায়ী কোন কাজ না করে নির্বিবাদে অক্সিডেন্টালকে এ দেশ ত্যাগ করার সুযোগ দিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন বলে প্রতিয়মান। নিজেরা লাভবান হয়েছেন ও অক্সিডেন্টালকে লাভবান করেছেন। দেশের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি করেছে। এ সত্য এখন সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত।
ঘ) সম্পূরক চুক্তি ’৯৮ ক্ষতিপূরণ আদায়ের ক্ষেত্রে একমাত্র আইনগত বাঁধা। সেক্ষেত্রে চুক্তি বাতিল হওয়া জরুরী।
ঙ) ভূপাল দূর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ আদায়ে ভারতের অভিজ্ঞতা মাগুরছড়া ব্লো-আউটে গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায়ে মাইল ফলক হিসেবে গণ্য হবে।
চ) মাগুরছড়া ব্লো-আউট সম্পূরক চুক্তি ’৯৮ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ’৯৫ লঙ্ঘনে জড়িত অক্সিডেন্টাল ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানী ও ফৌজদারী অভিযোগ আনা যাবে।
ব্লো-আউটের কারণ: মাগুরছড়া গ্যাস ফিল্ড ব্লো-আউট তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বিস্ফোরণের সম্ভাব্য চিহ্নিত কারণসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
১. ৫২৭ – ৭৯৫ মিটার গভীরতা পর্যন্ত খননকৃত কুপের অভ্যান্তরীন গাত্রে কোন casing-এর পরিকল্পনা ছিলনা। সুতরাং কুপের এ অংশে কোন casing ছিলনা এবং কুপের অভ্যান্তরীন গাত্রের ঐ অংশটি অনাবৃত ছিল। যদি তা থাকত তাহলে বিস্ফোরণ প্রশমিত হতে পারত।
২. গ্যাসন্তরের অস্তিত্ব জানা থাকা সত্বেও কুপের deviation point গ্যাসস্তরের অভ্যন্তরে নির্ধারণ করা হয়েছে। যদি গ্যাসস্তরের উপরে কিংবা নীচে এ deviation point নির্ধারণ করা হ’ত, তাহলে এ বিস্ফোরণ এড়ানো সম্ভব হতে পারত। তাছাড়াও casing এবং পাইপ-এ cementation সন্তোষজনক ছিলনা এবং তা ছিল নিম্নমানের।
৩. খননকালে কুপের অভ্যন্তরে mud circulation এর সাহায্যে উর্দ্ধমুখী গ্যাসের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। mud ইঞ্জিনিয়ার কুপের mud parameters-এর অবস্থা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না এবং তা mud parameters monitoring করেন নি। বরং তিনি সংকটকালীন সময়ে mud circulation এবং কূপ খননে জড়িতদের সংগে যোগাযোগ রক্ষা না করে গবেষণাগারে প্রায় দু’ঘন্টাকাল অতিবাহিত করেন। যদি যথাসময়ে mud parameters-এর মাধ্যমে mud parameters নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত, তাহলে গ্যাস প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ হ’ত এবং বিস্ফোরণ এড়ানো হয়ত সম্ভব হ’ত।
৪. কূপের সংকটাপন্ন অবস্থা অনুধাবন করা সত্ত্বেও কূপ খনন থামানো হয় নি।
৫. ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন রাতে ড্রিলিং সুপারভাইজার, মাড ইঞ্জিনিয়ার, মাড লগার, ড্রিলিং কারিগর- এদের মধ্যে তত্ত্বাবধান, সমন্বয় ও যোগাযোগের অপ্রতুলতা কূপের সংকটকালীন অবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
৬. খনন কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ অক্সিডেন্টালের অনুমোদিত কর্ম পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাপ্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেন নি।
৭. গ্রহণযোগ্য মানের কোন অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না। তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা মান সম্মত ছিল না।
৮. মাগুরছড়ায় কুপ খননের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক এমনকি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য কোন মান/নীতি অনুসরণ করা হয়নি।
৯. অতঃপর খননকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলা ও সম্মিলিত ত্রুটি-বিচ্যুতিই বিস্ফোরণকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলে।
ব্লো-আউটের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ: ১৯৯৭ সালের ৩০শে জুলাই প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদনে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। ভূগর্ভস্থ সম্পদ যথা- গ্যাস ও পানি সম্পদ এবং পরিবেশ সহ ভূ-উপরিস্থ সম্পদ বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তদন্তকালীন বিভিন্ন সংস্থা/কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে ক্ষতি বা ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্পদের বিবরণ পাওয়া যায়।
ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নিম্নরূপ:
গাছপালা, চা বাগান, বিভিন্নভাবে পরিবেশ আক্রান্তসহ সর্বমোট ১৩৭৬৮.৪৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও অক্সিডেন্টালের ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদের মূল্য ১৭৬.৮২ কোটি টাকা।
তদন্ত রির্পোটে ব্লো-আউটে পুড়ে যাওয়া গ্যাসের পরিমাণ উল্লেখ করা হলেও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপন করা হয়নি। এক্ষেত্রে প্রতি ১০০০ ঘনফুট গ্যাস ২.৬ মার্কিন ডলার হিসাবে বাংলাদেশী টাকায় (১ ডলার = ৬০ টাকা) ৩৮৩৪.৪৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অক্সিডেন্টালের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এ হিসাবে ধরা হয়নি। তদন্ত রির্পোটের ৮.৪.৬ ও ৮.৬ অনুচ্ছেদে যথাক্রমে ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদ ও পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দেয়া হয়েছে। আর্থিক পরিমাণ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নিরূপনের সুপারিশ করা হয়েছে। রির্পোটে স্থানীয় অধিবাসীদের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য স্পষ্ট নয়। তবে BELA র তদন্ত রির্পোটে দেখা যায় ৪০টি খাসিয়া পরিবার গৃহহীন হয়। তাদের ঘরবাড়ীসহ উপার্জনের একমাত্র পথ পানের বরজও ধ্বংস হয়।
শেভরনের জাতীয় গ্রীডে গ্যাস সরবরাহ প্রসঙ্গে: মাগুরছড়া মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের একটি জায়গার নাম। ১৯৯৭ সালের জুন মাসে স্থানটি রাতারাতি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়। এখনো প্রতি বছর ‘মাগুরছড়া দিবস’- ছাড়াও মাঝে মাঝে সংবাদ শিরোনামে মাগুরছড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে জনগণের সামনে আবির্ভূত হয়। বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীর সাথে হিসেব-নিকেশ শেষে পিএসসি চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পাচ্ছে তেল-গ্যাস সম্পদের ২১ ভাগ, আর বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানী লুটে নিয়ে যাবে গ্যাস-তেল সম্পদের ৭৯ ভাগ। আর বাপেক্স উত্তোলন করলে পুরোটার মালিক হতো দেশ। বিদেশী কোম্পানী গ্যাস অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে তারা আবার বড় বড় বিপর্যয় ঘটাতে পারে, যা ইতিমধ্যেই মাগুরছড়া ও টেংরাটিলা (ছাতক) গ্যাসকূপ সমূহের দুর্ঘটনায় প্রমাণিত। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, বিদেশী কোম্পানীর কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে ডলারে। সরকার ভর্তুকী দিয়ে কেনার ফলে শত শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা দেশ থেকে চলে যাচ্ছে এবং এরই বিষময় ফল হচ্ছে জনগণকে বেশী দামে গ্যাস ও বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশের মাটির তলার সেই গ্যাস শেভরন কোম্পানীর কাছ থেকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস ৩ ডলার দরে কিনতে হচ্ছে। এতে দেশ অচিরেই বিরাট বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বাংলাদেশকে শেভরন কোম্পানীর স্বার্থে মুনাফা যোগান দিতে গিয়ে প্রতিদিন ভর্তুকী দিতে হচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হলে সরকারকে জনগণের জ্বালানী গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধি করতে হবে। এর ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দামও চক্রবৃদ্ধিহারে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য বাংলাদেশের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান রয়েছে বাপেক্স। বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠান তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কয়েকগুণ বেশী সাফল্য দেখিয়েছে। বিদেশী কোম্পানীর কাছে তেল-গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দেয়ায় বাপেক্সের ৩০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ছে, ১৩০০ দক্ষ কর্মকর্তা বেকার হচ্ছে ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হচ্ছে। বিদেশী কোম্পানীকে ইজারা দেয়ায় গ্যাস আবিষ্কারের খরচ দিতে হচ্ছে আমাদের। অথচ তেল-গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনে বাপেক্সের খরচ বিদেশী কোম্পানীর চেয়ে অনেক অনেক কম।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সকল গ্যাসক্ষেত্র দেশীয় কোম্পানী বাপেক্সকে দিয়েই কূপ খনন-উত্তোলন-বিপণন করা যেত। এজন্য বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীকে শেয়ার দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আর্থিক অনটনের প্রশ্ন অবান্তর। হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাস উত্তোলনের জন্য বর্তমানে মাত্র ৭৫ কোটি টাকা দিয়ে কূপ খনন করা যায়। দেশের বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী প্রতিবছর মাত্র ৪টি কূপ খননের জন্য ৩০০ কোটি টাকা করা দরকার হয়। এছাড়া প্রতিবছর পেট্রোবাংলা ২,০০০ কোটি টাকার উপরে সরকারকে প্রদান করে, এর শতকরা ৬.৬৬ ভাগ অর্থাৎ ৩০০ কোটি টাকা অন্তত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে ব্যয় করা হলে তেল-গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন খাতে বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন হয় না। কারিগরি দক্ষতার প্রশ্নও অবান্তর। ইতিমধ্যে বাপেক্স ফেঞ্চুগঞ্জ, সালদা নদী ইত্যাদি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে উৎপাদন চালু রেখেছে। তাহলে মাগুরছড়া, ছাতক-টেংরাটিলাসহ সকল গ্যাসক্ষেত্রে কূপ খনন করতে বাপেক্সের পক্ষে কোনো অসুবিধা ছিল না। সরকার যদি শেভরন কোম্পানীর স্বার্থে মুনাফা যোগান দিতে গিয়ে মৌলভীবাজারের ২টি কূপের গ্যাস ক্রয় বাবদ শত শত কোটি টাকা বছরে ভর্তুকি দিতে পারে। তাহলে প্রতিবছর পেট্রোবাংলা যে উদ্বৃত্ত ফান্ড সরকারকে প্রদান করে, এর শতকরা ৬.৬৬ ভাগ তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের মাধ্যমে গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ দেয়া সম্ভব নয় কেন?
অক্সিডেন্টাল কোম্পানীর ক্ষতিপূরণ বাবদ ১০ কোটি মার্কিন ডলার লাভ: মাগুরছড়া থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার সময় নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর উত্তরসূরী অক্সিডেন্টাল এলাকার প্রতিবাদকারী জনগণের সামনে বিছিয়ে দেয় ষড়যন্ত্রের জাল। কূপ এলাকায় কর্মরত শ্রমিকদের বলা হয় তারা ইচ্ছে করলে পরিত্যক্ত মালামাল কুড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। নব্য ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মহানুভব অনুমতি পেয়ে শত শত বছর ধরে শ্রম ও সম্পদ শোষণের ফলে পুরুষানুক্রমে দরিদ্র শ্রমিকরা হাতুড়ি শাবল নিয়ে পরিত্যক্ত মালামাল কুড়ানোর সংবাদ আশপাশে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় নেতৃত্বে জনগণের একটা অংশও এ মালামাল সংগ্রহে শরিক হয়ে যায়। এ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করার জন্যে আগে থেকেই ওঁৎ পেতে ছিল অক্সিডেন্টালের ষড়যন্ত্রের ভিডিও ক্যামেরা। কয়েকদিন ধরে অক্সিডেন্টালের ফেলে যাওয়া মালামাল সংগ্রহের উদ্দীপনা-কামড়া-কামড়ি চলে। শাসক শ্রেণীর আমলাতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোতে জনগণের চিন্তা ও আচরণ অক্সিডেন্টালের স্থানান্তর কার্যক্রমকে করে তোলে প্রতিরোধহীন, নির্বিঘ্ন। লুটপাটেরও ভিডিও দেখিয়ে অক্সিডেন্টাল বীমাকৃত মালামালের বিপরীতে বীমা কোম্পানিকে লোকসানের হিসাব বাড়িয়ে দেখাতে সক্ষম হয়। বিস্ফোরণের কারণে অক্সিডেন্টাল কোম্পানি ক্ষতিপূরণ বাবদ লাভ করেছে ১০ কোটি মার্কিন ডলার।
মাগুরছড়ার ক্ষতিপূরণ, ইউনোকলের এক ভূতুরে হিসাব: মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যাপারে এক হিসাব দিয়েছে মার্কিন কোম্পানি ইউনোকল। তারা বলছে, ক্ষতিপূরণ হিসাবে পেট্রোবাংলাকে ১৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলার তৎকালীন চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘পেট্রোবাংলা এ ধরনের কোনো টাকাই পায়নি। মাগুরছড়া গ্যাস কূপ বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, ক্ষতিপূরণ পাওয়া ও বিতরণের জন্য গঠিত সংসদীয় সাব-কমিটির জন্য পেট্রোবাংলা ইউনোকলের কাছে কাগজপত্র চাইলে তারা এব্যাপারে যে কাগজপত্র সরবরাহ করেছে, তাতেই ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। পেট্রোবাংলা যথারীতি সরবরাহকৃত কাগজপত্র সাব-কমিটির কাছে দিলে বিষয়টি সর্ব প্রথম কমিটির নজরে পড়ে। সাব কমিটি বলেছে, ইউনোকলের দেয়া এ টাকা গেল কোথায়? সাব-কমিটি ইউনোকলের কাগজপত্রে মাগুরছড়ার ব্যাপারে ক্ষতিপূরণ হিসাবে ১৭৪ কোটি ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১১৫ টাকা পরিশোধের তথ্য পেয়েছে। কাগজপত্রের আরেক স্থানে ২০০০ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৩৩২ কোটি ৩২ লাখ ৮৮ হাজার ৯০০ টাকা প্রদানের কথা উল্লেখ আছে। সংসদীয় সাব-কমিটি ইউনোকলের ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টিকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে অভিহিত করেছে। অত্যন্ত গোপনে আমলাদের সহযোগিতায় অক্সিডেন্টাল চূড়ান্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে ইউনোকলের কাছে ১২, ১৩, ১৪ নং গ্যাস ব্লকের মালিকানা ’৯৮ সালে বিক্রি করে আরো কয়েক হাজার কোটি মার্কিন ডলার লাভ করে। অক্সিডেন্টালের মালিকানাধীন গ্যাসক্ষেত্র লুণ্ঠনের ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত ও প্রচারিত হয় অক্সিডেন্টালের উন্নত ও সভ্য দেশের প্রচার মাধ্যমে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রেও সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয় অক্সিডেন্টালের মালামাল লুটপাটের।
১৮৭২ সালের চুক্তি আইন অনুযায়ী জাতীয়স্বার্থ বিরোধী সকল ‘পিএসসি’ চুক্তি বাতিল করা সম্ভব: দেশের জনগণের ও জাতীয়স্বার্থ পরিপন্থী জ্বালানি প্রকল্পের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারকে অবস্থান নিতে হবে। বর্তমান সরকারকে এ ব্যাপারে সজাগ হতে হবে। বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা প্রজাতন্ত্রের তথা জনগণের সম্পত্তি। সংবিধানের ১৪৩ (১)নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ; ‘ক. বাংলাদেশের যে কোনো ভূমির অন্তঃস্থ সব খনিজ ও অন্যান্য মূল্যসম্পন্ন সামগ্রী; খ. বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার অন্তর্বর্তী মহাসাগরের অন্তঃস্থ কিংবা বাংলাদেশের মহীসোপানের উপরিস্থ মহাসাগরের অন্তঃস্থ সকল ভূমি, খনিজ ও অন্যান্য মূল্যসম্পন্ন সামগ্রী; …’, প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তি প্রকৃত অর্থে জনগণ এর মালিক। কাজেই তথাকথিত রয়ালটির নামে জনগণের সম্পত্তি কোনো বিদেশি কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করা যাবে না। দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে গ্যাস ও কয়লা বা গ্যাস-কয়লাজাত কোনো পদার্থ বিদেশে রফতানি করা যাবে না। যদি করা হয়, তবে জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
অতীতের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন মহল জ্বালানি খাতের প্রস্তাবগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থির সময় বেছে নেয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০১ সালে গ্যাস রফতানি প্রস্তাব, একই বছরে আগে আবিস্কৃত ও কিছুকাল উৎপাদনরত টেংরাটিলা-ছাতক গ্যাসক্ষেত্র, ২০০৫ সালে টাটার বিতর্কিত বিনিয়োগ প্রস্তাব এবং এশিয়া এনার্জি কোম্পানির ফুলবাড়ী কয়লাখনি প্রস্তাবগুলো। এগুলো তো নেহাত কাকতালীয় ব্যাপার না। হিসাব করা ঝুঁকি দেশের জন্য। বিগত সরকার কি একবারও ভেবেছিল, এসব প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে দেশে জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতা কি চরম আকার ধারণ করতে পারে? একটা কথা সাম্রাজ্যবাদী ও বহুজাতিক কোম্পানীর তথাকথিত বিনিয়োগ প্রস্তাবকারীরা ভালোভাবেই প্রচার করে থাকে যে, যেনতেন প্রকারে একটি চুক্তি হয়ে গেলেই সম্পাদিত চুক্তির শর্ত যতই দেশের মানুষের স্বার্থবিরোধী হোক না কেন তা নাকি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মেনে নিতে সরকার বাধ্য থাকবে। সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমানও ফুলবাড়ী কয়লা খনি সংক্রান্ত এশিয়া এনার্জির সঙ্গে চুক্তিকে দেশের… স্বার্থবিরোধী আখ্যা দিয়েও চুক্তি বাতিল করা যাবে না বলে বক্তব্য দিয়েছিলেন! আসলে দেশের স্বার্থবিরোধী হলে চুক্তি বাতিল করা যাবে না কথাটা ঠিক নয়। কারণ ১৮৭২ সনের চুক্তি আইনে চুক্তির সংজ্ঞা, চুক্তি গঠন বা সম্পাদনে অত্যাবশ্যকীয় যেসব উপাদানের কথা বলা হয়েছে, বিদেশী কোম্পানীগুলো সেইসবের অনুসরণ করতে দেয় নি বলে সম্পাদিত চুক্তিই তার প্রমাণ। Under Section 2 (h) of the Contract Act, 1872, “An agreement enforceable by Law is a Contract”. According to Sir Salmond, “A Contract is an agreement creating and defining obligations between the parties”. Sir Frederic Pullock defines, “Every agreement and promise enforceable at Law is a Contract.” According to Sir Anson, “A Contract is an agreement enforceable at Law made between two or more persons by which rights are acquired by one or more to act or forbearance on the part of the other.” Essential elements necessary for the formation of a valid Contract: “1. Offer and Acceptance, 2. Agreement, 3. Legal Relationship, 4. Lawful Consideration, 5. Capacity to Contract, 6. Legality of the Object, 7. Free Consent, 8. Certainty, 9. Possibility of Performance, 10. Must not be in abuse of Legal Process, 11. Contract not expressly declared void by Law, 12.Writing and Registration.” এ ছাড়া ১৮৭২ সনের চুক্তি আইন অনুযায়ী চুক্তি গঠনের অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে বিষয়বস্তুর বৈধতা। কোন চুক্তিকে বৈধ হতে হলে এর উদ্দেশ্য ও প্রতিদান অবশ্যই বৈধ হতে হবে। অবৈধ, নীতি-বিগর্হিত, জনস্বার্থ বিরোধী, জাতীয়স্বার্থ বিরোধী ইত্যাদি সম্মতি অবৈধ উদ্দেশ্য বিবেচনায় চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয় না বিধায় উহা আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য হয় না। কোন চুক্তির বিষয়বস্তু বা এর উদ্দেশ্য যদি প্রচলিত আইনের বা জন-নীতির পরিপন্থী হয়, কিংবা তা নৈতিকতা-বিরোধী হয়, তবে সংশ্লিষ্ট চুক্তিটি বৈধ হতে পারে না। ১৮৭২ সনের চুক্তি আইনের ২৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, নিম্নলিখিত অবস্থায় সম্মতির উদ্দেশ্য ও প্রতিদান অবৈধ বলে গণ্য হয়ে থাকে। যেমন:- (ঘ) গণনীতি বিরুদ্ধ সম্মতি (Agreement against Public Policy), ”যে সম্মতি বলবৎ করলে জনস্বার্থ ক্ষুন্ন হয়, সেই সম্মতিকে গণনীতি বিরুদ্ধ সম্মতি বলা হয়। যে সম্মতির উদ্দেশ্য বা প্রতিদান গণনীতির পরিপন্থী, সেই সম্মতি বাতিল বলে গণ্য হবে।” যেমন জাতীয়স্বার্থ বিরোধী ‘উৎপাদন অংশীদারী চুক্তি’(Production Sharing Contract-PSC)-পিএসসি চুক্তি, Joint Venture Agreement, JVA, (Supplemental Agreement) বা সম্পূরক চুক্তি, দেশের জনস্বার্থ বিরোধী অসম বাণিজ্য চুক্তি ইত্যাদি।
বিগত সরকার সমূহের আমলে যেহেতু গ্যাস ও তেল উত্তোলন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিদেশী তেল কোম্পানির সঙ্গে সংগঠিত আলোচনা ও সম্পাদিত অসম, অযৌক্তিক, লুণ্ঠন ভিত্তিক, জাতীয় স্বার্থবিরোধী, দেশের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতিকর উৎপাদন অংশীদারী চুক্তিগুলো দুর্নীতিরই ফসল; সেহেতু সেইসব চুক্তি ১৮৭২ সালের চুক্তি আইনে বাতিলযোগ্য। অবৈধ, নীতি-বিগর্হিত, জনস্বার্থ বিরোধী, জাতীয়স্বার্থ বিরোধী ইত্যাদি সম্মতি অবৈধ উদ্দেশ্য বিবেচনায় চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয় না বিধায় বর্তমান সরকার অবৈধ প্রভাব ও দুর্নীতির কারণ দেখিয়ে সেইসব চুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা করতে পারেন। এবং আমি মনে করি সরকারের উচিত এসব চুক্তি বাতিল ঘোষণা করা। অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে বিদেশীরাই আমাদের দেশে এমনসব উন্নয়ন বিরোধী এসব ভয়ংকর চুক্তি সম্পাদন করিয়েছে। যার দায়ভার বিদেশীরা এড়াতে পারে না। প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে, বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানী সমূহের সাথে সম্পাদিত সকল অসম চুক্তি বাতিল করা।
‘মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি’র পক্ষ থেকে ১০টি দাবিতে আন্দোলন করে আসছে।
দাবিসমূহ হচ্ছেঃ ১. মাগুরছড়ায় দায়িত্বহীনতার কারণে যে ব্লো-আউট ঘটেছে এবং গ্যাস সম্পদ, পরিবেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তার জন্যে অক্সিডেন্টাল-ইউনোকল-শেভরনের কাছ থেকে কমপক্ষে ১৩,৭৬৮.৪৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে আদায় করুন। ২. মাগুরছড়ায় গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণে পরিবেশগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত আনারস, লেবু, ভূমি, বসত বাড়ি, পশু পাখি, প্রাকৃতিক শোষণ ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক উৎপাদন, পশু পাখির বসতি, ভূপৃষ্ঠস্থ প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ, ভূগর্ভস্থ পানি স্তরের অধোগমন, প্রাণ বৈচিত্র, ভূমিস্থ অনুজীব, বনজ সম্পদ এবং মৃত্রিকার যে অপূরণীয় ক্ষতি, সেই ক্ষতিপূরণ আদায় করুন। ৩. মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ, বন, পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের অপরাধে অক্সিডেন্টাল কোম্পানীর বিরুদ্ধে তার দেশের গাফিলতি আইন (Law of Negligence) কঠিন দায়িত্বের আইন (Law of Strict Liability) ও ক্ষতিপূরণের আইন (Law of Compensation) এর আওতায় আদালতে মামলা দায়ের করুন। ৪. গ্যাস ও তেল উত্তোলন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিদেশী তেল কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত অসম, অযৌক্তিক, লুণ্ঠন ভিত্তিক, জাতীয় স্বার্থবিরোধী, দেশের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতিকর উৎপাদন অংশীদারী চুক্তিগুলো অবিলম্বে বাতিল করুন। ৫. গ্যাস ও তেল হলো জনগণের সম্পত্তি, এর মালিক সমগ্র জনগণ, তাই জনগণের অবগতির জন্য এ যাবৎকালে সংগঠিত সব আলোচনা, চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করুন। ৬. বাংলাদেশের জন্য মূল্যবান খনিজ সম্পদ লুণ্ঠন, অপচয় করার প্রক্রিয়ায় জড়িত যেই হোন না কেন তাদের চিহ্নিত করুন। ৭. বিদেশী কোম্পানিকে মুনাফা যোগান দেয়ার জন্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর পরামর্শে দেশের উৎপাদনশীল খাত ক্ষতিগ্রস্ত করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো বন্ধ করুন। ৮. দেশের শিল্পায়ন ও উৎপাদনশীল সামগ্রিক উন্নয়ন চাহিদা বিবেচনা করে এবং তার সঙ্গে সমন্বিতভাবেই গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই অনুসন্ধানের প্রক্রিয়ায় আগামীতে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রতিবছর দেশীয় কোম্পানি উত্তোলিত গ্যাস বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থের অন্তত শতকরা ২০ ভাগ গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন গবেষণা শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রভৃতি কাজে ব্যয় করুন। ৯. দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে পঙ্গু করা চলবে না। গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনের দায়িত্ব প্রধানতঃ বাপেক্সকে দিতে হবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ১০. শহর-গ্রামে তথা দেশের সর্বত্র এবং কলে-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করতে হবে।
আইনী ব্যবস্থা: ২০০৩ সালের ১১ মে ইউনোকলের ওপর রুলনিশি জারি করেছে হাইকোর্ট। কেন সম্পূরক চুক্তি বাতিল করা হবে না এবং মাগুরছড়া গ্যাস ফিল্ডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ প্রদানের আগে গ্যাস-তেল উত্তোলন বন্ধ রাখতে কেন ইউনোকলকে নির্দেশ দেয়া হবে না- এ মর্মে ২ সপ্তাহের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। একই সাথে সরকার ও পেট্রো বাংলাকেও কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। বিচারপতি মোঃ আব্দুর রশীদ ও বিচারপতি সিদ্দিকুর রহমান মিয়ার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। চট্টগ্রামের বিআইটির ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগের প্রধান প্রফেসর এম শামসুল আলমের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ রুলনিশি জারি হয়। রিট আবেদনে বলা হয়, ১৯৯৫ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের সাথে মার্কিন তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি অক্সিডেন্টালের চুক্তি হয়। এরপর ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মাগুরছড়া গ্যাস ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডে বিপুল অংকের ক্ষতি হয়। এ ব্যাপারে সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে। রিপোর্টে বলা হয় ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার জন্যে কোম্পানি দায়ী।
ওদিকে ১৯৯৮ সালের ২৫ নভেম্বর ক্ষতিপূরণের কোন শর্ত না রেখেই ২য় দফায় সম্পূরক চুক্তি হয়। এ কারণে ওই চুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন দাখিল করা হয়। শুনানীতে আইনজীবীরা বলেছেন, অক্সিডেন্টাল দেশের প্রচলিত পেট্রোলিয়াম ও পরিবেশ আইন না মেনে কাজ শুরু করে। এছাড়া, তারা কোম্পানির সকল দায়-দায়িত্ব ইউনোকলকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে ইউনোকলের প্রতি রুলনিশি জারির আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রুলনিশির কোনো সন্তোষজনক জবাব ইউনোকল দেয়নি। সরকার কর্তৃক আইসিসি কোর্টে মামলা করার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল। এছাড়া ২০০৪ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী জাতীয় সংসদে গোলাম হাবিবের এক প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ডে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিপূরণের জন্য বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করবে বলে জানায়। ক্ষতিপূরণ আদায়ের কোনো সুরাহা এখনো পর্যন্ত হয়নি। মাগুরছড়ার ক্ষতিপূরণ আদায়সহ ৫ দফা দাবিতে ঢাকার পল্টন ময়দান থেকে বৃহত্তর সিলেটের বিবিয়ানা, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-খুলনা-মংলা অভিমুখে লংমার্চ করা হয়েছে। এতো আন্দোলনের পরও জনগণের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, মার্কিন বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানী ইউনোকল মাগুরছড়া গ্যাসকূপ ব্লো-আউটের ক্ষয়ক্ষতি বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ না দিয়েই বিস্ফোরিত গ্যাসকূপের কাছাকাছি ১৪ নং ব্লকের এমবি-৪ ও এমবি-৫ নামে ২টি কূপ খনন কিভাবে সম্পন্ন হলো এবং কিভাবে এই ২টির গ্যাস কালাপুরে স্থাপিত প্রসেসিং প্লান্টে সঞ্চালনের জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের লাল তালিকাভূক্ত লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক-রিজার্ভ ফরেষ্টের ভেতর দিয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনাশী গ্যাস গ্যাদারিং পাইপ লাইন নির্মাণ সম্পন্ন করে।
Bangladesh Environmental Lawyers Association-BELA বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে ৬১০৫/১৯৯৭ নং রীট আবেদন দাখিল করে। উক্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে মাননীয় হাইকোর্ট মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ড ব্লো-আউটের জন্য অক্সিডেন্টাল অব বাংলাদেশ লিমিটেড’কে কেন দায়ী করা হবে না মর্মে ২৮/০৮/১৯৯৭ইং তারিখে রুলনিশি ইস্যু করেন।
লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক-রিজার্ভ ফরেষ্টের ভেতর পাইপ লাইন নির্মাণ, পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস: মার্কিন বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানী ইউনোকল মাগুরছড়া গ্যাসকূপ ব্লো-আউটের ক্ষয়ক্ষতি বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ না দিয়েই বিস্ফোরিত গ্যাসকূপের কাছাকাছি ১৪নং ব্লকের এমবি-৪ ও এমবি-৫ নামে ২টি কূপ খনন সম্পন্ন এবং এই ২টির গ্যাস কালাপুরে স্থাপিত প্রসেসিং প্লান্টে সঞ্চালনের জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের লাল তালিকাভূক্ত লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক-রিজার্ভ ফরেষ্টের ভেতর দিয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করে গ্যাস গ্যাদারিং পাইপ লাইন নির্মাণ করেছে। ইউনোকল কোম্পানী প্রাথমিক পরিবেশগত মূল্যায়ন (Initial Environmental Examination-IEE) এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সাইট ক্লিয়ারেন্স (Site Clearence) পেলেও এনভায়রনমেন্টাল ইমপেক্ট এসেসমেন্ট (Environmental Impact Assessment-EIA) ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (Environmental Clearence Certificate) ছাড়াই ঐ কাজ চালায়। পাইপ লাইন নির্মাণের কাজে ইউনোকল বনজ সম্পদ, বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ-প্রতিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে বলে বনবিভাগ বহু আগেই অভিযোগ করেছে। অভিযোগে আরো বলা হয় যে, লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক-রিজার্ভ ফরেষ্টের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত ৮/৯ ফুট প্রশস্ত পায়ে হাটার পথকে গাড়ী চলাচলের রাস্তা দেখিয়ে প্রাথমিক পরিবেশগত মূল্যায়ন রিপোর্ট জমা করা সাপেক্ষে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সাইট ক্লিয়ারেন্স (Site Clearence) নিয়ে ইউনোকল উক্ত রাস্তাকে নির্মাণ কাজের সময় ২৫/৩০ ফুট চওড়া করে। লাউয়াছড়া বনাঞ্চলের ভেতর প্রায় পৌনে দুই কিলোমিটার পথে অসংখ্য গাছ, লতা, গুল্মাদি ও প্রাকৃতিক ঝোপঝাড় কেটে পরিস্কার করে পরিবেশ-প্রতিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করা হয়েছে। এতে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কের প্রায় সোয়া দুই কিলোমিটার অংশের প্রাকৃতিক উদ্ভিরাজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টিলার মাটি কেটে ড্রেসিং ও লেবেলিং করায় ভূমিক্ষয়ের আশংকা দেখা দিয়েছে। গ্যাস গ্যাদারিং পাইপ লাইন নির্মাণ কাজে ভারী যানবাহন ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার, শ্রমিকের কোলাহল প্রভৃতি কারণে পরিবেশ বিনষ্ট এবং ন্যাশনাল পার্ক-রিজার্ভ ফরেষ্টের বন্যপ্রাণী বাইরে চলে আসার অভিযোগ করা হয়েছে। পাইপ লাইন নির্মাণকালীন সময়ে বনবিভাগ ও ইউনোকল ক্ষতিগ্রস্ত উদ্ভিদের যে যৌথ জরীপ সম্পন্ন করে তাতে ইউনোকল স্বাক্ষর করেনি। বনবিভাগের এসব অভিযোগকে ইউনোকল গুরুত্বই দেয় নি। বরং ইউনোকলের প্রেসিডেন্ট এন্ডো এল ফথ্রপ এসব অভিযোগ ও বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকাতে ছবিসহ প্রকাশিত লাউয়াছড়া সংক্রান্ত সরজমিন প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলে দাবী করেছে। ইউনোকল প্রেসিডেন্ট এন্ডো এল ফথ্রপ প্রাথমিক পরিবেশগত মূল্যায়ন (Initial Environmental Examination-IEE) কে এনভায়রনমেন্টাল ইমপেক্ট এসেসমেন্ট (Environmental Impact Assessment-EIA)-ইআইএ হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া সাইট ক্লিয়ারেন্স (Site Clearence) কে পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (Environmental Clearence Certificate) বা ছাড়পত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। অথচ ইউনোকল কোম্পানী পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের (Environmental Clearence Certificate) বা ছাড়পত্র পায়নি। এছাড়া (Initial Environmental Examination-IEE) প্রাথমিক পরিবেশগত মূল্যায়ন শেষে সাতটি সুনির্দিষ্ট শর্তের ভিত্তিতে সাইট ক্লিয়ারেন্স (Site Clearence) দেয়া হলেও পাইপ লাইন নির্মাণ কাজের সময় ইউনোকল সেগুলোও মেনে চলেনি।
শর্তগুলো ছিলঃ ১. শব্দ ও কোলাহল এড়ানোর জন্য হস্তচালিত কার্যক্রম পরিচালিত করা, ২. খননকাজ হাতে সম্পন্ন করা যাতে গাছের শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, ৩. গাছপালা না কাটা, ৪. বন্যপ্রাণীর জীবন যাত্রায় কোন প্রকার অসুবিধা যাতে না হয়, ৫. প্রতিদিন বিকেলের মধ্যে শ্রমিকদের সরিয়া নেয়া, ৬. বনের মধ্যে কোন ভারী স্থাপনা না রাখা, ৭. নির্মাণ কাজ শুরু করার আগে ইআইএ সম্পন্ন করা। সরজমিনে লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক-রিজার্ভ ফরেষ্ট পরিদর্শনে গেলে দেখা যায় যে,ইউনোকল সকল শর্তাবলী লঙ্ঘন করেছে। যেমন, ১. ভারী যানবাহন ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার করা হয়েছে, ২. অসংখ্য গাছের শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে, ৩. অসংখ্য গাছপালা কাটা হয়েছে, ৪. বন্যপ্রাণীর জীবনযাত্রায় ব্যঘাত সৃষ্টি করা হয়েছে, ৫. বিকেলের মধ্যে কাজ শেষ না করা, ৬.লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক-রিজার্ভ ফরেষ্টের ভেতর দিয়ে ভারী স্থাপনা বহন করা হয়েছে, ৭.নির্মাণ কাজ শুরু করার আগে ইআইএ সম্পন্ন না করা এবং ছাড়পত্র না নেওয়া। কূপ খনন করার পরে কূপের বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থসহ রাসায়নিক পানি ছড়া-খাল(ছোটনদী)তে ফেলে পরিবেশ দূষিত করা হয়েছে; ফলে উক্ত বিষাক্ত পানিতে ছড়ার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, ব্যাঙ, সাপ, বিচ্ছু, কেঁচো,শামুক, ঝিনুক, পোকা-মাকড়, কাঁকড়া, অনুজীবসহ ইত্যাদি মারা গেছে বলে জানা যায়। ইউনোকল কোম্পানীর পূর্বসুরি অক্সিডেন্টাল কোম্পানীর সাথে সম্পাদিত পিএসসি চুক্তির মেয়াদ মাগুরছড়া ব্লো-আউটের পর ১৯৯৮ সালে শেষ হয়ে গেলে ঐ বছরেই নভেম্বর মাসে (Supplemental Agreement) বা সম্পূরক চুক্তি সম্পাদিত হয়। (Supplemental Agreement) বা সম্পূরক চুক্তির কিছুদিন পর অক্সিডেন্টল কোম্পানী তাদের সমস্ত দায় দায়িত্ব ইউনোকলের কাছে হস্তান্তর করে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়।
ছাতক গ্যাসক্ষেত্র, টেংরাটিলা ব্লো-আউট: ছাতক গ্যাসক্ষেত্র ১৯৫৯ সালে আবিস্কৃত হয় এই কূপটি ছাতক-১ হিসেবে পরিচিত। এই গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৭ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের পর কূপে অত্যাধিক পানি আসার কারণে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এই গ্যাসক্ষেত্রটিতে মোট মজুদ প্রায় ৩৩২ বিলিয়ন ঘনফুট, যার অধিকাংশই উৎপাদন করা হয়নি। এই ক্ষেত্রটি থেকে গ্যাস উৎপাদন পুনরায় শুরুর লক্ষ্যে বাপেক্সকে পাশ কাটিয়ে সরকার কানাডিয়ান বহুজাতিক নাইকো রিসোর্স কোম্পানিকে ইজারা দেয়। এই কোম্পানি ছাতক- ১ এর কাছেই ছাতক-২ কূপটি খনন করা শুরু করে এ বছরের প্রথম দিন থেকে। ছাতক-২ (টেংরাটিলা) কূপটিতে ব্লো-আউট অবশ্যম্ভাবী ছিলনা। এর যথার্থ কারণ সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি খুঁজে বের করেছে। কূপ-নকশা এবং খননকর্মে ত্র“টির কারণে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে। উপরোক্ত ত্রুটিটি ছিল ১৯৯৭ সালে মৌলভীবাজারের মাগুরছড়া কূপে সংঘটিত দুর্ঘটনার অনুরূপ। মাগুরছড়ায় দুর্ঘটনার পর তার কারণ তদন্ত করে দেখা যায় যে, কূপ খননকারী অক্সিডেন্টাল কোম্পানীর কূপ-নকশা এবং খনন পদ্ধতিতে ত্রুটি এবং এর সঙ্গে কোম্পানীর অবহেলা ও দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করা হয়। একইভাবে টেংরাটিলা কূপেও কূপ-নকশা ও খনন কাজের একই ধরনের ত্র“টি হয়েছে। কূপটিতে যথাযথভাবে কেসিং না করার ফলে গ্যাস নরম বালি স্তরে চারদিকে ঢুকে পড়ে ও তা কূপের পরিপার্শ্বে ও বহু স্থান দিয়ে বের হতে থাকে। আর গ্যাসস্তর থেকে পুলিং আউট করার ফলে গ্যাস উপরে উঠে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূ পৃষ্ঠে এসে দুর্ঘটনাটি ঘটায়।
মাত্র ৮ বছর আগে মাগুরছড়া কূপের দুর্ঘটনার কারণ যেখানে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেটি ছাতক-২ খননের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়নি। একটি নতুন কূপ খনন করার পূর্বে তার আশপাশে পূর্বেকার খননকৃত কূপসমূহের সমূহ তথ্য ও খনন ইতিহাস বিবেচনায় আনা একটি প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এই কূপের ভূগর্ভে কি ধরনের শিলা স্তর, কি ধরনের গ্যাস স্তর পাওয়া যায় এবং তাদের ব্যবহার কি রকম হবে- এ তথ্য সমূহ জানা থাকা সত্ত্বেও এ ব্লো-আউট গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা।
ছাতক (টেংরাটিলা) কূপে দুর্ঘটনায় তিন ধরনের ক্ষতি হয়েছে। প্রথমত, ভূ গর্ভে মূল্যবান গ্যাস মজুদের একটি বড় অংশ পুড়ে এবং বাতাসে উড়ে গিয়ে বিনষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ঐ এলাকায় কৃষি ও প্রতিবেশের বড় রকমের ক্ষতি হয়েছে আর তৃতীয়ত, জনগণের সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
টেংরাটিলার যে গ্যাসস্তরটিতে এই ব্লো-আউট ঘটে তা একটি বড় আকারের গ্যাসস্তর। নাইকো কোম্পানী ও বাপেক্স যৌথভাবে ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের মজুদ নতুনভাবে নির্ধারণ করে, মোট মজুদ প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ঘনফুট, এ পরিমাণ গ্যাসের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ২৩,৩৬০ কোটি টাকা। তার মধ্যে কেবল এ নাইকো ও বাপেক্স যৌথভাবে আবার এক বছর পূর্বেই ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের মজুদ পুনর্মূল্যায়ন ও মজুদ পুনর্নির্ধারণ করে এবং তাতে বলা হয় যে, দুর্ঘটনাকবলিত এই গ্যাসস্তরে ১১৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদ রয়েছে যার বাজার মূল্য প্রায় ৬,৭১৬ কোটি টাকা। ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের অন্য দুটি গ্যাসস্তর আরো গভীরে অবস্থিত। গ্যাস বিনষ্ট হওয়ার আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও পরিবেশের ক্ষতি ও মানুষের সম্পত্তির যে ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য যথাযথভাবে নির্ধারণ করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি ছাতক (টেংরাটিলা) দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ বাবদ কানাডিয়ান নাইকো রিসোর্স কোম্পানির উপর মাত্র ১০ কোটি টাকা জরিমানা নির্ধারণ করেছে। দেশপ্রেমিক ভূতাত্ত্বিকদের মতে, উক্ত জরিমানাকে অগ্রহণযোগ্য ও জনগণের সাথে উপহাস। বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীগুলো কতটা অদক্ষ এবং অযোগ্য তা ইতিমধ্যে সিমিটার, অক্সিডেন্টাল ও নাইকো কোম্পানীর কর্মকান্ড থেকেই তা স্পষ্ট হয়েছে। ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য সরকারের কোন আগ্রহ নেই। ১৯৯৭ সালে মাগুরছড়া ব্লো-আউটে গ্যাস সম্পদ বিনষ্ট ও পরিবেশের ক্ষতির পরিমাণ তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। তদন্ত কমিটি এ ক্ষতির হিসাবটি সরকারকে রিপোর্ট দেয়। সরকার সে মোতাবেক অক্সিডেন্টাল কোম্পানীর কাছে ক্ষতিপূরণ দাবী করে। কিন্তু কোম্পানী ক্ষতিপূরণ দেবার কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে সরকার পক্ষ জানায়। পরবর্তীতে অক্সিডেন্টাল কোম্পানী আরেক মার্কিন কোম্পানী ইউনোকলের কাছে অবৈধভাবে হস্তান্তর করে চলে যায়। পরে আবার ইউনোকল কোম্পানীও তাদের স্বত্ব শেভরনের কাছে বিক্রি করে চলে যায়। কিন্তু মাগুরছড়া ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আর ফয়সালাই হলো না।
গ্যাস ও তেল উত্তোলন সংক্রান্ত বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানীর সঙ্গে সরকারের সম্পাদিত চুক্তিগুলো ভয়াবহভাবে অসম, অযৌক্তিক, লুণ্ঠনভিত্তিক, জাতীয় স্বার্থবিরোধী ও দেশের জন্য ক্ষতিকর। সরকারের নমনীয় নীতির জন্যই দেশের অমূল্য গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনষ্ট করেও বিদেশী কোম্পানী পার পেয়ে যাচ্ছে। আর কতদিন বাংলাদেশের জনগণের মূল্যবান এই গ্যাস সম্পদ নিয়ে বিদেশী কোম্পানীর খামখেয়ালী ও লুণ্ঠন সহ্য করে যাবে সরকার। এটি মোটেই জনগণের কাম্য নয়।
একটি গ্যাসকূপ খনন করতে বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীকে ডেকে এনে শেয়ার দেওয়ার প্রয়োজন নেই এ কাজ জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স নিজেই করতে পারে। বাপেক্সকে দিয়েই বাংলাদেশের সকল গ্যাসকূপ খনন করা বাঞ্চনীয়। এক্ষেত্রে সরকারের আর্থিক অসঙ্গতির কথা উঠা অবান্তর। ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ ৪,০০০ কোটি টাকার গ্যাস সম্পদ বা মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে ৪ হাজার কোটি টাকার গ্যাস বা এমবি-২, এমবি-৩, এমবি-৪, এমবি-৫সহ বাংলাদেশের সকল গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে প্রতিটি কূপে মাত্র ৪০ কোটি টাকা খরচের সঙ্গতি না থাকার যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। আর বাপেক্সের কারিগরি ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করা অজ্ঞতা ও প্রতারণার সামিল। বাপেক্স ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে এবং ফেঞ্চুগঞ্জ ও সালদানদী গ্যাসক্ষেত্রসমূহে কূপ খনন করে গ্যাস উৎপাদন চালু রেখেছে। তাই ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে-মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে, এমবি-২, এমবি-৩, এমবি-৪, এমবি-৫ সহ বাংলাদেশের সকল গ্যাসক্ষেত্রে বাপেক্সকে দায়িত্ব দিতে অসুবিধা কোথায় ছিল?
