কেন যেন আমাদের সমাজে বাবাদের ওভাবে মূল্যায়ন হয় না
১৮ জুন ২০২৩ ১৫:৩৮
বাবা এক মায়ার নাম, বাবা এক ছায়ার নাম। বাবা চোখের সামনে ভেসে ওঠা এক জীবনযোদ্ধার নাম। পৃথিবীর আলো দেখার পর থেকে যে মানুষটা আমাদের একটু সুখের জন্য, আমাদের চাওয়া-পাওয়াগুলো মেটানোর জন্য নিজের সব সুখ ও ইচ্ছা বিসর্জন দেন তিনি বাবা।
যিনি আমাদের চাহিদা, আমাদের আবদারগুলো পূরণ করার জন্য দিনকে রাত এবং রাতকে দিন বানিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যান তিনি আমাদের বাবা। বাবা জীবনের বটবৃক্ষ, নিদাঘ সূর্যের তলে সন্তানের অমল-শীতল ছায়া। বাবার তুলনা তিনি নিজেই। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন।
বাবা মানে নির্ভরতার আকাশ, নিরাপত্তার চাদর। আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার প্রতীক হলো বাবা। যার কল্যাণে এই পৃথিবীর রূপ, রঙ ও আলোর দর্শন। সন্তানের নিত্য আবদার মেটানো এবং সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য নিজের বর্তমানকে প্রতিনিয়ত হাসিমুখে বিসর্জন দেওয়া এই বাবাদের আজ আলাদাভাবে স্মরণ করার দিন।
প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বজুড়ে বাবা দিবস উদযাপন করা হয়। সে হিসেবে আজ রবিবার (১৮ জুন) বিশ্ব বাবা দিবস। এ বাবা দিবস উদযাপনের পেছনে রয়েছে এক সুমহান ইতিহাস।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় প্রথম ‘বাবা দিবস’ পালিত হয়। আবার সনোরা স্মার্ট ডড নামে ওয়াশিংটনের এক নারীর মাথাতেও বাবা দিবসের আইডিয়া আসে। যদিও তিনি ১৯০৯ সালে ভার্জিনিয়ার বাবা দিবসের কথা একেবারেই জানতেন না। ডড এই আইডিয়াটা পান গির্জার এক পুরোহিতের বক্তব্য থেকে, সেই পুরোহিত আবার মাকে নিয়ে অনেক ভালো কথা বলছিলেন। তার মনে হয়েছিল, তাহলে বাবাদের নিয়ে কিছু করা দরকার। ডড আবার তার বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগেই পরের বছর ১৯১০ সালের ১৯ জুন বাবা দিবস পালন করা শুরু করেন।
১৯১৩ সালে আমেরিকার সংসদে বাবা দিবসে ছুটি ঘোষণার জন্য একটি বিল উত্থাপন করা হয়। ১৯২৪ সালে সে সময়কার আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে পূর্ণ সমর্থন দেন। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন বাবা দিবসে ছুটি ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রতিবছর জাতীয়ভাবে বাবা দিবস পালনের রীতি চালু করেন। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
হাজারো কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করে তিল তিল করে সন্তানকে বড় করে তুলেন বাবারাই। তাদের জন্যই এই বাবা দিবস। অবশ্যই বাবাদের জন্য ভালোবাসা প্রতিদিনই, প্রতি মুহূর্তেই। তবে আজ বিশেষ দিবস, তাদের বিশেষভাবে স্মরণ করার দিন। মুখ ফুটে ‘ভালোবাসি’, ‘মাই লাভ ফর ড্যাড’ বলার দিন। আজ বাবাকে নিয়ে কেক কাটা হবে। ফুল, নতুন জামা, প্রিয় বই উপহার দেওয়া হবে বাবাকে। প্রয়াত বাবার কথা ভেবে নীরবে চোখ মুছবেন অনেকেই। ‘বাবা কতদিন কতদিন দেখি না তোমায়…’। এই দেখা আর হবে না।
বাবাকে ঘিরে আমাদের প্রত্যেকের রয়েছে অনেক না বলা গল্প, না বলা স্মৃতি। এ দিন অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাবার স্মৃতিচারণ করে থাকে। অনেকে বাবার স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে ছুটে যায় দুরন্ত শৈশব, কৈশোরে। প্রত্যেক সন্তানের কাছে বাবা অতুলনীয়, অসাধারণ। আমার চোখে আমার বাবা একজন মহামানব। পৃথিবীর সব সন্তানের কাছেই তাই।
‘বাবার কাছেই হাঁটতে শিখি
শিখি চলা-বলা,
সারাটা দিন কাটতো আমার জড়িয়ে তার গলা।’
আমি পরিবারের বড় সন্তান। সে হিসেবে ছোট বেলা থেকেই আমি আদর-ভালোবাসা পেয়েছি সবচেয়ে বেশি। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে— ছোটবেলায় আমার একটা কঠিন অসুখ হয়, আমার যায়যায় অবস্থা। আমার বাবা আমাকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে পাগলের মতো ছুটে বেড়ান। সেই শিশুকাল থেকেই এখন পর্যন্ত আমার কোনো আবদারে বাবা ‘না’ করেননি। শত কষ্ট শত অভাবের মাঝেও আমার যেকোনো বায়না, ইচ্ছা তিনি পূরণ করে দেন। আসলে বাবারা এমনই। আমার বাবা আমাকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখেন। আমি যাতে মানুষের মতো মানুষ হতে পারি। সবকিছুর ঊর্ধ্বে একজন ভালো মানুষ, নৈতিক ও আদর্শবান মানুষ হতে পারি। আমারও স্বপ্ন, আমারও আকাঙ্ক্ষা আমি যেন একজন ভালো মানুষ হতে পারি, দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারি, দেশ ও জাতির গর্বে পরিণত হতে পারি।
বাবা আমাদের প্রত্যেকের জীবনের বটবৃক্ষের ছায়া। যার বাবা নেই সে বুঝে এই না থাকার বেদনা কেমন! আমাদের সুখ, শান্তি আর আবদার মেটানোর জন্য বাবাদের অসীম ত্যাগতিতিক্ষা কখনোই বলে বা লিখে শেষ করা যাবে না। বাবাদের ঋণ আমরা কখনো বিন্দুমাত্রও শোধ করতে পারবো না। কিন্তু কেন যেন আমাদের সমাজে বাবাদের অবদান ওভাবে স্বীকার করা হয় না বা বাবারা ওভাবে মূল্যায়িত হন না, যেভাবে মায়ের অবদান স্বীকার করা হয়ে থাকে, মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। অথচ বাবারা আজীবন ‘নীরব যোদ্ধা’ হিসেবেই সংগ্রাম করে যান শুধু ছেলেমেয়ে আর পরিবারের জন্য।
বাবাদেরকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থেই সন্তানকে তার বাবার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। পরম দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পিতার বুকফাটা আর্তনাদ না শোনার মতো সন্তানও এই সমাজে রয়েছে। আমাদের দেশে দেখা যায়—যে বয়সে একজন বাবা তার ছেলে-বৌ, নাতি-নাতনীর সাথে কাটানোর কথা জীবনের সে সময়টা তাকে কাটাতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।
এ বিষয়ে জনপ্রিয় একটা গানের বাস্তবতা মনে পড়ে যায়—‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/ মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার। নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি/ সবচেয়ে কমদামি ছিলাম একমাত্র আমি/ ছেলে আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/ আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’
বাবা দিবসে সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই—জীবনের শেষ বয়সে আমাদের কারও বাবারই বাসস্থান যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয়। বাবারা সব সময় ভালো থাকুক। বাবা দিবসে পৃথিবীর সকল বাবা’কে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইমরান ইমন কেন যেন আমাদের সমাজে বাবাদের ওভাবে মূল্যায়ন হয় না মুক্তমত