Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুক্তির স্বপ্ন দেখা এক বিভীষিকাময় গল্প

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
১৩ জুন ২০২৩ ১৪:৩৬

শোষিত মানুষের মুক্তির স্বপ্ন হৃদয়ে লালন করে কিশোর বয়সে লাল ঝাণ্ডার কাঁধে নিয়ে রাজপথে নেমেছিল কৃষক বাবার সন্তান আসিফ। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার নানা অসংগতি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নেতাদের প্রতি টি বক্তব্য তাকে ভীষণ ভাবে উজ্জীবিত করেছে। ফলে সমাজের সাধারণ কিশোরদের তুলনায় চিন্তার জায়গায় থেকে একটু এগিয়ে থাকা অগ্রসর চিন্তা করে। যার কারণে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার অন্যায়, অবিচার এবং অসংগতি তাৎক্ষণিক ভাবে বুঝতে পারে। কিশোর বয়স থেকেই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় রাজপথে। তার বিশ্বাস রাজপথেই শোষিত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তি আসবে।

বিজ্ঞাপন

কিশোর বয়সে ছেলেটির এমন প্রতিবাদী আচার – আচরণ দেখে গ্রামের মুরব্বিরা বিচলিত হয়ে যায়। যে আসিফের ছোট্ট মুখে বড় বড় কথা। অনেকেই আবার বলে উঠেন,যার মুখ চিপলে দুধ বের হয় তার মুখে এত বড় মানায় না। ডানপিটে কিশোর মুরব্বিদের কথা তোয়াক্কা না করে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে লাল ঝাণ্ডারের পতাকা কাঁধে রাজপথে আন্দোলন করে। তার ধ্যানে জ্ঞানে একটাই লক্ষ্য শোষিত,বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

কিশোর বয়সেই গ্রামে তার সমবয়সীদের সাথে নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠ প্রাঙ্গণে শিক্ষা কোনো পণ্য নিয়ে শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকারের দাবি ও সমাজে কূপমন্ডুকতা বিরুদ্ধে পাঠচক্র গড়ে তোলে।
আসিফের কিশোর কাল পেরিয়ে যৌবনের পর্দাপণে নতুন ভাবে রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। তারুণ্যের রক্ত যে কথা বলে, তারুণ্যের যে স্বভাব কোনো কিছুতেই হার না মানা।

আবার অন্য দিকে ব্যক্তি জীবনে শুরু হয় কলেজ জীবনে নতুন এক শিক্ষাজীবন। এতে করে তাকে প্রবল ভাবে রাজনীতিতে আকৃষ্ট করে কলেজ জীবনে। তার প্রধান কারণ হল আসিফ যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করত। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত শিক্ষক সংকট, ক্লাসরুমের সংকট, লাইব্রেরি সেমিনারে বই নেই, গবেষণাগার নেই, ক্যাম্পাসের হলে নিন্মমানের খাবারের আয়োজন, সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক আয়োজন নেই ইত্যাদি নানা সংকট তার সামনে দাঁড়ায়।প্রতি মুহূর্তে সংকটে গুলো ভুগতে থাকে।

বাড়িতে বাবার কাছে ফোন দিয়ে প্রতিমাসে প্রাইভেট, ক্যান্টিন, বই ও খাতা-কলমের টাকা নিতে হয়। কৃষক বাবা তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেলেও ধারদেনা করে সন্তানকে সময় মত টাকা পাঠিয়ে দেন। তবে আসিফের বাবা মা জানত যে রাজনীতি করে।যার কারণে তার বাবা টাকা পাঠানো পর খুব বুঝিয়ে বলেন, বাবা তোমার এখন রাজনীতি করার বয়স নয়, এখন মন দিয়ে পড়াশোনা কর। কিন্তু আসিফ তার বাবার কথা গ্রাহ্য করত না।

পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়ে কখনো শিক্ষার্থীদের সংকট নিয়ে দাবি আয়ের মিছিল করে, কখনো কৃষকের সংকট নিয়ে মিছিল করে, কখনো নারী নির্যাতনকারীদের শাস্তির দাবি নিয়ে ও প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ এবং সমাজের নানা অন্যায় অবিচার নিয়ে রাজপথে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে স্লোগান তুলে। স্লোগান শেষে পার্টি অফিসে বসে চিন্তায় কপাল ভাজ হয়ে যায়। সামনের দিনের প্রোগ্রাম সফল করতে টাকার প্রয়োজন। তা পাবে কোথায় থেকে? তাই তো পার্টির কর্মীদের নিয়ে শহর কিংবা গ্রামের হাটবাজারে চলে যায় লিফলেট দিয়ে অর্থ সংগ্রহের কাজে।

সারাদিন অর্থসংগ্রহের কাজে ক্লান্ত হয়ে যায়। তবুও রুটি আর চা খেয়ে দোকানে দোকানে অর্থ সংগ্রহ করেন। তবে গণচাঁদা করতে গিয়ে নানা শ্রেণি পেশার মানুষের কাছ থেকে শুনতে হয় নানান রকমের কথা। পার্টির প্রতি সাধারণ মানুষের অভিমান আর অভিযোগের শব্দের মালা তৈরী হয়। সেই শব্দের
মালা চাঁদা সংগ্রহ শেষে সেখানে ছুড়ে ফেলে চলে আসে পার্টি অফিসে। আবারও নতুন করে মুক্তির স্বপ্ন দেখে। এভাবে গণচাঁদা আর মিছিল মিটিং এ তার কলেজ জীবনের দুই বছরের যৌবন কালের রাজনীতি খুব দাপটে আর নিজেকে সৎ একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে মনের ভিতর আত্মতৃপ্তিতে কাটে।

জীবনের অপর নাম সংগ্রাম। ফলে ভালো রেজাল্ট করে ভর্তি যুদ্ধের মাধ্যমে ভালো মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্স নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় তাকে। কিন্তু টাকার অভাবে ভালো প্রাইভেট, কোচিং না করেই ভর্তি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে কোনো আশানুরূপ সাফল্য আসে নি। তাই বাধ্য হয়ে ভর্তি হয়ে সার্টিফিকেট তৈরীর কারাখানা জাতীয় অবহেলিত বিশ্ববিদ্যালয় নামক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়। আর নতুন করে মেসে উঠাসহ লেখাপড়ার খরচ জোগান দিতে বিক্রি করতে বাড়ির পছন্দের আলো নামের গরুটিকে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষেই থেকেই টিউশনির সন্ধানে বেড়িয়ে পড়ে। কারণ তার বাবা কোনো ভাবেই তার লেখাপড়ার টাকার জোগান দিতে পারছে না। ফলে তিনটা টিউশনির খোঁজ পায়। আর সেই টিউশনির টাকা দিয়ে নিজের পড়াশোনা খরচ আর মাঝে মাঝে মায়ের ওষুধের খরচ তাকে চালাতে হয়। এ দিকে সংকটের মধ্যে মহাসংকট হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবন। তাই তো ক্যাম্পাসে নিয়মিত ক্যাম্পেইন আর ছাত্র যোগাযোগের মাধ্যমে রাজনীতি নতুন এক জগৎতে পা এগিয়ে দেয়।

রাজনীতিতে তার বাড়তে থাকে দায়িত্ব। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, নারী, পরিবেশ, পুঁজিবাদী রাজনীতি, প্রাণ প্রকৃতি রক্ষা ও দাবি আদায় এবং সমাজে সর্বক্ষেত্রে অনিয়মের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ থাকে সোচ্চার। যখন দেখে ছেলেটি দায়িত্বশীল হয়ে গড়ে ওঠে তখন তাকে নিয়ে নেতাদের চোখে স্বপ্ন ফুটে। তখন তাকে বিভিন্ন ভাবে মানুষিক গড়ে তোলা হয় বিল্পবী জীবন আর পার্টি জীবন হচ্ছে সত্যিকারের জীবন। এমনকি ব্যক্তিগত জীবন বিছিন্ন করে শোষিত মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হবে। তার কাছে ওয়াদা বদ্ধ নেওয়া হয়।

ছেলেটি বিল্পবের স্বপ্ন নিয়ে একপর্যায়ে ওয়াদাবদ্ধ করে রাজনীতি জীবন বিপ্লবী জীবন। আর অন্য দিকে পরিবার তাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল ছেলে বড় হয়ে বাবা মায়ের দুঃখ দুর্দশা দূর করবে কিন্তু সব আশা যেন গুড়ে বালি হয় যায়। আসিফ বাড়িতে যখনি যায় তখনি বাবামা বলে, ‘বাবা তোমার অনার্স মাস্টার্স শেষ কোনো একটা জব করে পরিবারের হাল ধর। আমরা বুড়ো বয়সে আর কত কাজ করব।’ ছেলেটির মাথায় বাবা মায়ের কোনো কথা কর্ণপাত হয় না। উল্টো বাবা মাকে সে বুঝায়, দেখ আজ কত মা সন্তান হারা, কোটি কোটি বাবা মা অনাহারে আছে। তাদের মুখের হাসি ফোটাতে আমাকে রাজনীতি করতে হয়। এভাবে বলেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে চলে আসে ক্যাম্পাসে।

সারা বিশ্বের টালমাটাল অবস্থা। কে বাঁচবে আর কে মরবে তা নিয়ে হৈচৈ। কারণ বিশ্বব্যাপী আক্রমণ করছে করোনা ভাইরাস। আসিফের তিনটা টিউশনি ছিল। তা করোনার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। টিউশনি থেকে ফোন আসে করোনার মধ্যে সন্তানের জন্য শিক্ষক রাখবেন না। টিউশনির টাকা বন্ধ মানে তার পথচলা বন্ধ। তিন বেলা খেয়ে রাজনীতি করবে তা আর হচ্ছে না। প্রথম তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয় নিজের জীবন নিয়ে। তার জীবন চলবে কেমন করে? কেমন করে রাজনীতি করবে?

ইতোমধ্যেই বাড়ি থেকে খবর আসে তার একমাত্র আশ্রয়স্থল মা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। কৃষক বাবা যে টুকু জমি ছিল তা বিক্রি করে পড়াশোনা করে ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করেছে। কিন্তু ছেলে উচ্চ শিক্ষিত হয়েও বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ছেলের সার্টিফিকেটের বয়সের সময় সীমা শেষ হয়েছে। তার পক্ষে রাজনীতি করাও সম্ভব হচ্ছে না। কোথায় গিয়ে জীবন গড়াবে কোনো কূল কিনারা পাচ্ছে না। কিশোর কালে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে যে সংগ্রাম শুরু করছে। সেই সংগ্রামের স্মৃতি যেন বিস্মৃতি হয়ে যায়। আসিফ খুঁজে নিজের জীবনের মুক্তির পথ। প্রতি মুহূর্তেই তাকে ধুকেধুকে যন্ত্রণা দেয়। শোষিতদের মুক্তির জন্য লড়াই সংগ্রাম করতে গিয়ে নিজেই শোষিত সাগরে ডুবে দিনাতিপাত করছে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

মুক্তমত মুক্তির স্বপ্ন দেখা এক বিভীষিকাময় গল্প রাশেদুজ্জামান রাশেদ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

উর্মিলার সংসার ভেঙে যাওয়ার কারণ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০২

নতুন পরিচয়ে কুসুম সিকদার
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৫৭

সম্পর্কিত খবর