চিকিৎসায় ভুল, সেবা ও সমসাময়িক কথা
২৩ জুন ২০২৩ ১৭:১৯
‘ভুল’ শব্দটি প্রকৃতপক্ষে একটি মাত্রা নির্দেশ করে অথবা স্থান, কাল ও পাত্রভেদ নির্দেশ করে। কোথায় কতটুকু ভুল মার্জনীয় অথবা অমার্জনীয় সেটি নির্দেশ করে। আমাদের সকলেরই ভুল হয়। মাঝেমধ্যেই পত্রিকায় পড়তে হয় ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু- এ ধরনের খবর। এখন প্রশ্ন হলো সঠিক চিকিৎসা করে রোগী মারা গেলে সেটি একরকম এবং ভুল চিকিৎসা করে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে সেটি অন্যরকম।
এখানে প্রশ্নটা একটি প্রাণের। যে প্রাণ আপনি আমি সৃষ্টি করতে পারবো না। একটি পরিবারকে বাঁচাতে পারবো না। অথবা ভুল সংশোধনের সুযোগও পাবো না। অনেক ভুল সংশোধনের সুযোগ থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা নেই। আমাদের চিকিৎসার শেষ আশ্রয় হলো চিকিৎসক। সৃষ্টিকর্তার পরেই যাকে আমরা বিশ্বাস করি। তিনি কোনো ভুল করবেন না এই বিশ্বাসও করি। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা মানে ভুল বা অবহেলা যেভাবেই বিশ্লেষণ করি না কেন এটি অপ্রত্যাশিত। এবং এক্ষেত্রে যা ঘটে তা হলো আস্থার সংকট। এমনিতেই বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য বিপুল সংখ্যক রোগী প্রতি বছর ভারতে যাচ্ছে। সেখানে শুধু ভালো চিকিৎসার বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি। সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে বিশ্বস্ততার বিষয়টি। অর্থাৎ একটি নিশ্চয়তা যা একজন রোগী আশা করে। অথচ আমাদের দেশেও প্রচুর আধুনিক যন্ত্রপাতি সম্বলিত হাসপাতাল,ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। সেই একই চিকিৎসা আমাদের দেশেও হচ্ছে। ভালো মানের চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু তবুও চিকিৎসার জন্য ভারতে ছুটছেন এদেশের বহু রোগী। কেন ছুটছেন এই প্রশ্ন করলেই উত্তরটা বেরিয়ে আসে। সম্প্রতি মাহবুবা মাহবুবু রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় বিষয়টি আরও প্রকাশ্যে এসেছে। এই ঘটনা তো একটি ঘটনা নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। হাসপাতাল, ক্লিনিকে ভাঙচুরের সাথে মারধরের ঘটনাও ঘটে। এসব কেন ঘটবে? চিকিৎসা এমন একটি শব্দ যা সেই পেশার মানুষকে তার কাজ এবং সততার মাধ্যমে অনন্য উচ্চতায় পৌছে দিতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান সেবামূলক পেশাগুলোর মধ্যে চিকিৎসা ও শিক্ষা অন্যতম।
এসব যদি বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণে বিচার্য হয় বা এই পেশার কেউ বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই পেশায় আসেন তাহলে এই ক্ষেত্রকেই তিনি কুলষিত করবেন। কারণ তার কাজ শুধু টাকা উপার্জন নয় বরং তার কাজের মাধ্যমে অনেকের আস্থা অর্জন করা। সেবার ধর্মই এটা। আপনার পেশাগত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আপনাকে মানুষের কাছাকাছি পৌছাতে হবে। একজন অসুস্থ ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার পরে যাকে ভরসা করেন তিনি একজন চিকিৎসক। একজন মৃতপ্রায় ব্যক্তিও শেষ পর্যন্ত ভাবেন তার ডাক্তার তাকে অবশ্যই ভালো করতে পারবেন। এই যে ভরসা এটা আর কোথাও নেই। এইটুকু অর্জন কেবল চিকিৎসকের আছে। চিকিৎসক সেই চেষ্টাও করেন। কখনো সফল হন আবার কখনো হন না। কারণ জন্ম,মৃত্যু এসব মানুষের হাতে নেই। শুধু প্রচেষ্টা করতে পারে মাত্র। এই প্রচেষ্টাটুকু যিনি করেন তিনি ডাক্তার।
ডাক্তার পরম ভরসার নাম। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক চিকিৎসক এই পেশাকে পুরোপুরি বাণিজ্যিকীকরণ করে ফেলছেন যা সত্যিই দুঃখজনক। কিছু মানুষের জন্য সবাইকে কথা শুনতে হয়। অনেকে তার শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করেই চিকিৎসা করতে আসে। আজ জীবনের অন্যান্য ব্যয়ের সাথে বেড়েছে চিকিৎসা খরচও। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক রোগী প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা চিকিৎসকের কাছে যায় চিকিৎসা করতে। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়ে ডাক্তার হয়ে বের হচ্ছে। তারা অসুস্থ মানুষের সেবা করছে। দেশের আনাচে কানাচে বড় বড় ক্লিনিক,প্যাথলজি সেন্টার গড়ে উঠছে। অনেকের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও রোগীরা ভিড় করছে। কারণ তারা একটু নির্ভরতা চায়। এজন্য তারা প্রচুর টাকা খরচও করছে।
একজনের ডাক্তারের ওপর অনেক রোগীর চাপ। দিন-রাত তারা রোগী দেখেন। হয়তো কেউ কেউ বিশ্রামের সময়ও পান না। রোগী সিরিয়াল দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকেন চিকিৎসককে দেখানোর জন্য। তারপর এই টেষ্ট সেই টেষ্ট করাতে হয়। এখন যেন চিকিৎসা মানেই হাতে টেষ্ট রিপোর্ট থাকতে হবে এমন অবস্থা। টেষ্ট মানেই অতিরিক্ত কিছু টাকা। দরিদ্র রোগীর জন্য সত্যিই এটা চাপ হয়ে যায়। চিকিৎসা ফি, টেষ্ট ফি মিলিয়ে পকেটের মোটা টাকা খরচ হয়ে যায় ডাক্তারের কাছে গেলে। তা হোক। যদি চিকিৎসা সঠিক হয় তাহলে তো স্বার্থক। আর যদি শেষে ভুল চিকিৎসা হয় তার কি করার আছে? ভুল স্বীকার করলেই সব দায় এড়ানো যায় না। আমার কথা পাশ্ববর্তী দেশের ডাক্তাররা যদি আমার দেশের একজন নাগরিককে এই পরিমাণ বা এর চেয়ে কম টাকায় ভালো মানের এবং নির্ভার চিকিৎসা দিতে পারেন তাহলে আমাদের দেশের চিকিৎসকরা সেটা পারছেন না কেন? ডিগ্রিতে মানে শিক্ষায় তো কোনো কমতি নেই। নামের শেষে এত এত ডিগ্রি লেখা রয়েছে। তারপরও কেন এই অবস্থা হবে। আমাকে ভারতে যেতে হবে কেন? সবার আগে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। একজন ব্যবসায়ী নয়, সেবক হিসেবে চিন্তা করতে হবে। টাকা উপার্জন তো সবচেয়ে বড় লক্ষ্য তবে সেবা হবে তার থেকেও বড়। সে ক্লিনিক হোক আর ডাক্তার। সকলের একটাই ব্রত থাকবে, সেবা।
একটা ভালো অভিজ্ঞতার কথা বলি। কিছুদিন আগে আমার বৃদ্ধা মাকে নিয়ে গেলাম একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে। তিনি আমার মাকে সম্বোধন করলেন মা বলে এবং আশ্চর্য ব্যাপার হলো তিনি কোনো টেষ্ট দিলেন না। আমি টেষ্টের কথা বলাতে তিনি হেসে বললেন, আমি জানি ওনার (মায়ের) কি হয়েছে। টেষ্ট দিয়ে কি হবে? কিন্তু এমনটা তো খুব দুর্লভ আজকাল। যেখানে টেষ্ট না দিয়ে রোগীকে একটু সাহায্য করা যায় সেখানেও টেষ্ট দেন। আমার ক্ষেত্রেও সেটা ঘটেছে। কারণ ডাক্তারের কাছে গেলে টেষ্ট করাতে হবে এটা মেনেই নিয়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে আমার মতো কিছু রোগী আবার টেষ্ট না দিলেই বরং বিমুখ হন! অতি আশ্চর্য বিষয় এটা! তখন সেই ডাক্তার সম্পর্কেও সন্দেহ করেন!
আবার আমি এমন ডাক্তারও দেখেছি যে মানুষকে বুক ভরে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে হয়। তিনি দেখেছি তার ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে প্রাপ্ত ওষুধের স্যাম্পলগুলো গরীব রোগীদের দিয়ে দিতে। কেউ গরীব এটা জানার পর তার ভিজিটের টাকাও পকেট থেকে বের করে দিতে দেখেছি।
ভারতের বিখ্যাত গায়ক নচিকেতার গান’ ও ডাক্তার তুমি কতশত পাস করে এসেছ বিলেত ঘুরে, তোমার এমবিবিএস, এফআরসিএস ঝোলাতে” মোটামুটি ছোটবড় সবাই শুনেছে। সেখানে ডাক্তারদের সেবার বিপরীত মুখকে স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে এটা মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি অন্তত মানি না। সবাই সমান নয়। এর বিপরীত চিত্রও আছে। ক্ষেত্রবিশেষে ডাক্তারই জীবন মরণের ব্যবধান গড়ে দেন। এই যে করোনা মহামারী গেলো সেখানে প্রথম হিরো হলো এই চিকিৎসকরা। তারাই সামনে থেকে এতবড় একটি মহামারী পাড়ি দিয়েছে। সত্যি তারা বাহবা পাওয়ার যোগ্য। করোনা আক্রান্ত জেনেও তো তারা আমাদের চিকিৎসা করেছেন,সেবা করেছেন। মুখে যে যাই বলি, তাদের স্মরণাপন্নই হয়েছি,ভরসা করেছি,বিশ্বাস করেছি এবং এখনও করছি। এতকিছুর পরেও রোগী বিশ্বাস রাখে যে ডাক্তারবাবু হয়তো তাদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্তই নিচ্ছে। আবার এর বিপরীতে রোগীর অবস্থার সুযোগ নিয়ে টাকা আদায়ের কিছু ঘটনাও ঘটে। এরকম আরও কত ঘটনা ঘটছে। কিন্তু তারপরও সব সয়ে যায়। তাদের মুখের ভাল কথা সব ভুলিয়ে দেয়। চিকিৎসা হলো সেবার আরেক নাম। আর চিকিৎসক হলো সেই সেবার কারিগর। শুধু একটু বাণিজ্যিকিকরণ বাদ দিয়ে মানবিক হতে হবে এই আর কী।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস