শ্রীমতি খালের জৌলুস হারিয়ে যাচ্ছে
২১ জুন ২০২৩ ১৬:০২
“আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর। মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে, ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে। দুই কুলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া, বরষার উৎসব জেগে উঠে পাড়া”।
পটিয়া শ্রীমতি নদীর পাড়ে আসলে রবী ঠাকুরের “আমাদের ছোট নদী” কবিতার চরণগুলি মনে পড়ে। বনে সাড়া না পড়লেও শ্রীমতি খালে চলচলাইয়া কলাইয়া পানির ঢল কিন্তু গ্রামে সাড়া পড়ে যায়। নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়, শৈশবে ফুফু বাড়িতে বেড়ানোর স্মৃতিগুলো চোখের সামনে জলছবির মতো ভেসে উঠে। শ্রীমতি খালের পাশে বিসিক শিল্পের মাঠে সাইকেল চালানো শেখা, ক্রিকেট খেলা, শ্রীমতি খালে জাল দিয়ে মাছ ধরা, আহা দুরন্ত কৈশোর! কেউ কী ফিরিয়ে দিবে আমায়?
কেঁ কোঁরত কেঁ কোরত দাঁড়টানার শব্দে চলত সাম্পান আর নৌকা। পটিয়া শ্রীমতি খালের উৎপত্তি মুলত শ্রীমাই পাহাড় থেকে। শ্রীমতি রাণীর নাম অনুসারে শ্রীমাই পাহাড়। শ্রীমাই পাহাড় থেকে শ্রীমাই খাল। শ্রীমাই খালের কিছু অংশ নয়ানিভারাম হাইদগাঁও গ্রামের পড়েছে। বুদবুদ চর, সাদা মাঠির পাহাড়, কিছু পাহাড়ী গ্রাম। যেখানে প্রাচীনকালে বন্যহাতি নেমে দলবদ্ধ হয়ে ঘোরাফেরা করতো বলে ঐএলাকার আদি নাম ছিল হস্তীগ্রাম হস্তীগ্রাম থেকে হাইদগাঁও নামের উৎপত্তি। প্রাচীন জনশ্রুতি মতে জানা যায়- শ্রীমতি খালের উত্তর পশ্চিম তীর ঘেষে জনৈক সাধুঋষি শিলা ‘চক্র পূজা’ চর্চায় নিজেকে নিয়োগ করেন। এ সময়কালের মধ্যে এক রাজা পাত্রমিত্র নিয়ে এ পথ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। রাজা সাধুকে নানা পরিক্ষা করে দেখেন এবং শিলা চক্র পূজার প্রভাব লক্ষ্য করে এর স্মারক চিহ্ন রূপে স্থানের নামকরন করেন ‘চক্রশালা’।
এ প্রসঙ্গে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিমের অভিমত হচ্ছে ‘ চন্ডিলাহ রাজার রৌপ্য মুদ্রার লিপি পাঠ থেকে জানা যায় যে ‘চাকশোয়ানা’ নামের শব্দ থেকে সম্ভবত আধুনিক ‘চক্রশালা’ নামের উৎপত্তি। কচুয়াই ইউনিয়নের, আজিমপুর গ্রামের পূর্ব নাম ‘চাষকোলা’ থেকে চক্রশালা নামের উৎপত্তি। চক্রশালা এবং শ্রীমতি খালকে গিরে রয়েছে এরকম অনেক অজানা কাহিনী। শ্রীমতি খাল দেখতে ছোট নদীর মতো। পাহাড়ী জল ধারার স্রোতে খালের সৃষ্টি হয়। শ্রীমতি খাল বরইতলী থেকে এঁকে বেঁকে কেরাঞ্জ খালে গিয়ে মিলিত হয়েছে।
বর্ষায় খালটি পানিতে টইটম্বুর থাকে। পাহাড়ী ঢল নামে ছল ছলাইয়া কল কলাইয়া পাহাড়ী ঢলের স্রোতে ভেসে যায় মানুষের বাড়ি-ঘর। প্লাবিত হয় পটিয়ার বিভিন্ন ইউনিয়ন। বন্যার সময় শ্রীমতি খালের ঢলে পটিয়ার বাহুলি, ভাটিখাইন, ছনহরা, বাথুয়া, মোড়লী, কচুয়াই ইউনিয়নের অনেক বাড়ি ঘর শ্রীমতির গ্রাসে হারিয়েগেছে। একসময় শ্রীমতি খালের পাহাড়ি ঢলের পানি গ্রাম ছাড়িয়ে পটিয়া শহরও প্লাবিত হতো। তৎকালীন পটিয়ার প্রয়াত চেয়ারম্যান শামসুল আলম মাষ্টারের উদ্যেগে শ্রীমতি খালের উপর প্রথম বাঁধ নির্মাণ করা হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলো বন্যার হাত থেকে থেকে রক্ষ পায়। শ্রীমতি খালের শুভ্র কাঁচ বালি দালান-কোঠা নির্মাণে ব্যবহার হয়। সম্প্রতি শ্রীমতি খালের প্রয়োজনতিরিক্ত বালি উত্তোলণের ফলে খালের প্রাকৃতিক পরিবেশ অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুম এলে খালের দু পাশে বাঁধ এবং বাড়িঘর শ্রীমতি খালে বিলীন হয়ে যায়। আবার কিছু এলাকায় খাল ভরাট হয়ে গেছে। শীত মৌসুমে খালের পানি শুকিয়ে যায়। পানি শুকিয়ে গেলে পাহাড় থেকে বাঘ, হাতি, হরিণসহ বনের বিভিন্ন পশুর বিচরণ দেখা যায়। আদিকাল থেকে শ্রীমতি খালের পারে প্রচুর পরিমাণে কচু এবং নানা রকমের সবজির চাষাবাদ হতো। কতিত আছে কচু থেকে কচুয়াই ইউনিয়ন। কোন এক পল্লী কবি চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ননা দিতে গিয়ে বলেছিলেন,
“আসল সৈয়দ যারা মাইল্যাপাড়া
হারালাতে ফকির বেশ
পটিয়াতে কচুছড়া
চরকানাইতে ভোয়ইয়া বেশ”।
শ্রীমতি খালে উপর দুটো সেতু। শ্রীমাই ব্রিজ নামে পরিচিত। শ্রীমতি খালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিসিক শিল্প নগরী। ব্রীজের পাশে খ্রিস্ট্রান সম্প্রদায়ের উপসানালয়, অপর পাশে অবকাশ যাপনের জন্য চমৎকার শ্রীমতি খালের বাঁধ। বাঁধের পাড়ে অনেক ভ্রমণ পিপাসুরা বেড়ানোর জন্য আসে। শ্রীমতি খালের ভরাট হয়ে যাওয়া অংশগুলো পুনরায় খনন করে দুপাশে খালের বাঁধগুলো আরও মজবুত করে নির্মাণ করলে শ্রীমতি খাল তার প্রাণ ফিরে পাবে। নৌকা সাম্পানও চলাচল করতে পারবে। শ্রীমতি তাঁর আগের জৌলুসতা ফিরে পাবে।
শ্রীমতি খালসহ এর শাখা উপশাখা দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধার খনন করা অতিব জরুরী। না হয় অদুরভবিষ্যতে পটিয়া পৌরসভাসহ পাশ্ববর্তী ইউনিয়নগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়নবোর্ডসহ কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
লেখক: সমন্বয় সহকারী ইতিহাসের খসড়া
সারাবাংলা/এজেডএস