ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ
৩০ জুন ২০২৩ ১৪:২৮
কোন ব্যক্তি,সমাজ বা জাতি যখন শাসনের অত্যাচারে নিষ্পেষিত হয়, পেছনের দেয়াল ঠেকে যায় এবং অধিকার আদায়ের অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না তখনই বিদ্রোহ দেখা দেয়। যুগে যুগে এরকম বহু বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সাঁওতাল বিদ্রোহ। তবে এই উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। কারণ ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশ শাসন করেছিল প্রায় দুইশত বছর ধরে। এই দুইশত বছরে ব্রিটিশদের নির্যাতন,শোষণ আর জুলমের বিরুদ্ধে বহুবার ভারতীয় উপমহাদেশে ছোট-বড় বহু বিদ্রোহ হয়েছে। মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। তিতুমীরের মতো বীর শহীদেরা শুধু বাঁশের লাঠি হাতে ব্রিটিশদের কামানের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছে। প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। এরকমই একটি বিদ্রোহের নাম সাঁওতাল বিদ্রোহ। সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি সংগঠিত বিদ্রোহ যখন জমিদারদের শাসনে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্থ। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল সাঁওতালরা। ১৮৫৫ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারে ইংরেজদের কৃষি নীতির বিরুদ্ধে সাঁওতালরা তীব্র বিদ্রোহ শুরু করেন। সেই বিদ্রোহ ছিল সশস্ত্র বিদ্রোহ। তবে সশস্ত্র হলেও ইংরেজদের কাছে ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। আর সাঁওতালদের হাতে ছিল আদিকালের তীর ধনুক। প্রায় এক বছর ধরে চলা এই বিদ্রোহ দমন করতে ইংরেজ সরকারের ঘাম ছুটে যায়। সাঁওতালদের পাশাপাশি প্রচুর সংখ্যক ইংরেজ সৈন্যও নিহত হয়। উভয় পক্ষের প্রায় দশ হাজার সেনা নিহত হয়। সাঁওতালরা পরাজিত হয়। কিন্তু কোনো বিদ্রোহ বিফলে যায় না। সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটার পেছনে মূলত কারণ হিসেবে মনে করা হয় ব্রিটিশদের নেওয়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এর বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ শাসন, এদেশীয় মহাজন ও তাদের দোসরদের হাত থেকে নিজেদের চিরায়ত জমি রক্ষার উদ্দেশ্যে তারা একতাবন্ধ হয়েছিল। ব্রিটিশরা সাঁওতালদের চাষ করা জমি পরিষ্কার করে নিজস্ব পদ্ধতিতে চাষবাদ শুরু করেছিল এবং সাঁওতালদের উপর রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করে যা সাঁওতালদের পক্ষে দেওয়া অসম্ভব ছিল।
এই অবস্থায় অনেকেই তাদের এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। তবে এরই মধ্যে সাহসী সাঁওতাল সবাইকে একত্রিক করে এবং সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহে সাঁওতালদের নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং যাদের নাম উল্লেখযোগ্য তারা হলো সিধু ও কানু। এই দুইজন সহ আরও কয়েকজন সাহসী সাঁওতালের নেতৃত্বে ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সাঁওতালরা ভগ্নাডিহির মাঠে একত্রিত হয়ে একটি স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় যা ব্রিটিশ সরকারের শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত করে। তাদের এই দাবীর প্রতি সাঁওতালরা ব্যাপক সমর্থন করে এবং ইংরেজ ও দেশীয় মহাজনদের বিরুদ্ধে একজোট হয়। সাঁওতালরা যে পাহাড়ের প্রান্তদেশে বসবাস করতো সে স্থানকে বলা হতো দামিন ই কোহ অঞ্চল। এই স্থানে তারা নিজেদের মতো কৃষিকাজ করতো। জানা যায়, এখানে প্রায় দেড় হাজার গ্রামে আশি হাজারের বেশি সাঁওতালের বসবাস ছিল। ধীরে ধীরে সাঁওতালদের পরিশ্রমে একটি পাহাড়ি অঞ্চল সমৃদ্ধ হয়। এই সমৃদ্ধ অঞ্চলটি ইংরেজ সরকারের নজরে পরে। তখনই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা চালু হয়। সরকার পাহাড়ি অঞ্চলের জমিগুলোকে স্থানীয় জমিদার বা মহাজনদের সহজ শর্তে জমিগুলোর বন্দোবস্ত দেয়। শুরু হয় সাঁওতালদের জীবনের নতুন অধ্যায়। ইংরেজ সরকারের অধীনে থাকা দেশীয় জমিদাররা অধিকাংশই ছিল মুনাফালোভী। তারা খাজনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। তারা চড়া সুদে সাঁওতালদের ঋণ দিতো চাষাবাদ করতে। তারপর ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে জমিগুলো গ্রাস করে।
এভাবে একে একে সাঁওতালরা জমি হারাতে থাকে। এইসব কাজ পরিচালনায় এবং দামিন ই কোহ অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সরকার বারহাইতে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং দীঘিতে একটি থানা স্থাপন করে। এই থানার বড়বাবু বা প্রধান দারোগা ছিলেন অত্যাচারী মহেশলাল দত্ত। আমরা অনেকেই লর্ড ডালহৌসির কথা জানি। এই লর্ড ডালহৌসি ছিলেন এই সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। যিনি একজন অত্যাচারী এবং মহাজন ঘেষা ছিল। বিদ্রোহের প্রথম দিনেই থানার দারোগাকে হত্যা করা হয়েছিল। যে অঞ্চলটি ইংরেজদের প্রতিশ্রুতিতে সাঁওতালরা নিষ্কন্টক হিসেবে শুরু করে পরিষ্কার করে বসতি ও চাষাবাদের উপযোগী করে গড়ে তুলেছিল সেই স্থানেই তাদের চড়া রাজস্ব দিতে হচ্ছিল। প্রতি বছর এই রাজস্বের পরিমাণ বাড়ছিল। তারপর এলাকায় বহিরাগতদের অত্যাচারও বেড়ে যায়। মহাজনদের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে তারা জমি ও ভিটেছাড়া হয়। দিনের পর দিন তাদের এই ক্ষোভ জমতে থাকে। একসময় তারা বুঝতে পারে তাদের ঠকানো হচ্ছে। তাদের প্রতিবাদের বিকল্প নেই। তাদের সামনে আসে কানু ও সিধু নামের দুই ভাই। ধীরে ধীরে তাদের এই আন্দোলন অন্যান্য সাঁওতাল অঞ্চলগুলিতেও ছড়িয়ে পরে। তারা একত্রিত হয়। ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহ কঠোর হাতেই দমন করেছিল। তাদের সেই দমন আপাত সফল হলেও তার ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। সিধু,কানুদের মতো বহু সাঁওতালকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। মনে রাখতে হবে এর পরেই অর্থাৎ ১৮৫৭ সালে ঐতিহাসি সিপাহী বিদ্রোহ ঘটে। অর্থাৎ একটি বিদ্রোহ আরেকটি বিদ্রোহের পথ দেখায়।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই