ঈদুল আযহা: অর্জন ও বিসর্জনের উৎসব
২১ জুন ২০২৩ ১৫:৩৮
যিলহজ্জ মাস হলো হিজরী সনের দ্বাদশ মাস এবং সর্বশেষ মাস। এ মাস অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ অধিক মূল্যবান মাস৷ এ পবিত্র মাসেই রয়েছে বিত্তমানদের জন্য ফরয হজ্জ এবং ঈদুল আযহার নামায। মানব ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ঘটনা সন্তান কোরবানীর ঘটনা। এ মাসে মুসলমানরা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ত্যাগ, সহিষ্ণুতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি যথাযথ ভাবে বাস্তবায়িত করতে হয়।
কুরবানী শব্দটির মূল শব্দ হচ্ছে কুরবানুন, যার আভিধানিক অর্থ হলো নৈকট্য অর্জন করা। আর কুরবানী শব্দটির অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ, বিসর্জন, আল্লাহর রাস্তায় পশু জবেহ করা। পরিভাষায় বলা হয়- কোন পশু জবেহ করার মাধ্যমে অথবা আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ বা সদকা করা৷ নিজের প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর রাস্তায় বিসর্জন করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করা। এক কথায়- ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের নামই কুরবান। মুসলমানরা প্রতি বৎসর জিলহজ্জ মাসের ১০, ১১, ১২ তারিখের যে কোন দিন সূর্যাস্তের পূর্বে আল্লাহ তায়ালার নামে বিভিন্ন প্রকার হালাল পশু কুরবানী দিয়ে থাকে৷
হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কুরবানি:- হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এর ১৩, ১৪ বছর বয়সে কুরবানি বিষয়ে ইংগিত দিয়ে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- যখন হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম পিতার কার্যক্রমে সহায়তা করার মত বয়সে উপনিত হলেন- তখন হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম প্রিয় পুত্রকে সম্ভোধন করে বলেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি তোমাকে জবেহ করেছি। এতে তোমার মন্তব্য কি? পুত্র বললেন, হে আমার সম্মানিত পিতা! আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা শীঘ্রই বাস্তবায়ন করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মাঝে পাবেন। ( সূরা সাফফাত:১০২)
হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কুরবানির বিষয়ে পবিত্র হাদিস শরীফের মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। একদিন হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম স্বপ্নে দেখেন, তাঁকে বলা হলো ইবরাহিম তুমি কুরবানি কর। তিনি সকালে ১০০ টি উট কুরবানি করেন। কেননা নবীগণের স্বপ্নও অহী। পরের দিনও আবার স্বপ্ন দেখলেন। আবার ১০০ টি উট কুরবানি দিল। তৃতীয়দিনও আবার স্বপ্ন দেখলেন, বললেন ইবারাহিম তুমি কুরবানি কর। তিনি আরয করলেন- মাবুদ আমি কি কুরবানি করব? ইরশাদ হলো, তোমার প্রিয় বস্তুটি কুরবানি দাও। অন্য বর্ণনায় ও পাওয়া যায়। স্বপ্নে ইশারা ইংগিতে নির্দিষ্ট কোন বস্তুর কথা বলা হয়নি। মহান আল্লাহর নির্দেশ মতে শিশুপুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম কে কোরবানির জন্য মিনা নামক প্রান্তরে শায়িত করে ধারালো ছুরি চালানোর পরও শিশুপুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এর কোমল চামড়া কাটা যাচ্ছিল না। হতাশ হ্নদয়ে ভেঙে পড়লেন। তখনি এক পর্যায়ে অনুভব করলেন, কুরবানি হয়ে গেছে। চক্ষু যখন খুললেন তখন দেখতে পেলেন দুম্বা কুরবানী হয়ে গেছে৷ তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। তখন আওয়াজ আসল- “হে ইবরাহিম! নিশ্চয়ই তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছ। আর এভাবেই আমি পূণ্যবানদের পুরস্কৃত করি। সেদিন বেহেশত থেকে দুম্বা এনে হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এর স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। এটি উম্মতে মুহাম্মদীর উপর ওয়াজিব করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রতি সালাত আদায় করুন এবং কুরবানি করুন। ( সূরা কাউসার ২)
মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির বিধান দিয়েছি, তিনি তাদের কে জীবনযাপনের স্বরুপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে৷ তোমাদের প্রভুই একমাত্র প্রভু। (সূরা হজ্জ: ৩৪)। কুরবানী হচ্ছে ইসলাম ধর্মের বিশেষ রীতি। কুরবানি না করে এর বিনিময়, মূল্য ইত্যাদি দেওয়া যাবে না। (তাফসীরে নূরুল ইরফান)। মিশকাত শরীফের মধ্যেও রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- কুরবানী হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এর সুন্নাত।
কুরবানি যার ওপর ওয়াজিব:- স্বাধীন ও মুকিম ব্যক্তি যিনি মালেকে নেসাব। অর্থাৎ মানুষের মৌলিক চাহিদা ব্যতিত সাড়ে সাত ভরি স্বপ্ন বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য অথবা সমমূল্য অর্থ বা ব্যবসার মালিক হওয়া।
কুরবানি যাদের ওপর ওয়াজিব নয়:- নাবালেগ ও পাগল নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। যদি তাদের অভিভাবক তাদের পক্ষ থেকে কুরবানি দিলে সহিহ বলে। মুসাফিরের জন্য কুরবানি ওয়াজিব নয়।
কোরবানির সময়:- জিলহজ্জ মাসের ১০ হতে ১২ তারিখের সূর্যাস্তের আগে পর্যন্ত। অর্থাৎ তিনদিন দুইরাত। এর আগেই নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই কুরবানি ওয়াজিব। ( রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২)
কোরবানির পশু ও পশুর বয়স:- গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা ইত্যাদি চতুষ্পদ হালাল গৃহপালিত পশু দ্বারা কুরবানি জায়েয। আর বয়স হলো গরুর ২ বছর, ছাগলের কমপক্ষে ১ বছর, উট ৫ বছর। কোরবানির জন্য সুন্দর ও নিঁখুত পশু বাছাই করা উত্তম। যেসব পশু অন্ধ ও এমন যে, যবেহ করার স্হানে যেতে অক্ষম, শিং ভাঙ্গা, লেজ কাটা, কান কাটা বা দুর্বল ইত্যাদি পশু কোরবানি উপযুক্ত নয়।
কোরবানির অংশ ও অংশদারিত্বে নিয়ম: গরু, মহিষ, উট এগুলোর সাত অংশ। অর্থাৎ সাতজনের নামে কোরবানি করা যাবে। তবে শর্ত হলো সব অংশ আল্লাহর ওয়াস্তে করতে হবে। খাওয়ার জন্য খেয়াল করলে হবে না কুরবানি। কেউ একজন পশু ক্রয় করার পর অংশীদার নিতে চাইলে নিতে পারবে। তবে ক্রয় করার আগে অংশীদার ভাগগুলো ঠিক করে নেয়া উত্তম। অন্যথায় মাকরুহ।
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতে মুহাম্মদীর পক্ষ থেকে কোরবানি করেছেন এবং উম্মতের কথা স্মরণ রেখেছেন। এটা সৌভাগ্য যে, যার পক্ষে সম্ভব, সে যেন রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য কোরবানি করে। কোরবানির সাথে আকিকা করা যাবে। মৃত ব্যক্তির জন্য কোরবানি দিতে পারবে।
কোরবানির গোশত ভাগ করার নিয়ম:- কোরবানির গোশত ৩ ভাগে ভাগ করে ১ ভাগ গরীবের জন্য, ১ ভাগ আত্নীয় স্বজনের জন্য,অন্য ভাগ নিজের জন্য রাখা মুস্তাহাব।
কোরবানির পশু জবেহ করার নিয়মঃ- কোরবানির পশু নিজে জবেহ করা মুস্তাহাব। যদি নিজে করতে না পারে, তাহলে অন্যকে দিয়ে জবেহ করাবে। জবেহ করার সময় নিম্নের রগসমূহ কাটার ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হবে। ১. শ্বাসনালী ২. খাদ্যনালী ৩. রক্ত চলাচলের রগ দু’টি। কোরবানির পশুর মাথা দক্ষিণে এবং পিছনের দিক উত্তর দিকে রেখে কেবলামুখী হয়ে শায়িত করতে হবে।
ঈদুল আযহার আমল ও ফজিলত:-
১. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল আযহার দিবসে নামায আদায় না করা পর্যন্ত কিছুই আহার করতেন না। ( তিরমিযী, দারেমী, ইবনে মাজাহ)।
২. যারা কোরবানি করবে তাদের দাঁড়ি, চুল, লোম না ছাটা ও নখ না কাটা মুস্তাহাব। (রদ্দুল মুহতার)
৩. জিলহজ্জ এর ৯ তারিখের ফজর থেকে ১৩ তারিখের আসর পর্যন্ত জামাআতে শরীক সকল মুকতাদী ও ইমামের উপর ফরয আদায়ের পর ১ বার উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করা ওয়াজিব এবং ৩ বার পড়া উত্তম।
৪. ঈদুল আযহার নামাযে ও জুমার নামাজের পর পাঠ করা উত্তম। ইদগাহে যাওয়ার সময়ও তাকবীর পাঠ করা উত্তম। আর তাকবির হলো- “আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।”
৫. এ পবিত্র মাস জিলহজ্জ মাসে ১ তারিখ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত রোযা রাখা উত্তম। সম্ভব না হলে ১ টি রোযা রাখা উত্তম।
এ মাসে বেশী বেশী নফল নামায আদায় করা উত্তম। আর ঈদুল আযহার রজনীটি আল্লাহর করুণা লাভের পঞ্চরাত্রির অন্যতম। এ পবিত্র রাতে বেশী বেশী নফল ইবাদতের মাধ্যমে রাত অতিবাহিত করলে অশেষ কল্যাণ ও সওয়াব নিহিত রয়েছে। কোরবানির বিশাল নিয়ামতের মূল কারণ হলো- বান্দার পক্ষ থেকে মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি মুহাব্বতের এক প্রোজ্জ্বল নির্দশন পরিলক্ষিত হয়। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের প্রত্যেকের কুরবানি কবুল করুক। আমিন
লেখক: শিক্ষার্থী, ফাযিল ৩য় বর্ষ, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসা
সারাবাংলা/এজেডএস