মানুষের জীবনে সবার আগে শেখা উচিত গুণিজনকে সম্মান করা, তাদের স্মৃতি হৃদয়ে লালন করা ধারণ করা। নিজ সন্তানকেও শেখানো উচিত মানুষকে সম্মান করা না হয় পরবর্তী প্রজন্ম সম্মান শব্দটাকে চিরতরে কবর দিয়ে দিবে। সৃষ্টিশীল গুণীজনকে সম্মান করাটাও কিন্তু পবিত্র কাজ। বিবেকের আদালতে নিজেকে প্রশ্ন করি আসলে আমরা কি তা করতে পারছি? গুণীদের সম্মান না করলে পৃথিবীতে গুণিজনের জন্ম কী করে হবে?
পল্লিবাংলার সৃজনশীল মানুষরা সবসময় অবহেলা উৎসাহ ও অনুপ্রেরণাবিহীন পরিবেশে বেড়ে উঠেছে মুখ তুলেও তাকায়নি। না ফেরার দেশে যাওয়ার পর অনেকে গুণিজনকে সম্মান দেখাতে যায়। কেন জীবদ্দশায় নয় ? অনেক সময় দেখা যায় সৃষ্টিশীল মানুষগুলো একসময় তাঁর জিয়নকাঠির আলো ছড়িয়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। সাহিত্য-সংস্কৃতিকে অমরত্ব দান করতে হলে তাদের ভালোবাসতে হবে, হাত বাড়িয়ে বিন¤্র চিত্তের সাথে সম্মান করতে হয়। অজানা বিস্মৃত অধ্যায় স্বজাতির সাহিত্য-সংস্কৃতির অতীত ইতিহাস উপলব্ধি করতে হয়।
অধ্যয়ন জীবন থেকে লেখক আহমদ ছফার নাম শুনেছি, দুর্ভাগ্য সাক্ষাৎ হয়নি তাঁকে কখনো দেখিনি। দীপ্তিমান লেখক ছফার বই পড়ে জানলাম, তিনি উঁচু কাতারের একজন দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক। অজানা কৌতূহল থেকে লেখক আহমদ ছফাকে জানার পিপাসা পেয়ে বসে।
একদিন গুণী মানুষটার স্মৃতিবিজড়িত চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের সাহিত্য পাড়ায় পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। আঁকাবাঁকা রাস্তা। সবুজ শ্যামল পাখিডাকা ছায়া-ঘেরা ছবির মতো সুনিবিড় গ্রাম। রাস্তার দু পাশে সবজি খেত, মরিচ, বেগুন,শিমের লতায় থোকা থোকা শিমের নাচন। বাগানের মাঝখানে কাকতাড়–য়া। পাকুড় গাছে দোয়েল পাখি শিস তুলছে। একটু সামনে গিয়ে দক্ষিণ গাছবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই ইশকুলে জীবনের প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন লেখক আহমদ ছফা, পরবর্তীতে গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটি লেখক আহমদ ছফা স্মৃতিবিজড়িত। পরিতাপের বিষয় দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই লেখক আহমদ ছফার কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। লেখকের পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবরাও কেউ এগিয়ে আসেনি। আমার কাছে মনে হয় একজন লেখক হচ্ছেন সমাজের তথা দেশের সবচেয়ে উচুকাতারের সম্মানী মানুষ। একজন আন্তর্জাতিকমানের বুদ্ধিজীবী ও লেখকের স্মৃতি না থাকা লজ্জার।
সাহিত্য পাড়ায় বাপ-দাদার ভিটে ও লেখকের ভাইপোদের জরাজীর্ণ বাড়িটি আছে। একসময় আহমদ ছফার মাটির ঘর ছিল সেটিও বিলুপ্ত। লেখকের খুব কাছের প্রতিবেশী নাতিসম্পর্কীয় তারেক বলল, ছফা দাদুর একটা মাটির ঘর ছিল বর্তমানে নেই। লেখকের বাড়ি ঘেঁষে ধীরগতিতে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে “বরুমতি খাল” আঞ্চলিক ভাষায় বলে “বৈরগনি খাল” দেখতে ছোটো নদীর মতো। এই খাল নিয়ে লেখকের একটা বইও আছে “বরুমতির আঁকেবাঁকে”।
কথাশিল্পী আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০ শে জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দক্ষিণ গাছবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী সম্পন্ন করে গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বোয়ালখালী কানুনগো পাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে কিছুদিন পড়াশুনা করেন। ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অনার্স অধ্যয়ন ও পরীক্ষা বর্জন। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ¯œাতকোত্তর করে পরবর্তীতে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্যারের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি গবেষণা (অসম্পূর্ণ) জার্মান ভাষা ডিপ্লোমা করেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে স্বল্পকালের জন্য অধ্যাপনাও করেন। ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখি শুরু। ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষকসমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। কৃষক আন্দোলন সংগঠনে থাকাকালীন সময়ে কারাবরণও করেছিলেন। দৈনিক গণকণ্ঠ ও সাপ্তাহিক উত্তরণ, উত্থান পর্বে নিয়মিত লিখতেন। উত্থান পর্বের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন লেখক নিজেই। উত্তরণের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। লেখালেখি ও সম্পাদনায় স্বচ্ছতা ও সাহসী ও স্পষ্টবাদিতায় সাংবাদিক মহলে বাংলাদেশের উজ্জ্বল এক দীপ্তিমান মেধাবী লেখক আহমদ ছফা। লেখক আহমদ ছফা যে শুধু লেখক দার্শনিক কথাসাহিত্যিক ছিলেন না তিনি ছিলেন মহৎ ও পরোপকারী মানুষ। তিনি প্রায়শ নিষ্পেষিত মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত প্রসারিত করতেন। ১৯৯১ সালে ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে অনেকের বাড়িঘর বিলীন হয়েছিল। লেখক আহমদ ছফা বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠানের আর্র্থিক সহায়তায় প্রায় একশত ঘর পুনর্নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। এছাড়াও গ্রামের দরিদ্র ও গরিব ছাত্র এবং আত্মীয়স্বজনের জন্য তিনি মাসে মাসে টাকা পাঠাতেন। এমনকি অনেক লেখক কবি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদেরকেও তিনি নানা সময়ে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন।
তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলা জার্মান সম্প্রীতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। লেখক ছফার অনবদ্য রচনাবলী কালের সাক্ষী অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায়, তথাপি তাহার নাম নিত্যান্দ রায়- লেখক আহমদ ছফা জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি অধ্যয়ন শুরু করেন। গুরু ও রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে তাঁর পাঠক নন্দিত বই -“যদ্যপি আমার গুরু” অনেক জনপ্রিয় একটি বই, এছাড়াও অর্ধশতাধিক বই রচনা করেছেন লেখক আহমদ ছফা, উল্লেখযোগ্য তাঁর জীবনের প্রথম গ্রন্থ বরুমতির আঁকেবাঁকে। প্রবন্ধসমূহের মধ্যে আছে জাগ্রত বাংলাদেশ, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, বাংলা ভাষা, রাজনীতির আলোকে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা, বাঙ্গালি মুসলমানের মন, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ, রাজনীতির লেখা, নিকট দূরের প্রসঙ্গ, সংকটের নানা চেহারা, সাম্প্রতিক বিবেচনা, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ, বাঙ্গালি জাতি এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্র, আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, সেই সব লেখা ইত্যাদি, উপন্যাস লিখেছেন অনেক ‘সূর্য তুমি সাথী’, ‘উদ্ধার’, ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’, ‘অলাতচক্র’, ওঙ্কার, গাভীবিত্তান্ত, অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী, পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ, নিহত নক্ষত্র, কবিতার বইও লিখেছেন, জল্লাদ সময় ও দুঃখের দিনের দোহা, একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা, লেনিন ঘুমাবে এবার, আহিতাগ্নি, এছাড়াও কিশোর গল্প ও শিশুতোষ ছড়া, ভ্রমণকাহিনি লোকজন ভাষার ব্যবহার, পুঁথিপুরাণের শব্দ প্রয়োগ ও বাক্যরীতির সঠিক চয়নে, অনুবাদ করেছেন জার্মান কবি গ্যাটের গুতের ফাউস্ট ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস অলাতচক্র অবলম্বনে হাবিবুর রহমান পরিচালিত “অলাতচক্র” নামে একটি ত্রিডি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে।
সাহিত্যের মাঝে অনন্তকাল বেঁচে থাকুক কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখে গেছেন। মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেছিলেন, “মৃত্যু হলো শোকের চেয়েও প্রয়োজনীয়, মৃত্যু জীবিতদের জন্যে স্পেস সৃষ্টি করে। মৃত্যু সৃষ্ট জীবের কলুষ কালিমা হরণ করে, মৃত্যু জীবনকে শুদ্ধ এবং পবিত্র করে”। জীবনের প্রতি কোন মায়া ছিল না। নিয়মকানুন মানতেন না, খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করতেন না, গানের কথায়ও লিখেছেন, “ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম আউল বাউল ফকির সেজে আমি কোনো ভেক নিলাম না”। গত ২০০১ সালে ২৮ জুলাই বাংলাদেশের সক্রেটিস খ্যাত কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা সবাইকে কাঁদিয়ে চিরতরে প্রস্থান নেন। সাহিত্য জগতের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বিচিত্র দার্শনিকের শেষের ঠিকানা হলো মিরপুর কবরস্থানের ব্লক ক, ২৮ লাইন ১০৮৫ নং সাড়ে তিন হাত মাটির কুটিরে শুয়ে আছেন। প্রিয় লেখকের শেষের ঠিকানা দেখতে গিয়েছিলাম। মসজিদের ঠিক পেছনে শুয়ে আছেন। কবরটি এতো সুন্দর লাল টালি ইটের ঘেরা মাঝখানে সবুজ দুর্বাঘাসের চাদর পাশে কামিনি ফুলের গাছ দেখে মুগ্ধ হলাম। ভাবলাম দেশের মানুষ প্রকৃতিপ্রেমি স্পষ্টবাদী লেখক ও বু্দ্ধিজীবীকে চিনতে না পারলেও প্রকৃতি ঠিকই চিনেছেন। প্রকৃতি তার নিজস্ব তুলি দিয়ে সমাধিটি যেন সাজিয়েছেন। লেখকের এপিটাপে যখন ঝাপসাচোখে পড়ছিলাম-
“আমার কথা কইবে পাখি করুণ করুণ ভাষে
আমার দুঃখ রইবে লেখা শিশির ভেজা ঘাসে
আমার গান গাইবে দুঃখে পথ হারানো হাওয়া
আমার নাম বলবে মুখে মেঘের আসা যাওয়া
ইন্দ্রধনু লিখবে লিখন কেমন ভালোবাসে
দীঘল নদী করবে রোদন সমাধিটির পাশে”-লেখক আহমদ ছফা।
চোখের কোণে কখন যে জল গড়িয়ে পড়লো টেরও পায়নি- বর্তমান প্রজন্মের দাবি একটাই কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফাকে যেন মরণোত্তর বাংলা একাডেমি পদকসহ যথাযথভাবে মূল্যায়ন ও সম্মাননা দেওয়া হয়।
লেখকের ৮১তম জন্মবার্ষিকীতে প্রত্যাশা ‘আহমদ ছফার’ নামে গাছবাড়িয়া গ্রামে তার স্মৃতিবিজড়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখকের নামে পাঠাগার,ভবন ও সড়কের নামকরনসহ ‘আহমদ ছফা একাডেমি’ স্থাপন করার জন্য জন্য চন্দনাইশের সম্মানিত জনপ্রতিনিধিদের সু-দৃষ্টি কামনা করছি।
লেখক: কলামিস্ট