দেশের গ্যাস চাহিদা, সংকট ও বাপেক্স: দেশে বর্তমানে উৎপাদিত গ্যাস দেশের চাহিদা পুরোপুরি মেটাতে পারছেনা। বর্তমানে দেশে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয় যা গড় চাহিদার কিছু কম। ইতিমধ্যে যে সংখ্যক গ্যাসকূপ জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের মাধ্যমে খনন করা উচিত ছিল, তা খনন করা হয়নি। বিগত কয়েক বছরে হাতেগোনা ক’টি কূপ খনন করা হয়েছে- যা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। দেশে যে হারে গ্যাস চাহিদা বেড়েছে, উৎপাদন কূপের সংখ্যা সে তুলনায় বাড়ে নি। তাই উৎপাদিত গ্যাস ও গ্যাস চাহিদার মধ্যে তফাৎটা রয়েই গেছে ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তদুপরি চাহিদা বলতে বোঝায় সাপ্রেসড ডিমান্ড, যা এ মুহুর্তে না পেলেই নয়। গ্যাস চাহিদার চেয়ে উৎপাদন অতিরিক্ত হলেও তা ব্যবহৃত হয়ে যায়। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে, শিল্পায়নের ভিত্তি নির্মাণে, কৃষির বিকাশে, জ্বালানী ও সার সমস্যার সমাধানে দেশের গ্যাস সম্পদ কাজে লাগানো গেলে চাহিদা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে।
গ্যাস সংকটের অন্য কারণটি হলো গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ত অবকাঠামো। গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় পাইপ লাইন দেশব্যাপী গড়ে উঠেনি। আবার যেখানে পাইপ লাইন রয়েছে, তার পরিবহন ক্ষমতা চাহিদার তুলনায় কম।
গ্যাস ক্ষেত্রসমূহে বাপেক্সের মাধ্যমে পর্যাপ্ত উন্নয়ন কূপ খনন করে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন না বাড়ালে এ সংকট মিটবে না। সরকারী উদ্যোগে গত বছর মাত্র দু’টি উন্নয়ন কূপ খনন করা হয়। সরকার এ বিষয়ে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। উন্নয়ন কূপ খনন করতে আর্থিক অসঙ্গতির কথা বলা হয়। অথচ পেট্রোবাংলা সরকারকে বছরে ২ হাজার কোটি টাকার উপরে প্রদান করে, এর শতকরা ১০ ভাগ অন্তত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে ব্যয় করা হলে বিদেশনির্ভরতা ও অনগ্রসরতা থাকতো না। বাংলাদেশে গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো স্ট্যান্ডবাই উৎপাদন কূপ নেই। দেশে যে পরিমাণ গ্যাস উৎপাদিত হয়, তার শতকরা ২০ভাগ গ্যাস উৎপাদন ব্যবস্থা স্ট্যান্ডবাই বা প্রস্তুত রাখা হলে জরুরী অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা যায়। যেমন, কোনো কূপে যদি সাময়িকভাবে গ্যাস উৎপাদন ব্যাহত হয়, তবে ঐ প্রস্তত রাখা কূপসমূহ চালু করে উৎপাদন বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিক জ্বালানীর ব্যবহার শতকরা ৭০ ভাগ গ্যাসনির্ভর। দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের শতকরা ৯০ভাগ তৈরি হয় গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে। তাই গ্যাস সংকট মানেই বিদ্যুৎ সরবরাহের সংকট সৃষ্টি। ঘন ঘন লোডশেডিং জনজীবন অতিষ্ঠ করে, শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত করে, ব্যবসা বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করে। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের একটি বড় অংশ সার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় গ্যাস সংকট সৃষ্টি হলে সার কারখানায় সার উৎপাদন ব্যাহত হবে। এসব সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতেই সরকার তেল-গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য বহুজাতিক কোম্পানীগুলোকে ডেকে নিয়ে এসে তাদেরকে শেয়ার দিয়েছে। পরিনামে দেশের জন্য তা হয়েছে আত্মঘাতী।
গ্যাসের বর্তমান মজুদ প্রসঙ্গে: বাংলাদেশের পক্ষে বর্তমানে গ্যাস রপ্তানী করার অবকাশ নেই। দেশের বর্তমান মজুদ দিয়ে নিজস্ব প্রয়োজন মেটানো যাবে বড়জোর ২০ বছর। এরপর বাংলাদেশকে গ্যাস আমদানী করার পন্থা বের করতে হবে। গ্যাসের চাহিদা দিনদিন তো বেড়েই চলেছে।
গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে যাবে ৯ বছরের মধ্যে
প্রায় আড়াই দশক আগে বলা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ভাসছে’। অর্থাৎ সোজা বাংলায় দেশের খনিগুলোতে মজুদ থাকা গ্যাসের পরিমাণ এত বিপুল যে তার ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ নিজে চুলায় দেয়া কিংবা গাড়ি চালানো কিংবা শিল্প-কারখানায় গ্যাস দিয়ে রপ্তানিও করতে পারে।
তার দেড় দশকের মধ্যেই বাংলাদেশকে গ্যাস আমদানি শুরু করতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের গ্যাসের মজুদ আসলে কত আছে? আর সে গ্যাস দিয়ে কতদিন চলা সম্ভব?
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মহাপরিচালক আবুল খায়ের মোহাম্মদ আমিনুর রহমান বলেছেন, এই মুহূর্তে দেশে আবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণ মোট ২৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট বা টিসিএফের চাইতে কিছু বেশি।
তিনি বলেছেন, “আবিষ্কৃত ২৮ টিসিএফের মধ্যে ১৯৬৫ সালে আবিষ্কার হওয়া গ্যাসও আছে। কিন্তু যেহেতু প্রতিদিনই আমরা গ্যাস খরচ করছি, সে কারণে খরচ হওয়া অংশ বাদ দিয়ে আমাদের মজুদের পরিমাণ ৯.০৬ টিসিএফ।”
আবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণ নির্ধারণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, কূপ খনন করার পর সিসমিক জরিপের ফল এবং সেখানকার গ্যাসের চাপের ওপর নির্ভর করে ওই কূপে গ্যাসের মোট পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
আবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে মূলত তিন ধরণের মজুদ হিসাব হয়–প্রমাণিত মজুদ, উত্তোলনযোগ্য মজুদ এবং সম্ভাব্য মজুদ।
সরকারি যে প্রতিষ্ঠানটি খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন, পরিশোধন এবং বাজারজাত করার কাজ করে সেই পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে দেয়া ২০২২ সালের জুলাই মাসের তথ্য বলছে, দেশে প্রমাণিত, উত্তোলনযোগ্য আর সম্ভাব্য মিলে মোট মজুদের পরিমাণ ৩০ দশমিক ১৩ টিসিএফ।
এর মধ্যে আবিষ্কৃত ২৮ টিসিএফ গ্যাসের মধ্যে এ পর্যন্ত ব্যবহার করা প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিমাণ সাড়ে ১৯ টিসিএফের বেশি।
পেট্রোবাংলার ২০২২ সালের ৩০শে অক্টোবরের দৈনিক গ্যাস উৎপাদন রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্রে মোট ৭০টি কূপ রয়েছে, এর মধ্যে ৬৯টি কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।
এর মধ্যে দেশি প্রতিষ্ঠান বাপেক্স, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড বিজিএফসিএল এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড এসজিএফএল গ্যাস উত্তোলন করছে।
এর বাইরে দুইটি বহুজাতিক তেল কোম্পানি বা আইওসি শেভরন ও তাল্লো চারটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন করছে।
তবে বঙ্গোপসাগরের মহীসোপান এলাকায় বিপুল গ্যাসের মজুদের যে সম্ভাবনার তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিয়েছে, তা এখন পর্যন্ত মজুদের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এদিকে, গ্যাস কূপগুলো থেকে প্রতিবছরই উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ কমছে।
হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে দেশে প্রতিদিন ২৬৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো, যা ২০২১ সালে এসে ২৩৫২ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে যায়।
গ্যাসের বর্তমান মজুদ দিয়ে কতদিন চলবে?
হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মহাপরিচালক মি. রহমান বলেছেন, বর্তমানে যে মজুদ আছে তা দিয়ে আগামী নয় বছর চলা যাবে।
“মানে যদি নতুন কোন গ্যাসক্ষেত্র থেকে আর গ্যাস না পাওয়া যায়, তাহলে এই মজুদ দিয়ে আরো ৯ বছর চলা যাবে। কিন্তু আগামী নয় বছরের মধ্যে নতুন গ্যাস উত্তোলন হবে না বা নতুন মজুদ বাড়বে না, অতটা নৈরাশ্যবাদী আমরা নই, আর সে আশংকাও নাই।”
মি. রহমান বলেছেন, প্রতিবছরই নতুন কূপ যুক্ত হচ্ছে।
এই মুহূর্তে বাপেক্সের মাধ্যমে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান চলছে। এবং এখন বাপেক্স ভোলা এবং সিলেট অঞ্চলে মোট ছয়টি নতুন কূপ খননের কাজ করছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
কিন্তু বাংলাদেশে বছরে এক ট্রিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস ব্যবহার হয়।
বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৩৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট, কিন্তু উৎপাদন হয় ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
গ্যাসের মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পেছনে।
বাংলাদেশ কী গ্যাসের ওপরে ভাসছে?
বিশেষজ্ঞ এবং সরকারি কর্মকর্তা সকলেই বলছেন, গ্যাসের এত বিপুল মজুদ বাংলাদেশে কখনোই আবিষ্কৃত বা প্রমাণিত হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বদরুল ইমাম জানিয়েছেন, মূলত কথাটি এসেছিল ১৯৯৭ সালে ইউনোকল নামে একটি কোম্পানি যারা বিবিয়ানায় একটি বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে সেসময়।
তখন বাংলাদেশে গ্যাসের তেমন চাহিদা ছিল না, ফলে ওই প্রতিষ্ঠানটি চেয়েছিল বাংলাদেশ সরকার যাতে সেখান থেকে পাওয়া গ্যাস রপ্তানি করে।
অধ্যাপক ইমাম জানিয়েছেন, সেসময় ওই কোম্পানি সরকারকে ‘কনভিন্স’ করার জন্য এই প্রচারণা চালায় যে দেশে এত গ্যাস আছে যে ‘বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে’।
কিন্তু সেসময় গ্যাস রপ্তানির বিরুদ্ধে দেশে প্রতিবাদের মুখে সরকার সে সিদ্ধান্ত নেয়নি।
অধ্যাপক ইমাম বলছেন, “যদিও বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ এবং বদ্বীপ এলাকা সাধারণত গ্যাসসমৃদ্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু গ্যাসের ওপর ভাসার মত মজুদ বাংলাদেশে কখনো প্রমাণিত হয়নি বা আবিষ্কৃত হয়নি।”
বাংলাদেশে গ্যাসের মজুদ যে নিম্নগামী সে সম্পর্কে কয়েক বছর আগে থেকে পেট্রোবাংলা তাদের পূর্বাভাসে দেখিয়ে আসছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে আগামী চার বছরে ৪৬টি কূপ খনন করে গ্যাস অনুসন্ধান চালানো হবে।
এই ৪৬টি কূপের মধ্যে অনুসন্ধান কূপ, উন্নয়ন কূপ এবং ওয়ার্কওভার অর্থাৎ আগে খনন করা কূপে নতুন অনুসন্ধান চালানোর কথা রয়েছে।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে দিনে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস উৎপাদন না বাড়ানোর ফলে এই খাত আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে, আর সে কারণেই এখন বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে তীব্র সংকট।
এদিকে, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় যে, নতুন গবেষণায় তারা বঙ্গোপসাগরে ১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হাইড্রেটের সন্ধান পেয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলছেন, ২০১২ সালে মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর দেশটি সাগরে তাদের অংশে গ্যাসের অনুসন্ধান এবং উত্তোলনে ব্যাপক বিনিয়োগ করে।
ফল হিসেবে তারা এখন সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করে নিজেরা ব্যবহারের পর চীনে রপ্তানিও করছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটি গত ১০ বছরেও হয়নি বলে বলছিলেন অধ্যাপক ইমাম।
তিনি বলেছেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং সংকটের মুখে অনাবিষ্কৃত এ ক্ষেত্রটিতে দ্রুত অনুসন্ধান শুরু করা প্রয়োজন, একমাত্র তাহলেই জ্বালানি খাতে স্বস্তি পাওয়া সম্ভব।
পরিশেষে আবারো বলি, দেশের খনিজ সম্পদ ও ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থেই মাগুরছড়া ব্লো-আউটের ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৪ হাজার কোটি টাকা অাদায়ে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
মাগুরছড়া ব্লো-আউটের ২৬ বছর: ক্ষতিপূরণ আদায়ে সরকারের করণীয় মুক্তমত সৈয়দ আমিরুজ্জামান