Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যেগ নিতে হবে

মো. বজলুর রশিদ
১৩ জুন ২০২৩ ১৮:০৪

দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এর আগে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার বিষয়ে সতর্ক করেছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরে ১৩ জুন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে মোট ৩,৬০১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ বছর ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন।

উল্লেখ্য যে, ২০২২ সালে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২৮১ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়। আর ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এমন অবস্থায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্মিলিত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞাপন

ডেঙ্গু জ্বর একটি মশাবাহিত ভাইরাল রোগ যা বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক জায়গায় দেখা যায়। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে সাধারণ, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে, যা সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে। তবে, এখন তা সারা বছরই পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। দেশে এডিস মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত জলবায়ু এবং পরিবেশগত অবস্থা রয়েছে, যা ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রাথমিক বাহক।

বাংলাদেশে বর্ষাকালে এবং পরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। ভারী বৃষ্টিপাত এবং জমে থাকা পানি মশার জন্য আদর্শ প্রজনন স্থান প্রদান করে, যার ফলে ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশের শহর ও আধা-শহুরে এলাকা যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি সেখানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার মতো শহরগুলোতে প্রায়ই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া জেলা শহরগুলোতেও ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে মারাত্মক ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যেখানে বেশি সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যু বরণ করেছে। ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ও শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়।

বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে ডেঙ্গু মোকাবিলা এবং এর প্রভাব কমাতে কাজ করছে। উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, জনসচেতনতামূলক প্রচারণা এবং ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা জোরদার করা।

ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য মানুষদের সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেওয়া হয়, যেমন মশা নিরোধক ব্যবহার করা, সুরক্ষামূলক পোশাক পরা এবং বাড়ির আশেপাশে মশার প্রজনন স্থান নির্মূল করা। সরকার ডেঙ্গু প্রবণ এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিও পরিচালনা করে।

কার্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য ডেঙ্গুর প্রাথমিক উপসর্গ নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গুর লক্ষণগুলির মধ্যে উচ্চ জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, জয়েন্ট এবং পেশী ব্যথা, ফুসকুড়ি এবং হালকা রক্তপাত অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। ডেঙ্গুর চিকিৎসা প্রধানত বিশ্রাম, প্রচুর তরল পানীয় পান এবং ব্যথা উপশম কল্পে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ। গুরুতর ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি এবং বিশেষ চিকিৎসা ও যত্ন প্রয়োজন হতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যেখানে ব্যক্তি এবং সম্প্রদায় উভয়ের প্রচেষ্টা জড়িত থাকবে। যে মশাগুলো ডেঙ্গু ছড়ায় তারা জমে থাকা পানিতে বংশবৃদ্ধি করে। সুতরাং, কারো বাড়ি এবং মহল্লার আশেপাশে যে কোনও সম্ভাব্য প্রজনন স্থান সনাক্ত করা এবং নির্মূল করা জরুরি। খালি এবং পরিষ্কার পাত্র, ফুলের টব, ডাবের খোসা, ফেলে দেওয়া টায়ার এবং অন্যান্য বস্তু যেখানে পরিষ্কার পানি জমে থাকে সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা। পানি জমে থাকা রোধ করতে ফুলের টবের পানি এবং ছাদের পানি নিয়মিত পরিবর্তন করা।

মশারির নিচে ঘুমানো সুরক্ষা দিতে পারে বিশেষ করে দিনের বেলায় যখন ডেঙ্গু ছড়ানো মশা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। ভবনে মশা যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য জানালা ও দরজার পর্দা লাগানো। মশা নিরোধক স্প্রে ব্যবহার এবং বাইরে গেলে বা বাড়ীতে থাকলে ফুল হাতা জামা, প্যান্ট বা পায়জামা পরিধান করা।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্পর্কে ব্যক্তি বা সংস্থার উদ্যোগে গণসচেতনতা প্রচারণা পরিচালনা করা। ঘোষণা, পোস্টার এবং শিক্ষামূলক প্রোগ্রামের মাধ্যমে ডেঙ্গু মশার প্রজনন স্থান এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য প্রদান করা।

জমে থাকা আবর্জনা ও থাকা পানি যা মশার প্রজনন ক্ষেত্র হিসাবে কাজ করে তা নিয়মিত সংগ্রহ, যথাযথ ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্ব্যবহার করা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অনুশীলনে সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার সমন্বয় করতে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা। ডেঙ্গু-সম্পর্কিত তথ্য, নির্দেশিকা এবং স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের দেওয়া উদ্যোগ সম্পর্কে আপডেট থাকা।

কারো যদি ডেঙ্গুর মতো উপসর্গ অনুভূত হয় তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসা জটিলতা প্রতিরোধ করতে এবং ভাইরাসের বিস্তার কমাতে সাহায্য করতে পারে।

মনে রাখা দরকার যে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং এর কার্যকরভাবে প্রতিরোধে টেকসই পদক্ষেপ প্রয়োজন। জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা, সচেতনতা বাড়ানো, গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা এবং ধারাবাহিকভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন সংস্থাসহ একাধিক স্টেকহোল্ডারের উপর বর্তায়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তর (DGHS) বাংলাদেশের সার্বিক জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নিয়োজিত। তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সমন্বয়, নির্দেশিকা প্রদান এবং ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার তদারকিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ঢাকা দুটি সিটি কর্পোরেশনে বিভক্ত, ডিএনসিসি এবং ডিএসসিসি, যারা তাদের নিজ নিজ এলাকার নাগরিক বিষয়গুলি পরিচালনার জন্য নিয়োজিত। এই সিটি কর্পোরেশনগুলি মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও সচেতনতা প্রচারসহ জনস্বাস্থ্য উদ্যোগ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় স্থানীয় পর্যায়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টাসহ জনসেবা পরিচালনা ও বাস্তবায়নের জন্য নিয়োজিত সিটি কর্পোরেশন এবং স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলির তত্ত্বাবধান করে।

DGHS-এর একটি ডেডিকেটেড কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (CDC) প্রোগ্রাম রয়েছে যা ডেঙ্গুসহ সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। CDC প্রোগ্রাম নজরদারি পরিচালনা করে, প্রযুক্তিগত দিকনির্দেশনা প্রদান করে এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধের কৌশলগুলির উন্নয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়তা করে।

বিভিন্ন এনজিও এবং অলাভজনক সংস্থা ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি কাজ করে। এই সংস্থাগুলি প্রায়শই সচেতনতা প্রচার চালায়, সম্প্রদায়-ভিত্তিক উদ্যোগগুলি বাস্তবায়ন করে এবং সংস্থান, দক্ষতা এবং জনবলের ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ একটি সমন্বিত দায়িত্ব এবং এখানে সমাজের মানুষের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার বাসিন্দারা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, সম্ভাব্য প্রজনন স্থানের রিপোর্টিং এবং কমিউনিটি সচেতনতা কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

কার্যকর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য সব স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সহযোগিতা এবং সমন্বয় প্রয়োজন যাতে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি ব্যাপক পদ্ধতি নিশ্চিত করা যায়। একসাথে কাজ করার মাধ্যমে এবং ধারাবাহিকভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে, ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ ও কমানো সম্ভব।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, তেজগাঁও কলেজ

সারাবাংলা/এসবিডিই

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যেগ নিতে হবে মুক্তমত মো. বজলুর রশিদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর