মাই লর্ড আমার মোয়াক্কেল নির্দোষ!
১৮ জুন ২০২৩ ১৪:৫৭
শিরোনামটি দেখে অনেকের মনেই ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে; হ্যাঁ প্রশ্ন উঠবেই স্বাভাবিক। শিরোনামের কথাটি একটি কমন শব্দ। যে শব্দ আমরা সিনেমায় এবং বাস্তবে আদালতেও শুনছি। অপরাধী দোষী হোক বা নির্দোশী হোক, আসামীর বিরুদ্ধে সকল প্রমানাদি উপস্থাপন করা স্বত্বেও আসামীর পক্ষে আইনজীবী বলেন ‘মাই লর্ড আমার মোয়াক্কেল নির্দোষ’।
হ্যা…। আমিও ওই আসামীর আইনজীবীর সাথে একমত পোষন করছি। কখন…? যখন মামলার আসামী হওয়ার পরেও তদন্ত, তদন্তের পর চার্জশীট এবং সাক্ষী প্রমানে দোষী সাব্যস্ত না হয় তখন। আমি বিশ্বাস করি বা আইনও বলছে, যতক্ষণ না পর্যন্ত আসামী দোষী সাব্যস্ত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আসামী জামিন পাওয়ার হকদার। কিন্তু বেশিরভাগ সময় দেখা যায় আইনের ফাক-ফোকর দিয়ে আসল অপরাধীরা জামিন পেয়ে যায় এমনকি মামলা থেকেও খালাশ পেয়ে যায়। ব্রিটিশ আমলের আইন দিয়ে এখনো চলছে আমাদের দেশের আইন। সাক্ষ প্রমান না থাকায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। প্রত্যক্ষ সাক্ষীর অভাবে আসল অপরাধীরা জামিন পেয়ে বীরদর্পে চলাচল করছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিমের হত্যাকারীরাও কি পার পেয়ে যাবেন। অনেকের মাঝে প্রশ্ন আসতেই পারে যে, সাংবাদিক রব্বানীকে কেবল হত্যা করা হয়েছে, হত্যার সাথে সম্পৃক্ত কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে, মুল হোতাকে আটকের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে ইত্যাদি। তাদের এমন প্রশ্নের সামনে আমার কথাটি একেবারেই বেমানান এমনিক প্রশ্নবিদ্ধও বটে। কিন্তু পুর্বের অভিজ্ঞতার আলোকেই বলছি, সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু, সাগর-রুনি হত্যাসহ অনেক সাংবাদিককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এমনকি সাংবাদিক ছাড়াও অনেক মানুষ হত্যা করা হয়েছে কতজন হত্যাকারীকে মৃত্যূদন্ড দেয়া হয়েছে? যেখানে সাংবাদিক রব্বানীকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে যা ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট… সেখানে একজন দায়িত্বশীল পদে থেকে পুলিশ কর্মকর্তা কিভাবে বলেন, আমার মনে হয় সাংবাদিক নাদিমকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল না তাদের, তাকে সতর্ক করতে চেয়েছিলেন। তখন সঠিক তদন্ত আর ন্যায় বিচার নিয়ে এমন প্রশ্নই মনে দানা বাজতেই পারে। অথচ কয়েকদিন আগেও সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম তার জীবন ঝূকি নিয়ে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চেয়েছিলেন।
যাক এ কথা না বাড়িয়ে আসল কথায় আসি। একটি ঘটনা ঘটার পর মামলা হয়, আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বিচার কার্য শুরু হয়। তদন্ত, সা প্রমানের ভিত্তিতে বিচার সম্পন্ন করা হয়। তখন বাদি ও আসামীর দুপইে আইজীবী নিযুক্ত থাকেন, হ্যা আসামীর পে আইনজীবী থাকবে এটি নাগরিক অধিকার। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে পেশার বাইরেও একটি বিষয় কাজ করে। আর তা হলো বিবেক এবং মানবিকতা। যখন দেখা যাচ্ছে সকল সা প্রমান আসামীর বিরুদ্ধে উপস্থাপন করা হয় তখনও আদালতে আসামী পরে আইনজীবী বলেন, ‘মাই লর্ড আমার মোয়াক্কেল নির্দোশ, আমার মোয়াক্কেল জামিন পাওয়ার হকদার’।
জামালপুরের সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে যা এখন দেশের আলোচিত ঘটনা। যেখানে প্রত্যর্শী বারবার বলছেন কারা কারা এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। কিন্তু এখন পর্যন্ত মুল হোতাদের গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের আটক করা হয়েছে। এখন সবার মনেই প্রশ্ন জাগে গোলাম রাব্বানী নাদিমকে হত্যার ‘মাস্টারমাইন্ড’ বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু এখন কোথায়। সবারই আশঙ্কা, বাবু হয়তো সীমান্ত দিয়ে পালিয়েছেন। ভুক্তভোগী পরিবারের প্রশ্ন, ঘটনার দুইদিন পার হলেও প্রধান অভিযুক্ত চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু বা তার ছেলে ফয়সাল কোথায়? তারা কি দেশ ছেড়ে পালিয়েছে? না হলে কেন এখনো তারা আটক হচ্ছেন না? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও অনেকের মাঝে প্রশ্ন রয়েছে। আদৌ কি বাবু তাদের হাতে আটক রয়েছে নাকি পালিয়ে যাওয়ার সহায়তা করেছেন? নিহত নাদিমের মেয়ে রাব্বিয়াতুল জান্নাত বলেন, ‘আমার আব্বুর হত্যার মাস্টারমাইন্ড চেয়ারম্যান বাবু। এখনো কেন চেয়ারম্যানকে ধরা হচ্ছে না। সে কি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে?’
রব্বানীর মেয়ে রাব্বিয়াতুলের কান্নার কন্ঠে আমরাও কণ্ঠ মিলাচ্ছি আসলেই বাবু ও তার ছেলে কোথায়? দেশে আছে নাকি দেশের বাইরে চলে গেছে? আদৌ কি গ্রেফতার হবে তারা। যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের স্বীকারোক্তিও বা কি? আদৌ এই হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমুলক বিচার হবে? সাগর রুনি হত্যাকারীদের আজও বিচার হয়নি। সাংবাদিক নাদিমের হত্যাকারী যারা আটক হয়েছে, আরও যারা আটক হবে তারাও আদালত থেকেই জামিনে মুক্তি পেয়ে যাবেন।
কত নির্মম, কতো নিষ্ঠুরতা…। সত্য ঘটনা নিয়ে নিউজ করার কারণে একটি জীবন শেষ হতে হলো। হায়রে মানুষ। হায়রে প্রতিহিংসা। গোলাম রব্বানী যদি তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ লিখেই থাকেন তাহলে আইনের আশ্রয় নিতেন? নিয়েছিলেন চেয়ারম্যান বাবু, কিন্তু সাংবাদিক রব্বানীর লেখা সঠিক হওয়ায় মামলা খারিজ করে দেয়া হয়। যার ক্ষোভে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। বাংলাদেশে অনেক আলোচিত ঘটনা আছে যে ঘটনায় দেশের সকল আইনজীবীরা একাত্বতা পোষন করেছেন ঘাতকদের পে তারা আদালতে আইনী লড়াই করবেন না। অনেক সাংবাদিক হত্যা হয়েছে কখনো শুনিনি আইনজীবীরা সাংবাদিক হত্যাকারীদের পক্ষে লড়বেন না। বরগুনার রিফাত হত্যাকান্ড, যেখানে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে সে দৃশ্য ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়েছিল তাদের পরেও আইনজীবী কাজ করেছেন।
তাহলে প্রকাশ্যে হত্যা করেও কি পার পেয়ে যাবে ঘাতকরা? তাহলে এটা বলা যায়, হত্যা করা সহজ, বিচার করা কঠিন। এ বর্তমান সমাজে মানুষকে হত্যা করা সহজ কিন্তু বিচার করা খুবই কঠিন। যখন হত্যা করা হয়, আইন হাতে তুলে নেয়া হয়, তখন আইন শৃঙ্খলা অবনতি হয় না; আইন নিয়ে কথাও হয়না, যখন আসামীদের বিচারকার্য শুরু হয় তখন ‘মাই লর্ড আমার মোয়াক্কেল নির্দোশ, আমার মোয়াক্কেল জামিন পাওয়ার হকদার’। সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিমের হত্যাকারীর বিচারে বেলায়ও ঠিক এমনই হবে নাতো? আইনজীবীদের প্রতি বিনয়ের সহিত নিবেদন করছি, পেশার বাইরেও একটি জগত রয়েছে, যেখানে বিবেক, মুল্যবোধ,মনুষ্যত্ব রয়েছে, রয়েছে মানবিকতা। আসুন শুধু সাগর রুনি ও গোলাম রব্বানী নাদিমের বেলায়ই নয় এ রকমের প্রকাশ্য হত্যাকারীদের পক্ষে আপনারা আইনী সহযোগিতা করবেন না। আপনাদের মাধ্যমেই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হয়।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই