Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চিকিৎসাসেবা হোক আরও সহজতর ও উন্নত

তৌফিক সুলতান
২৩ জুন ২০২৩ ১৬:৪৪

চিকিৎসাসেবা পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি। যদিও মানুষ টাকার বিনিময়ে ওষুধ, চিকিৎসা পরামর্শ ক্রয় করে থাকে। আমাদের এই বেঁচে থাকার জন্য চিকিৎসা নামের সোনার হরিণ আসলে কতটা মৌলিক এটাই বর্তমানে সবার মৌলিক প্রশ্ন।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ছাড়াও বেশ কিছু কারণে জনগণের এই মৌলিক অধিকারটি আজও পূরণ করা সম্ভব হয়নি। সরকারি আধা-সরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহ এবং এনজিওগুলো এক্ষেত্রে একযোগে সেবার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে না এলে সকলের জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণ আদৌ সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ। কেননা চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে আমাদের দেশে পর্যাপ্ত ডাক্তার, দক্ষ নার্স ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব অনেক বেশি। সেই সাথে আমাদের অসচেতনতা রোগীদের দুর্ভোগের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। এমন অনেক শিক্ষিত লোকও দেখা যায় যারা জানেনই না কোন রোগের বিশেষায়িত হাসপাতাল কোনটা। এবং তার অবস্থানটাই বা কোথায়।

বিজ্ঞাপন

সকলকে এমএলএফএফ ডিগ্রীধারী হতে হবে এ কথা আমি বলছি না। তবে স্বাস্থ্য সচেতনতা, প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান, কোন রোগের বিশেষায়িত হাসপাতাল কোনটা এবং তার অবস্থান সম্পর্কিত জ্ঞান যে অনেক ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে তা সকলেই মেনে নিতে বাধ্য। এ সম্পর্কিত জ্ঞান নিঃসন্দেহে বাঁচিয়ে দিতে পারে অনেক মূল্যবান প্রাণ।

আমাদের আশেপাশে বা চলার পথে নানা দুর্ঘটনা ঘটে । এই দুর্ঘটনা কবলিত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো একজন সুনাগরিকের কর্তব্য । তবে এই পাশে দাঁড়ানোটা যদি হয় আন্তরিকতাপূর্ণ এবং ফাস্ট এইড জ্ঞানসম্পন্ন তবেই তা হয় যথার্থ। ডাক্তার আসার পূর্ব পর্যন্ত সময় আহত বা আক্রান্ত ব্যক্তির আরোগ্যের পথ সুগম করা এবং অবস্থার অবনতি না ঘটে সে মত ব্যবস্থা করাই প্রাথমিক চিকিৎসা।

বিজ্ঞাপন

তাই বিশেষ শিক্ষার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের মধ্যে চিকিৎসাসেবার প্রাথমিক শিক্ষা ও সচেতনতা প্রদান করা অতান্ত জরুরী। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল—এর কথাই যদি বলি, এখানে প্রতিদিন অসংখ্য নতুন রোগী আসছে, রোগীকে সহযোগিতা করার মত অজ্ঞ-বিজ্ঞ দুই ধরনের লোকই পাওয়া যাবে। তারা কাছাকাছি কোন নিরাময় কেন্দ্রে নিয়েও যাবেন। সমস্যার শুরুটা হয় এরপর থেকে। আমাদের একটা জাতীয় চরিত্র হল আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যের স্বার্থের বেলায় আন্তরিক, যতক্ষণ না তার সাথে নিজ স্বার্থের সংযোগ ঘটে। আর এ কারণেই সমস্যার শুরু হয় কেননা এর পরবর্তী ধাপগুলোই কারো না কারো স্বার্থসংশ্লিষ্ট।

উল্লেখযোগ্য কিছু অভিযোগ যা অনেক পূর্ব থেকে করা হচ্ছে যেমন বিভিন্ন হাসপাতালে নার্স এবং ডাক্তারদের কাজ করে থাকে ওয়ার্ড বয় ও আয়ারা। যার ফলে অনেক দুর্ঘটনাও ঘটে। মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে এধরণের কাজ যে শুধু মাত্র সরকারি হাসপাতালেই লক্ষ করা যায় বিষয়টি এমন নয়, প্রাইভেট হাসপাতালে তা আরও ভয়াবহ।

প্রাইভেট হাসপাতালে ওযার্ড বয় গলার অপারেশন করতে গিয়ে রুগীর মৃত্যুর মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। একই ইনস্টোম্যান কোনো প্রকার ভায়েল ছাড়াই একের অধিক রুগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেও দেখা যায়। তারপরও বন্ধ হচ্ছে না এই সকল অনিয়ম। বড় ধরনের কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে অভিযুক্ত হাসপাতাল কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে। কিছুদিন পর পুনরায় যথারীতি উক্ত হাসপাতালের সকল কার্যক্রম চালু হয়।

সমস্যার সমাধানে প্রস্তাবনা:
✪একই ডাক্তার দিয়ে যাবতীয় জটিল রোগের চিকিৎসার সনাতনী পদ্ধতি পরিহার।
✪ সঠিকভাবে সরকারী ঔষধ সরবরাহ এবং বিলি নিশ্চিত করা।
✪ ডাক্তারদের চাকুরীর বয়স এবং যোগ্যতা সাপেক্ষে প্রমোশনের ব্যবস্থা করা।
✪ প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্রে অন্তত একজন পাবলিক রিলেশন অফিসার নিয়োগ।
✪অনতিবিলম্বে দেশে প্রয়োজনানুযায়ী মানসম্মত মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। যেখান থেকে বেড়িয়ে আসবেন চিকিৎসক–নার্স যা আমাদের দেশের চিকিৎসক–নার্স এর ঘাটতি পূরণে করতে সক্ষম হবে।
✪ পরিচালনা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে।
✪ জেলা, উপজেলা, গ্রাম পর্যায়ে অবস্থানরত ডাক্তারদের শহরের তুলনায় বেশি সুযোগ সুবিধা প্রদান করা।
✪ প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক ,নার্স এবং মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টের ব্যবস্থা করা।
✪ প্রতিটি ডাক্তারকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এফসিপিএস ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ হিসেবে তৈরি করা।
✪ সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্র ক্লোজ মনিটরিং এর ব্যবস্থা গ্রহণ। যা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে খুব সহজেই সম্ভব।
✪ যেসব ব্যক্তিবর্গ হাসপাতাল পরিচালনা করেন তাদের দেশের বাইরে চিকিৎসা গ্রহণ নিষিদ্ধ করা উচিৎ।
✪ হাস্যকর মনে হলেও বলব এলাকার প্রতিটি জনপ্রতিনিধি এবং সরকারী অফিসারদের স্থানীয় সরকারী নিরাময় কেন্দ্রগুলো থেকে চিকিৎসা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা উচিৎ।
✪ একটি হাসপাতালের রোগী থেকে শুরু করে চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড বয়সহ সবার সুযোগ–সুবিধা দেখা এবং সেবা নিশ্চিত করার জন্য সেখানে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
✪ একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বা পুরো স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ বাজেট কীভাবে কোথায় খরচ করতে হবে, সেটির পরিকল্পনা ও তদারকি করার দক্ষতা এই ব্যবস্থাপকের থাকতে হবে।
✪ জবাবদিহিতা থাকতে হবে পরিকল্পনামাফিক কাজ ঠিকমতো না হলে তার ব্যাপারে জবাবদিহি করার পরিবেশ থাকতে হবে। ব্যবস্থাপকদের যেমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে, তেমনি কাজে ত্রুটি থাকলে সেই ব্যাপারে তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।
✪ চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যারা চিকিৎসকের গায়ে হাত তুলবে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া চিকিৎসকদের রোগীর সঙ্গে যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ানো জন্য সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

ঢামেকহা আশপাশের পরিবেশের কথা যদি বলি,এর আশেপাশে দেখা যায় নেশাখোরদের অবস্থান। যেখানে সর্বসমূখে নেশা করে বেড়াচ্ছে ঔষধ, গ্লাভস, ক্যানোলা, সিরিঞ্জ ইত্যাদি ইকুইপমেন্ট খোলামেলা নিয়ে সাজিয়ে বসে আছে ক্রয়-বিক্রয়ও চলছে দিব্বি।

এই দিকেও নজর দিতে হবে কেন এসব হচ্ছে! এবং এর শেষ কোথায়! কী এর সমাধান।
প্রতিটি হাসপাতালের আশপাশের পরিবেশ সুন্দর রাখতে হবে।

সরকারি হাসপাতালগুলোর চারপাশে ভিতরে-বাইরে দালালদের আনাগোনা রোগীদের পরতে হয় দালালদের খপ্পরে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলো তো একে ব্যয়বহুল যা বহন করা সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন, এখানেও নিস্তার নেই। সেখানে রয়েছে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরত্ব। এসব দেখে মনে হয় সেখানে সেবা নয় ব্যবসায় গুরুত্ব পাচ্ছে।

সেবা নিতে আসা রোগীরা প্রশ্ন তুলছে, কর্তব্যরত চিকিৎসক এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এ পেশাটাকে মহৎ পেশা হিসেবে দেখন কি না? সেবা দিয়ে সম্মানী নিবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সুদের কারবারিদের মত সন্তানকে, রোগীকে আটকে রাখেন কীভাবে! এ সমাজ, এ দেশ আপনাদের কাছে কি কিছু দাবি করতে পারে না? কোন দায়বদ্ধতাই কি আপনাদের নেই? রোগীদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্নভাবে ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছে এর জন্য তারা দ্বায়ী ভাবছেন এই ব্যবস্থাপনাকে। বাইরে তারা এসে গালি দিচ্ছে এই দেশকে, দেশের সিস্টেমকে হাসপাতালের সাথে জড়িত সবাইকে।

এক ভুক্তভোগী রোগীর বক্তব্য, আমরা লজ্জিত হই যখন দেখি যেসব ব্যক্তিবর্গ নিজেদের নিরাময় কেন্দ্রকে বিশ্বমানের বলে সারা বছর গলাবাজি করলেও নিজের স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার সময় নিজেই নিজের হাসপাতালের উপর আস্থা রাখতে পারেন না। ছুটে যান ভিনদেশে। এদের কি তখন লজ্জা করেনা যখন বিদেশি হাসপাতালগুলোর থেকেও এরা বেশি চার্জ ধার্য করেন? অথচ সেবার মানের ব্যাপারে নিজেরাই আস্থাশীল নন। আমাদের জানতে ইচ্ছে করে এদের গায়ের চামড়া কতটা মোটা। চিকিৎসা তাদের কাছে সেবা নয় ব্যবসা।

স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা সেবা পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সরকারের দায়িত্ব স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। সরকারী ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে রোগীরা সেবা নিতে আসেন মূলত বিনামূল্যে মানসম্মত চিকিৎসার আশায়। গরীব রোগীদের শেষ আশ্রয়স্থল এই সরকারী হাসপাতাল। আর তাই প্রয়োজন যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা খাতের আমূল পরিবর্তন।

লেখক: ইন্টার্ন শিক্ষার্থী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

সারাবাংলা/এজেডএস

চিকিৎসাসেবা তৌফিক সুলতান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর